আসিফ বলল, তােমার নাম কি? পুষ্প ধরা গলায় বলল, আমার নাম দিয়ে আপনার কোনাে দরকার নেই।‘ এটা সে কেন বলল কে জানে? লেখকের উপর তার অসহ্য রাগ লাগছিল। এই রাগের জন্যেই হয়ত বলেছে। এখন আবার তার জন্যে খারাপ লাগছে।
হলঘরের ভেতর অসহ্য গরম।
বাইরে এসে একটু আরাম লাগছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। লীনা হালকা গলায় বলল, ‘বৃষ্টি হবে না কি? আসিফ জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে অন্য কিছু ভাবছে।
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বলল, ‘কিছু ভাবছ নাকি?”
‘বচ্ছ পানির তৃষ্ণা পেয়েছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলে কেমন হয়? ‘ভালােই হয়।
তারা দু‘জন কনফেকশনারি দোকানে ঢুকল। লীনার কী যেন একটা বলার কথা, অথচ কিছুতেই মনে পড়ছে না। মাঝে–মাঝে তার এ রকম হয়। খুব জরুরি কথা, যেটা না বললেই নয়—অথচ মনে পড়ে না।
লীনা।‘
‘টিভিতে একটা অফার পেয়েছি, যাব কি–না বুঝতে পারছি না।
যাবে না কেন?‘ ‘কখনাে করি নি তাে। বুঝিও না। তাছাড়া | ‘তাছাড়া কি?
‘রােলটা খুব ছােট। নায়কের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। নায়কের কাছে দু’বার টাকা ধার চাইতে আসে। এই পর্যন্তই। অভিনয়ের কোনাে স্কোপ নেই।
‘তা হলে যাবে কেন? তােমার মতাে এত বড় অভিনেতা। তুমি যদি টিভিতে যাও সুপার স্টার হয়ে যাবে।‘
আসিফ হাসল। লীনা বলল, আমি মােটেও হাসির কথা বলি নি। তুমি হচ্ছ সুপার–সুপার স্টার। তুমি নিজেও সেটা খুব ভালাে করেই জান। জান না?
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ জবাব দিল না। নিজের সম্পর্কে তার ধারণা বেশ উচু। সে খুব ভালাে করেই জানে তার ক্ষমতা কতটুকু। তার আশেপাশে যারা আছে তারাও জানে। ক্ষমতা তেমন কাজে আসছে না। তাদের দলটা ছােট–অভিনেতা–অভিনেত্রী তেমন নেই। মঞ্চে যেদিন শাে হয়, সেদিন অডিটরিয়াম প্রায় ফাঁকা থাকে। বড় কোনাে দলে যদি সুযােগ পাওয়া যেত। তবে দলটির প্রতি তার মমতা আছে। এরা তার জন্যে অনেক করেছে। প্রথম বারেই প্রধান চরিত্র তারা তাকে দিয়েছে। অন্য কোনাে দল তা করত না।
লীনা বলল, তুমি কোনাে কিছু নিয়ে খুব চিন্তা করছ বলে মনে হচ্ছে। ‘না তা করছি না। কোক শেষ হয়েছে? চল রওনা দিই। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। লীনা বলল, ‘কিছুক্ষণ হাঁটি, তারপর রিকশা নেব। হাঁটতে ভালাে লাগছে।
বেশ তাে চল হাঁটি।‘
লীনা ছােট ছােট পা ফেলে হাঁটছে। সে আসিফের হাত ধরে আছে। রিহার্সেলের সময় খুব ক্লান্তি লাগছিল। এখন বেশ ভালাে লাগছে। আসিফ ঘড়ি দেখল রাত দশটা। আশপাশ কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ছিনতাই পার্টির সামনে না পড়লেই হল।
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বলল, তােমাকে কি একটা জরুরি কথা বলতে চাচ্ছিলাম, এখন আর কিছুতেই মনে পড়ছে না।
‘তাহলে বােধ হয় তেমন জরুরি নয়। ‘না, জরুরি। খুবই জরুরি। আমার মাথায় কী যেন হয়েছে বুঝলে––কিছু মনে থাকে না। ব্রেইন টিউমারফিউমার কিছু একটা হয়েছে।
আসিফ তার জবাব দিল না। সিগারেট ধরাল। হাত ইশারা করে খালি রিকশা
ডাকল। ক্লান্ত গলায় বলল, “আর হাঁটতে পারছি না, চল রিকশায় উঠি। তােমার জরুরি কথাটা মনে পড়েছে?
না। তুমি যখন আশেপাশে থাকবে না তখন হয়ত মনে পড়বে। আমি ঠিক করেছি মনে পড়লেই একটা কাগজে লিখে ফেলব। কাগজটা থাকবে আমার ব্যাগে।
‘বুদ্ধিটা খারাপ না।
রিকশা দ্রুত চলছে। হাওয়ায় লীনার শাড়ির আঁচল উড়ছে। লীনা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে বলল, এক সময় আমরা একটা গাড়ি কিনব, বুঝলে। তারপর রােজ রাতে গাড়িতে করে ঘুরব। তুমি চালাবে। আমি তােমার পাশে থাকব।
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ জবাব দিল না। লীনা যখন কথা বলে তখন সে বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকে। বিয়ের প্রথম দিকে লীনার অসুবিধা হত। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। আসিফ কথা
বললেও তার অসুবিধা হয় না।
‘আজ রিহার্সেলে নতুন মেয়েটাকে দেখেছ? পুষ্প নাম।
‘হ্যা দেখলাম। কথাও তাে বললাম। অভিনয় না কি পারে না, বজলু ভাই বলছিলেন।
‘মেয়েটা অভিনয় দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল।”
‘এই দেখে তােমার কোনাে স্মৃতি মনে পড়ে নি?”
কোন স্মৃতি? একটু মনে করে দেখ।
আসিফ তেমন কিছু মনে করতে পারল না। লীনার খানিকটা মন খারাপ হল। সে চাপা গলায় বলল, তােমার সঙ্গে ঠিক এইভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল। মনে আছে? ময়মনসিংহ টাউন ক্লাবে নাটক করছিলে। তুমি হলে মধু পাগলা। মনে আছে?
‘আছে।”
তােমার ছেলে মরে গেছে, তার ডেডবডি নিয়ে তুমি যাচ্ছ। আপন মনে কথা বলছ। অভিনয় যে এত সুন্দর হতে পারে ঐদিন প্রথম বুঝলাম, কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড করেছি। শেষে বাবা আমাকে হলের বাইরে নিয়ে যান। তখনাে আমি ফোঁপাচ্ছিলাম। তােমার কিছু মনে নেই, তাই না। ‘মনে থাকবে না কেন? মনে আছে নাটকটা সুবিধার ছিল না। মেলােড্রামা। খুবই দুর্বল সংলাপ।
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
রিকশা গলির মােড়ে থামল। জায়গাটা হচ্ছে শান্তিবাগ। গলির ভেতর তিন তলা বাড়ির দোতলায় তারা থাকে। একটাই ফ্ল্যাট। দুটি পরিবার শেয়ার করে। কমন রান্নাঘর। তবে তাতে তেমন অসুবিধা হয় না।
বাড়ির গেটের কাছে এসে আসিফ থমকে দাঁড়াল। বিব্রত গলায় বলল, ‘আমি তােমার সঙ্গে আর যাচ্ছি না। সকালে ফিরব।‘
লীনা অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে।
‘শেলীর এ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হবে রাত এগারটায়। থাকা দরকার। পুলাভাই চিটাগাং গেছেন। বড় আপা একা।
এতক্ষণ এটা আমাকে বল নি কেন?
এইতাে বললাম। ‘চল, আমিও তােমার সঙ্গে যাই।
‘ভােমার যাওয়ার দরকার নেই। তুমি বিশ্রাম নাও। ভােমার শরীর খারাপ রেস্ট দরকার।
‘আমার শরীর খারাপ তােমাকে বলল কে?
‘কয়েক রাত ধরেই তাে ঘুমুতে পারছ না। যতবারই উঠি, দেখি চুপচাপ বিছানায় বসে আছ।‘
লীনা বলল, ‘বেশ তাে যাবে যাওভাত খেয়ে যাও! ‘ভাত খাব না। একদম খিদে নেই। সন্ধ্যাবেলা ভাজাভুজি কি সব খেয়েছি, টক ঢেকুর উঠছে। যাই লীনা।
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা বেশ মন খারাপ করে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। জরুরি কথাটা এখন তার মনে পড়েছে। চেঁচিয়ে ডাকবে আসিফকে? ডেকে বলবে জরুরি কথাটা? ঢাকাটা কি ঠিক হবে? এখন মনে হচ্ছে কথাটা তেমন জরুরি নয়।
দোতলার ফ্ল্যাটটা লীনারা যাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকছে, তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। স্বামী স্ত্রী এবং তিন বছর বয়েসী একটি মেয়ে। এক জন কাজের ছেলে আছে, সে বেশিরভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। পরিবারের কর্তা হাশমত আলি বেশ বয়স্ক লােক। চল্লিশের মতাে বয়স। আগে একবার বিয়ে করেছিলেন। ঐ পক্ষের দুটি মেয়ে আছে। মেয়েরা তাদের নানার বাড়িতে থাকে। নানার বাড়ি টঙ্গিতে। মাঝে–মাঝে আসে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যাবেলা চলে যায়। হাশমত সাহেবের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী বেনু।
সাজঘর (পর্ব-৪): হুমায়ূন আহমেদ
এই মেয়েটার বয়স খুবই কম। পনেরাে ষােল হওয়া বিচিত্র নয়। গ্রামের মেয়ে। তবে শহরের চাল–চলন দ্রুত আয়ত্ত করে ফেলেছে। মেয়েটি সুন্দরী, তবে বাচ্চা হবার পর গাল–টাল ভেঙে গেছে। বাচ্চাটা মায়ের কোল ছাড়া থাকতেই পারে না। বেনুকে সারাদিন বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরতে হয়। লীনাকে সে খুবই পছন্দ করে। যতক্ষণ লীনা বাসায় থাকে বেনু তার পেছনে থাকে। ব্যাপারটা লীনার পছন্দ না হলেও কিছু বলে না।
এই সাদাসিধা অল্প বয়েসী মেয়েটাকে লীনার ভালােই লাগে। সেই তুলনায় হাশমত আলিকে তার একেবারেই ভালাে লাগে না। লােকটার সব কিছুই কেমন যেন গ্রাম্য। রেলের বাঁধা মাইনের চাকরিতেও তার রােজগার সন্দেহজনকভাবে ভালাে। তবে তার ব্যবহার ভালাে। গত মাসে সে একটা ফ্রিজ কিনেছে এবং লীনাকে বলেছে, কিছু এরিয়ার টাকা পেলাম, তারপর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লােন নিলাম, তারপর কিনে ফেললাম। একটা শখ ছিল ভাবি।
লীনা বলল, ‘ভালাে করেছেন।
(চলবে)