এখন আরাম করে ঠাণ্ডা পানি খেতে পারবেন। হা হা হা। বেনু, ভাবীকে একটা পেপসি দাও।‘
এখন ধাক। ‘না ভাবি খান। খেতে হবে। এটা ভাবি আপনি নিজের ফ্রিজ ভাববেন। রিকোয়েস্ট। বেনু শােন, নিচের একটা তাক ভাবির।
খবরদার কিছু রাখবে না। যদি দেখি তােমার কিছু আছে তাহলে অসুবিধা আছে। জিনিসটা কেমন কিনলাম ভাবি? ভালাে না?
খুব ভালাে। খুব সুন্দর। ‘অনেকগুলাে টাকা চলে গেল, তবু শখের একটা জিনিস, তাই না ভাবি? ‘তা তাে বটেই। হাশমত আলির মধ্যেও এক ধরনের সরলতা আছে। এটা লীনার ভালাে লাগে।
এরা সুখেই আছে। নিজেদের নিয়ে আনন্দে আছে। পৃথিবী সমাজ উমাজ এইসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসে এরা গভীর আনন্দ খুঁজে পায়। প্রায়ই দেখা যায় অনেক রাতে হাশমত আলি বড়–সড় একটা মাছ কিনে এনেছে। বেনু। সেই মাছ কাটছে। হাশমত আলি উবু হয়ে তার সামনে বসে আছে। মাছটা কী রকম, সেই নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ
পুকুরের মাছ, কী বল বেনু? রঙটা কেমন কালাে দেখ না। শ্যাওলার নিচে থেকে কালাে হয়ে গেছে। নদীর মাছ হলে লাল হত। তেলটা ঠিক আছে কিনা দেখ তাে।‘
‘ঠিকই আছে। ‘তেল দিয়ে বড়া বানাতে পারবে। মাছের তেলের বড়া—তার স্বাদই অন্যরকম। দুটো বড় করে পিস কাট। ভেজে লীনা ভাবিদের দিয়ে এস।”
‘ওরা বােধ হয় শুয়ে পড়েছে। সকালে দেব। ‘আরে না এখনই দাও। টাটকা জিনিসের একটা আলাদা ব্যাপার আছে।
গভীর রাতে প্লেটে ভাজা মাছ নিয়ে হাশমত আলি নিজেই দরজা ধাক্কায়, ‘ভাবি ঘুমিয়ে পড়লেন না কি? ও ভাবি, ভাবি।
পরিষ্কার বােঝা যায় এই পরিবারটি লীনাদের বেশ পছন্দ করে। কেন করে সেও এক রহস্য। এতদিন একসঙ্গে আছে, এর মধ্যে একদিনও নাটক দেখার ব্যাপারে কোনাে আগ্রহ দেখায় নি। হাশমত আলি অবশ্যি প্রায়ই বলে, ‘একদিন যাব। বুঝলেন ভাবি, আপনাদের কাণ্ডকারখানা দেখে আসব। মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল। সারাক্ষণ ভ্যা–ভ্যা করে। বাচ্চা নিয়ে কি যাওয়া যায় ভাবি? বেনুকে একদিন নিয়ে দেখাব। গ্রামের মেয়ে, কিছু তাে এই জীবনে দেখে নি।
সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ
সিঁড়ির বাতি বােধ হয় আবার চুরি হয়েছে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে উঠতে হচ্ছে। একটা সিড়ি আছে ভাঙা। বাড়িওয়ালাকে কতবার বলা হয়েছে। এখনাে কিছু করছে না।
দরজা খুলে দিল বেনু। অবাক হয়ে বলল, ‘এত রাতে একা–একা আসলেন ভাবি!‘
না একা না। তােমার ভাই নামিয়ে দিয়ে গেছে। ভাই আবার গেলেন কই? ‘তার এক ভাগ্নির অপারেশন। ‘ও আল্লা! কী হইছে?
কী হয়েছে লীনা নিজেও ভালােমতাে জানে না। জানা উচিত ছিল। কথাবার্তা শুনে হাশমত বেরিয়ে এল। হাসিমুখে বলল, ‘একটা ভিসিপি ভাড়া করে নিয়ে এসেছি ভাবি।
‘তাই নাকি?
‘তিন শ‘ টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের জন্যে ভাড়া করলাম। মনের শখ মিটিয়ে ছবি দেখব।
‘ভালােই তাে।
‘খাওয়া দাওয়া করে আসেন। এক সঙ্গে দেখি—এগারটা ছবি এনেছি। সব ভালাে–ভালাে ছবি। আসিফ ভাই কই?
‘ওর এক ভাগ্নিকে দেখতে গেছে। ভােরবেলা আসবে। ‘আমি ভাবি দু‘দিনের ছুটি নিয়ে নিয়েছি। ক্যাজুয়েল লিভ। দিনরাত ছবি দেখব। ‘ভালাে। দেখুন। ‘আপনি ভাত খেয়ে আসুন। একা একা ছবি দেখে সুখ নেই ভাবি।
প্লেটে ভাত নিয়ে লীনা শােবার ঘরে চলে এসেছে। লীনার পেছনে পেছনে ঢুকেছে বেনু। ভাত খাওয়া হলে জোর করে তাকে ছবি দেখাতে নিয়ে যাবে। লীনার চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু মনে হচ্ছে তাকে ছবি দেখতেই হবে।
সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ
‘ভাবি?’
কী বেনু।
‘আপনি এত কাজ সারাদিনে ক্যামনে করেন তাই ভাবি। দিনে স্কুল। রাতে নাটক, থিয়েটার।
‘তুমিও তাে অনেক কাজ কর। ঘরের সব কাজ সামলাও, বাচ্চা দেখ। বাচ্চা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”
‘জ্বি। অনেক কষ্টে ঘুম পাড়াইছি। এরে একটা তাবিজ–টাবিজ দিতে হইব ভাবি। ‘তুমি কোলে নিয়ে নিয়ে মেয়েটাকে নষ্ট করেছ বেনু। ‘তাও ঠিক।
বেনু তৃপ্তির হাসি হাসল। যেন সে মেয়েকে নষ্ট করায় খুব আনন্দিত। সব মায়েরা যা পারে না সে ত পেরেছে।
‘ভাবি। ‘বল।
বেনু ইতস্তত করে বলল, ‘একটা শরমের কথা ভাবি। খুকির আব্বা কেমুন একটা ছবি আনছে। অসত্য কাণ্ডকারখানা। দেখলে শইল ঝিম ঝিম করে।‘
না দেখলেই হয়। ‘আমি খুকির আরে বলছি—এই ছবি দেখলে পাপ হইব। সে খালি হাসে। এইসব ক্যামনে বানায় আফা?
‘জানি না বেনু।
লীনাকে ছবি দেখার জন্যে বসতে হল। দিদার নামের কি একটা পুরনাে সিনেমা হচ্ছে। হিন্দী প্রতিটি বাক্য হাশমত আলি অনুবাদ করে দিচ্ছে খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। প্রচণ্ড ঘুমে শরীর আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। | ছবি মাঝপথে রেখে লীনা উঠে এল। আর আশ্চর্য, বিছানায় শােয়ামাত্র ঘুম উধাও। লীনা অনেকক্ষণ এপাশ–ওপাশ করল। মাথায় পানি দিয়ে এল, লাভ হল না। এই রাতটাও সম্ভবত অঘুমে কাটাতে হবে। এ রকম হচ্ছে কেন? তার মনে কি কোনাে গােপন দুঃখ আছে? কোনাে হতাশা আছে? থাকার তাে কথা নয়। তাহলে এ রকম
হচ্ছে কেন?
সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ
বাবার অভিশাপ লাগল নাকি?
লীনার বাবা ডিস্ট্রিকট জাজ ওয়াদুদুর রহমান সত্যি–সত্যি মেয়েকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। জাজ শ্রেণীর মানুষরা কখনাে খুব বেশি রাগতে পারেন না। কিন্তু তিনি রেগে গিয়েছিলেন। রাগে অন্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘কী আছে ঐ ছেলের? অভিনয় করে। অভিনয়টা আবার কি? অভিনয় হচ্ছে অনুকরণ। একটা বানরও অনুকরণ করে। তাই বলে একটা বানরকে বিয়ে করা যায়?
লীনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এসব তুমি কী বলছ বাবা?”
ওয়াদুদুর রহমান সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘যা বলেছি ঠিকই বলেছি। ঐ ছেলের আর আছে কী? ঘাড়ে–গর্দানে এক ছেলে। থার্ড ক্লাস পেয়েছে বি. এ– তো ব্যাংকে চাকরি করে। ঐ চাকরির বেতন কত তুই জানিস? এগার শ’ টাকা। এগার শ’ টাকা দিয়ে ও নিজে খাবে, না তােকে খাওয়াবে? না কি না খেয়ে থাকবে আর অভিনয় করে দেখাবে যে খুব খাওয়া হল?
সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ
‘ছিঃ বাবা, এই ভাবে কথা বল না।
‘আমার যা বলার আমি বললাম। এখন তাের যা ইচ্ছা করবি। তাের স্বাধীন ইচ্ছায় আমি বাধা দেব না। তবে এই বাড়িতে বিয়ে হবে না। বিয়ের খরচ আমি দেব। সেই টাকা আলাদা করা।‘
‘তােমার টাকা আমার লাগবে না বাবা।
‘নাটকের লােক বিয়ে করার আগেই নাটকের সংলাপ শুরু করেছিস। জীবন। নাটক না, এটা হাড়ে হাড়ে টের পাবি। জীবন এক সময় অসহ্য বােধ হবে।
অভিশাপ দিচ্ছ? ‘সত্যি কথা বলছি। মাঝে–মাঝে সত্যি কথা অভিশাপের মতাে মনে হয়।‘
লীনার বিয়ে হল বড় খালার বাড়িতে। সেই বিয়েতে ওয়াদুর রহমান সাহেব এলেন না। তবে লীনার ধারণা তার বাবার অভিশাপ লাগে নি। তারা সুখী। প্রচণ্ড সুখী। টাকা পয়সার কষ্ট তাে আছেই। এই কষ্ট তেমন কোনাে কষ্ট নয়। সহনীয় কষ্ট। অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে ভালবাসার অভাবের কষ্ট। সে কষ্ট লীনাদের হয় নি। লীনা এখনাে। তার স্বামীর প্রতি তীব্র ভালবাসা বােধ করে। ভালবাসা কখনাে একপক্ষীয় হয় না। আসিফও নিশ্চয়ই তার প্রতি সমপরিমাণ ভালবাসা লালন করে। কিন্তু সত্যি কি করে?
সাজঘর (পর্ব-৫): হুমায়ূন আহমেদ
লীনা উঠে পড়ল। আবার মাথায় কিছু পানি দিল। পাশের ঘরে ভিসিপি চলছে। যুগল সংগীত। সুর বেশ সুন্দর। কথাগুলাের মানে কি কে জানে— ও মেরা পানছেরি।
পানছেরি শব্দের মানে কি? হাশমত সাহেবকে কাল একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। মনে থাকলে হয়। আজকাল কিছু মনে থাকে না।
বেনুর বাচ্চা জেগে উঠেছে। কাঁদছে ট্যা–ট্যা করে। বেনু তাকে নিয়ে বারান্দায় হাটছে আর বলছে, ও খুকি কান্দে না। ও খুকি কান্দে না।
(চলবে)