সাজঘর (পর্ব-৮): হুমায়ূন আহমেদ

শাড়ির আঁচলের ভাঁজ থেকে লীনা কালাে রঙের কী যেন বের করলআসিফ বলল, এটা কি

নটরাজের একটা মূর্তিআমার ছোেটবােন শান্তিনিকেতন থেকে আমার জন্যে এনেছিলআমার খুব প্রিয়আপনি নিনআপনার টেবিলে সাজিয়ে রাখবেনপ্লিজ, জি ।

সাজঘরতখন আসিফের বয়স ছিল অল্পহৃদয় আবেগে পরিপূর্ণরাতটাও ছিল অন্য রকমচৈত্র মাসের রহস্যময় রাতচারদিকে উথাল পাথাল চাঁদের আলাে। পাশে নটরাজের মূর্তি হাতে দেবীর মতাে এক তরুণীতরুণীর কণ্ঠস্বর বড় মিথ্যআসিফের চোখে জল এসে গেলসেই জন্য গােপন করার কোনাে চেষ্টা সে করল না

কেন যেন তার মনে হল, এই নারীর কাছে তার গােপন করার কিছুই নেইএই নারী সর্বজ্ঞ ঈশ্বর। নটরাজের মূর্তি আসিফ নিজের কাছে রাখে নিরূপার মেডেলের মত মূর্তিটি সে কুয়ায় ফেলে দিয়েছিলকেন সে এটা করল? পৃথিবীর মতে, চৈত্র মাসের চাঁদের মতল, গহীন অরণ্যের মতাে মানুষও রহস্যময়। 

ঘুমুচ্ছিস নাকি রে আসিফ

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

আসিফ চমকে উঠলসে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলতার বেশ লজ্জা লাগছেভাগ্নির এত বড় একটা অপারেশন হচ্ছে, আর সে কি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেরেহানা 

বললেন, অপারেশন হয়ে গেছেপুতুল ভালাে আছেজ্ঞান ফিরেছে, কথাটথা বলল। 

বাহ্, চমৎকার তােতুমি এখন রেস্ট নাও আপাখুব ধকল গেছে। 

রেহানা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আসিফের পাশে বসলক্লিনিকের এই ঘরটা এখন প্রায় ফাঁকাআত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল সবাই চলে গেছেআসিফের মেঝো বােন এখনাে আছেসে দাঁড়িয়ে আছে ইনটেনসিভ কেয়ার ঘরটার পাশেতারও চলে যাবার কথাগাড়ি গিয়েছে একজনকে নামিয়ে দিতেগাড়ি এলেই সেও চলে যাবেএখানে থাকার আর কোনাে মানে হয় না। 

রেহানা বলল, আসিফ তুই কী করবি? থাকবি না চলে যাবি? আমার অসুবিধা নেই, থাকতে পারি‘ 

তাের খিদে লেগেছে বােধ হয়রাতে তাে খাস নিনা খিদে লাগে নিতাের বউ কেমন আছে? ভালােই। 

অনেক দিন দেখি নাতােরা আসিস না কেন? ব্যস্ত থাকিনাটক নিয়ে ব্যস্ত

কে যেন বলছিলবউকেও নামিয়েছিসএসব কী কাণ্ড বল তােনিজে যা করছিস তাই যথেষ্ট, তার উপর যদি....। আসিফ কিছু বলল নাহাই তুললরেহানা বললেন, নাটক নাটক করে তাের লাভটা কী হয়েছে শুনি? এমন তাে না যে দশটা লােক তােকে চেনেতাের তাে কিছুই হয় নি। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

তা ঠিক। 

এই জীবনে কোথাও স্থির হতে পারলি নাআজ এই চাকরি, কাল চাকরিতাের বয়স হচ্ছে না

বয়স হলে মানুষের একটা সিকিউরিটির দরকার হয়একটা বাড়িকিছু টাকা পয়সা.... তাের আছে কি

এইসব বাদ দাও। 

বাদ দাও বললেই বাদ দেয়া যায়? এই যে পুতুলের অপারেশন হলবার তের হাজার টাকা খরচ হয়েছেটাকা ছিল বলে খরচ করতে পেরেছিযদি না থাকত? তাের এই রকম কিছু হলে তুই কী করবি

কী আর করব? হাসপাতাল যাববিনা পয়সার চিকিৎসার চেষ্টা করব। 

তুই হয়ত ভাবিস ভােকে নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করি নাএটা ঠিক নাপ্রায়ই আমাদের বােনদের মধ্যে আলােচনা হয়খুবই কষ্ট লাগে। 

কষ্ট লাগার কি আছে

কষ্ট লাগার কিছু নেই? কী বলছিস তুই! একটা বাড়িতে থাকিস, সেই বাড়ির রান্নাঘর অন্য এক জনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। এটা কেমন কথা

সবার তাে সব কিছু হয় । 

চেষ্টা করলে ঠিকই হয়চেষ্টা না করলে হবে কীভাবে? কোনাে রকম চেষ্টা নাই, বড় হবার ইচ্ছা নাইনাটক, নাটক, নাটক। 

এইসব বাদ দাও আপা, দেখি চা পাওয়া যায় কি নামাথা ভারভার লাগছেচা খেলে ভালাে লাগবে‘ 

রাত দুপুরে চা পাবি কোথায়? চুপ করে বােসতাের সঙ্গে দেখাই হয় নাসুযােগ পাওয়া গেল। 

আসিফ সিগারেট ধরালতার সত্যিসত্যি ঘুম পাচ্ছেসিগারেটের ধোঁয়া দিয়েও ঘুম তাড়ান যাচ্ছে নারাত জাগার জন্যেই বােধ হয় প্রচণ্ড খিদেও লাগছেখালি পেটে সিগারেট নাভিতে পাক দিচ্ছেমনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

আসিফবল আপাতুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল তাে। 

বেশিরভাগ সময়ই আমি সত্যি কথা বলিতাের কি এখন চাকরি নেই?” 

এই কথা বলছ কেন? তুই তাের দুলাভাইকে বলেছিস তাের জন্যে একটা কিছু দেখে দিতেএই থেকে অনুমান করছিতাের কি চাকরি নেই

না নেইদিন ধরে নেই? মাস দুইতাের বউ জানে ? জানবে না কেন? জানে। 

তবু তুই নাটক কবি? এর পরেও তাের শিক্ষা হয় না? তুই কি মানুষ না জানােয়ার

রেহানা উঠে চলে গেলেনআসিফ একা একা বসে রইল। 

বেশিক্ষণ একা বসে থাকতে হল নারেহানা আবার এসে ঢুকলেনতিনি খুবকঠিন কিছু কথা বলতে এসেছিলেন বলতে পারলেন নাআসিফের বসে থাকার ভঙ্গিটি দেখে তাঁর খুব মায়া লাগল। 

লীনা যে স্কুলে পড়ায় তার নামলিটল ফ্লাওয়ার্সইংরেজি স্কুলখাজনার চেয়ে বাজনা বেশিনানান কায়দা কানুনসপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষামাসে একবার আউটিং। 

আজ সেই আউটিংয়ের দিনলীনাকে ক্লাস ওয়ানের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে হবে সাভার স্মৃতিসৌধেএকটা মাইক্রোবাস জোগাড় করা হয়েছেলীনার সঙ্গে যাচ্ছে অতসী দি। গেম টিচারমাইক্রোবাসে ওঠবার ঠিক আগ মুহূর্তে লীনা অতসীকে বলল

আমার না শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি। 

অতসী বলল, যেতে চাও না? নাশরীরটা খুবই খারাপ লাগছেমনে হচ্ছে ফেইন্ট হয়ে যাবঅতসী বলল, তুমি কি কনসিভ করেছ নাকি

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

লীনা জবাব দিল নাএসব নিয়ে কথা বলতে ভালাে লাগে না অথচ বিবাহিত মেয়েরা কত স্বাভাবিক ভাবেই না এসব নিয়ে আলাপ করেলীনার মাঝেমাঝে মনে হয়তার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা আছে। 

তুমি এখন না গেলে বড় আপা খুব রাগ করবেন। 

শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দিতােমাকে দেখেই বুঝতে পারছিদাঁড়াও, আপার সঙ্গে আলাপ করে আসি। 

লীনা ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইলবাচ্চাগুলাে মাইক্রোবাসে উঠে বসে আছেকোনাে সাড়াশব্দ করছে না, যেন একদল রােবটট্রেনিং দিয়ে দিয়ে এদের রােবট বানিয়ে ফেলা হচ্ছেহুকুম ছাড়া এরা মুখ খুলবে নাএর কোনাে মানে হয়শিশুরা থাকবে শিশুদের মতােহৈচৈ করবে, মারামারি করবে, কাঁদবে, হাসবে। 

অতসী ফিরে এসে বলল, ব্যাপার সুবিধার না লীনাবড় আপা খুব রেগে গেছেতুমি যাও শুনে আস। 

প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন সত্যিসত্যি রেগেছেনলীনাকে ঢুকতে দেখে তিনি শুকনাে গলায় বললেন, বােসবলেই টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

হ্যালাে, প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন বলছি...‘ 

এইসব কেজি স্কুলগুলাের প্রধানরা বিচিত্র কারণে প্রিন্সিপ্যাল পদবী নেনকেজি স্কুলগুলােতে কোনাে হেডমিসট্রেস নেইসব প্রিন্সিপ্যালএরা কথাবার্তায় সতুর ভাগ ইংরেজি বলেনঅদ্ভুত ধরনের ইংরেজি। 

লীনা‘ জি আপাআপনি এসব কী শুরু করেছেন বলুন তাে? তেমন কিছু তাে শুরু করি নি আপাশরীরটা ভালাে না, এটাই বলছিএকটা এ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পূর্ণ হবার পর আপনারা বলবেল শরীর খারাপ, তাহলে কী করে হবে বলুন? আর এই শরীর খারাপ ব্যাপারটাও তাে নতুন না

দুদিন পরপর শুনছি শরীর খারাপ। ভাবে তাে আপনি মাস্টারি করতে পারবেন নাআপনি বরং অন্য কোনাে প্রফেসন খুঁজে বের করুন যেখানে তেমন কাজকর্ম নেই। 

সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ

লীনা উঠে দাঁড়ালজোবেদা আমিন ঝাঁঝালাে গলায় বললেন, যাচ্ছেন কোথায়? বাসায় চলে যাবশরীরটা ভালাে লাগছে না| জোবেদ আমিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। লীনার খুব ইচ্ছা করছে বলে, আপনি কি আপা কখনাে লক্ষ করেছেন যে আপনার গোঁফ আছে? গায়ের রঙ কালাে বলে তেমন বােঝা যাচ্ছে নাফর্সা হলে রােজ শেভ করতে হত। 

কথাটা বলা হল নালীনা বাসায় চলে এলবাসায় এসেই শরীর খারাপ ভাবটা কেন জানি কেটে গেলসে বেনুর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করলখুকিকে গামলায় পানি 

নিয়ে গােসল করিয়ে দিল। 

(চলবে)

সাজঘর (পর্ব-৭): হুমায়ূন আহমেদ

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *