শাড়ির আঁচলের ভাঁজ থেকে লীনা কালাে রঙের কী যেন বের করল। আসিফ বলল, ‘এটা কি?
‘নটরাজের একটা মূর্তি। আমার ছোেটবােন শান্তিনিকেতন থেকে আমার জন্যে এনেছিল। আমার খুব প্রিয়। আপনি নিন। আপনার টেবিলে সাজিয়ে রাখবেন। প্লিজ, জি ।
তখন আসিফের বয়স ছিল অল্প। হৃদয় আবেগে পরিপূর্ণ। রাতটাও ছিল অন্য রকম। চৈত্র মাসের রহস্যময় রাত। চারদিকে উথাল পাথাল চাঁদের আলাে। পাশে নটরাজের মূর্তি হাতে দেবীর মতাে এক তরুণী। তরুণীর কণ্ঠস্বর বড় মিথ্য। আসিফের চোখে জল এসে গেল। সেই জন্য গােপন করার কোনাে চেষ্টা সে করল না।
কেন যেন তার মনে হল, এই নারীর কাছে তার গােপন করার কিছুই নেই। এই নারী সর্বজ্ঞ ঈশ্বর। নটরাজের মূর্তি আসিফ নিজের কাছে রাখে নি। রূপার মেডেলের মত মূর্তিটি সে কুয়ায় ফেলে দিয়েছিল। কেন সে এটা করল? পৃথিবীর মতে, চৈত্র মাসের চাঁদের মতল, গহীন অরণ্যের মতাে মানুষও রহস্যময়।
‘ঘুমুচ্ছিস নাকি রে আসিফ?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
আসিফ চমকে উঠল। সে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। তার বেশ লজ্জা লাগছে। ভাগ্নির এত বড় একটা অপারেশন হচ্ছে, আর সে কি না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। রেহানা
বললেন, ‘অপারেশন হয়ে গেছে। পুতুল ভালাে আছে। জ্ঞান ফিরেছে, কথাটথা বলল।
‘বাহ্, চমৎকার তাে। তুমি এখন রেস্ট নাও আপা। খুব ধকল গেছে।
রেহানা ক্লান্ত ভঙ্গিতে আসিফের পাশে বসল। ক্লিনিকের এই ঘরটা এখন প্রায় ফাঁকা। আত্মীয়স্বজন যারা এসেছিল সবাই চলে গেছে। আসিফের মেঝো বােন এখনাে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে ইনটেনসিভ কেয়ার ঘরটার পাশে। তারও চলে যাবার কথা। গাড়ি গিয়েছে একজনকে নামিয়ে দিতে। গাড়ি এলেই সেও চলে যাবে। এখানে থাকার আর কোনাে মানে হয় না।
রেহানা বলল, ‘আসিফ তুই কী করবি? থাকবি না চলে যাবি? ‘আমার অসুবিধা নেই, থাকতে পারি।‘
তাের খিদে লেগেছে বােধ হয়। রাতে তাে খাস নি। ‘না খিদে লাগে নি।‘ ‘তাের বউ কেমন আছে? ‘ভালােই।
অনেক দিন দেখি না। তােরা আসিস না কেন? ‘ব্যস্ত থাকি। ‘নাটক নিয়ে ব্যস্ত?
কে যেন বলছিল—বউকেও নামিয়েছিস। এসব কী কাণ্ড বল তাে। নিজে যা করছিস তাই যথেষ্ট, তার উপর যদি....। আসিফ কিছু বলল না। হাই তুলল। রেহানা বললেন, ‘নাটক নাটক করে তাের লাভটা কী হয়েছে শুনি? এমন তাে না যে দশটা লােক তােকে চেনে। তাের তাে কিছুই হয় নি।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘তা ঠিক।
‘এই জীবনে কোথাও স্থির হতে পারলি না। আজ এই চাকরি, কাল ঐ চাকরি। তাের বয়স হচ্ছে না?
‘বয়স হলে মানুষের একটা সিকিউরিটির দরকার হয়। একটা বাড়ি। কিছু টাকা পয়সা.... তাের আছে কি?
‘এইসব বাদ দাও।
‘বাদ দাও বললেই বাদ দেয়া যায়? এই যে পুতুলের অপারেশন হল—বার তের হাজার টাকা খরচ হয়েছে। টাকা ছিল বলে খরচ করতে পেরেছি। যদি না থাকত? তাের এই রকম কিছু হলে তুই কী করবি?
কী আর করব? হাসপাতাল যাব। বিনা পয়সার চিকিৎসার চেষ্টা করব।
‘তুই হয়ত ভাবিস ভােকে নিয়ে আমরা চিন্তা–ভাবনা করি না। এটা ঠিক না। প্রায়ই আমাদের বােনদের মধ্যে আলােচনা হয়। খুবই কষ্ট লাগে।
‘কষ্ট লাগার কি আছে?
‘কষ্ট লাগার কিছু নেই? কী বলছিস তুই! একটা বাড়িতে থাকিস, সেই বাড়ির রান্নাঘর অন্য এক জনের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। এটা কেমন কথা?
‘সবার তাে সব কিছু হয় ।
‘চেষ্টা করলে ঠিকই হয়। চেষ্টা না করলে হবে কীভাবে? কোনাে রকম চেষ্টা নাই, বড় হবার ইচ্ছা নাই—নাটক, নাটক, নাটক।
এইসব বাদ দাও আপা, দেখি চা পাওয়া যায় কি না। মাথা ভার–ভার লাগছে। চা খেলে ভালাে লাগবে।‘
‘রাত দুপুরে চা পাবি কোথায়? চুপ করে বােস। তাের সঙ্গে দেখাই হয় না। সুযােগ পাওয়া গেল।
আসিফ সিগারেট ধরাল। তার সত্যি–সত্যি ঘুম পাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া দিয়েও ঘুম তাড়ান যাচ্ছে না। রাত জাগার জন্যেই বােধ হয় প্রচণ্ড খিদেও লাগছে। খালি পেটে সিগারেট নাভিতে পাক দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বমি হয়ে যাবে।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘আসিফ। “বল আপা। ‘তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল তাে।
বেশিরভাগ সময়ই আমি সত্যি কথা বলি। ‘তাের কি এখন চাকরি নেই?”
এই কথা বলছ কেন? “তুই তাের দুলাভাইকে বলেছিস তাের জন্যে একটা কিছু দেখে দিতে। এই থেকে অনুমান করছি। তাের কি চাকরি নেই?
‘না নেই।‘ ‘ক’দিন ধরে নেই? ‘মাস দুই। ‘তাের বউ জানে ? ‘জানবে না কেন? জানে।
‘তবু তুই নাটক কবি? এর পরেও তাের শিক্ষা হয় না? তুই কি মানুষ না জানােয়ার?
রেহানা উঠে চলে গেলেন। আসিফ একা একা বসে রইল।
বেশিক্ষণ একা বসে থাকতে হল না। রেহানা আবার এসে ঢুকলেন। তিনি খুব। কঠিন কিছু কথা বলতে এসেছিলেন বলতে পারলেন না। আসিফের বসে থাকার ভঙ্গিটি দেখে তাঁর খুব মায়া লাগল।
লীনা যে স্কুলে পড়ায় তার নাম—লিটল ফ্লাওয়ার্স। ইংরেজি স্কুল। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। নানান কায়দা কানুন। সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষা। মাসে একবার আউটিং।
আজ সেই আউটিংয়ের দিন। লীনাকে ক্লাস ওয়ানের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে হবে সাভার স্মৃতিসৌধে। একটা মাইক্রোবাস জোগাড় করা হয়েছে। লীনার সঙ্গে যাচ্ছে অতসী দি। গেম টিচার। মাইক্রোবাসে ওঠবার ঠিক আগ মুহূর্তে লীনা অতসীকে বলল,
‘আমার না শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি।
অতসী বলল, ‘যেতে চাও না? ‘না। শরীরটা খুবই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে ফেইন্ট হয়ে যাব। অতসী বলল, ‘তুমি কি কনসিভ করেছ নাকি?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
লীনা জবাব দিল না। এসব নিয়ে কথা বলতে ভালাে লাগে না অথচ বিবাহিত মেয়েরা কত স্বাভাবিক ভাবেই না এসব নিয়ে আলাপ করে। লীনার মাঝে–মাঝে মনে হয়—তার মধ্যে কিছুটা অস্বাভাবিকতা আছে।
‘তুমি এখন না গেলে বড় আপা খুব রাগ করবেন।
শরীরটা খুব খারাপ লাগছে অতসী দি। তােমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। দাঁড়াও, আপার সঙ্গে আলাপ করে আসি।
লীনা ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইল। বাচ্চাগুলাে মাইক্রোবাসে উঠে বসে আছে। কোনাে সাড়াশব্দ করছে না, যেন একদল রােবট। ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে এদের রােবট বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। হুকুম ছাড়া এরা মুখ খুলবে না। এর কোনাে মানে হয়। শিশুরা থাকবে শিশুদের মতাে। হৈ–চৈ করবে, মারামারি করবে, কাঁদবে, হাসবে।
অতসী ফিরে এসে বলল, ‘ব্যাপার সুবিধার না লীনা। বড় আপা খুব রেগে গেছে। তুমি যাও শুনে আস।
প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন সত্যি–সত্যি রেগেছেন। লীনাকে ঢুকতে দেখে তিনি শুকনাে গলায় বললেন, বােস।‘ বলেই টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘হ্যালাে, প্রিন্সিপ্যাল জোবেদা আমিন বলছি...‘
এইসব কেজি স্কুলগুলাের প্রধানরা বিচিত্র কারণে প্রিন্সিপ্যাল পদবী নেন। কেজি স্কুলগুলােতে কোনাে হেডমিসট্রেস নেই। সব প্রিন্সিপ্যাল। এরা কথা–বার্তায় সতুর ভাগ ইংরেজি বলেন। অদ্ভুত ধরনের ইংরেজি।
লীনা।‘ জি আপা। ‘আপনি এসব কী শুরু করেছেন বলুন তাে? ‘তেমন কিছু তাে শুরু করি নি আপা। শরীরটা ভালাে না, এটাই বলছি। ‘একটা এ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পূর্ণ হবার পর আপনারা বলবেল শরীর খারাপ, তাহলে কী করে হবে বলুন? আর এই শরীর খারাপ ব্যাপারটাও তাে নতুন না।
দুদিন পর–পর শুনছি শরীর খারাপ। এ ভাবে তাে আপনি মাস্টারি করতে পারবেন না। আপনি বরং অন্য কোনাে প্রফেসন খুঁজে বের করুন যেখানে তেমন কাজকর্ম নেই।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
লীনা উঠে দাঁড়াল। জোবেদা আমিন ঝাঁঝালাে গলায় বললেন, ‘যাচ্ছেন কোথায়? “বাসায় চলে যাব। শরীরটা ভালাে লাগছে না।” | জোবেদ আমিন কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। লীনার খুব ইচ্ছা করছে বলে, ‘আপনি কি আপা কখনাে লক্ষ করেছেন যে আপনার গোঁফ আছে? গায়ের রঙ কালাে বলে তেমন বােঝা যাচ্ছে না। ফর্সা হলে রােজ শেভ করতে হত।
কথাটা বলা হল না। লীনা বাসায় চলে এল। বাসায় এসেই শরীর খারাপ ভাবটা কেন জানি কেটে গেল। সে বেনুর সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করল। খুকিকে গামলায় পানি
নিয়ে গােসল করিয়ে দিল।
(চলবে)