দুপুরে দরজা জানালা বন্ধ করে খানিকক্ষণ ঘুমুল। ঘুম ভাঙার পর মনে হল আসিফ থাকলে বেশ হত। দুজন মিলে বিকেলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যেত। মিরপুর বােটানিক্যাল গার্ডেন কিংবা বলধা গার্ডেন।
আসিফকে আজকাল কাছেই পাওয়া যায় না। বেচারা চাকরির জন্যে ব্যস্ত হয়ে সারাদিন ঘােরে। কোথায় কোথায় ঘােরে, কার কাছে যায় কে জানে।
আজ অবশ্যি আসিফ চাকরির সন্ধানে ঘুরছিল না। সে চুপচাপ টেলিভিশন রিহার্সেল রুমে বসেছিল। শেষ পর্যন্ত ঋণপ্রার্থী লােকটির ক্ষুদ্র ভূমিকা নিতে সে রাজি হয়েছে। কৌতূহল থেকেই রাজি হয়েছে। দেখাই যাক না টিভি অভিনয় ব্যাপারটা কি? টেলিভিশন এখন অতি শক্তিশালী একটি মাধ্যম। একে উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না।
অভিনেতা–অভিনেত্রীরা সবাই এসে গেছেন। আসিফ এদের কাউকে চিনতে পারছে না। তার ঘরে টিভি নেই। টিভি তারকারা তার কাছে অপরিচিত |
প্রযােজক এলেন পাঁচটার দিকে। মধ্যবয়স্ক এক জন ভদ্রলােক। হাসি–খুশি ধরনের মানুষ। ঘরে ঢুকেই কি একটা রসিকতা করলেন। কেউ হাসল না। আসিফ কী করবে। বুঝতে পারল না। এই ভদ্রলােক এখন মনে হচ্ছে তাকে চিনতে পারছেন না। একবার চোখে চোখ পড়ল, তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
সবাইকে স্ক্রিপ্ট দিয়ে দেয়া হয়েছে। আসিফ কোনাে স্ক্রিপ্ট পেল না। ছােট রােলের আর্টিস্টদের হয়ত স্ক্রিপ্ট দেয়া হয় না। কিন্তু সংলাপগুলােতাে জানতে হবে। আসিফ উঠে দাঁড়াল; বেশ খানিকটা দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেল প্রযােজকের দিকে। প্রযােজক তাকে এইবার মনে হল চিনতে পারলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘ভেরি সরি। ভাই, একটা সমস্যা হয়েছে।‘
আসিফ বলল, ‘কি সমস্যা?
‘লাস্ট মােমেন্টে নাটকে কিছু কাট–ছাঁট করা হয়েছে। ষাট মিনিটের বেশি হয়ে যাচ্ছিল, কাজেই বাধ্য হয়ে—আপনি ভাই কিছু মনে করবেন না। নেক্সট নাটকে দেখব আপনাকে একটা রােল দেয়া যায় কি না। | আসিফের কান ঝা–ঝাঁ করছে। সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার চোখে মুখে সহানুভূতির ছায়া। আসিফ বলল, আমি তাহলে যাই?
প্রযােজক বললেন, বসুন না, চা খেয়ে যান। একটা রিডিং হবার পরই চা। আসবে।‘ আসিফ নিজের জায়গায় এসে বসল। এরকম একটা পরিস্থিতিতে চট করে চলে যাওয়া যেমন মুশকিল, আবার বসে থাকাও মুশকিল।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
রিহার্সেল শুরু হয়েছে। রিহার্সেলের ধরনটা অদ্ভুত। সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে রিডিং পড়ে যাচ্ছে। একেক জনের পড়া হয়ে যাওয়া মাত্র সে পাশের জনের সঙ্গে গল্প করছে। মনে হচ্ছে পুরাে নাটকটার ব্যাপারে কারাে কোনাে আগ্রহ নেই। নিজের অংশটা হয়ে গেলেই যেন দায়িত্ব শেষ।
একজন অভিনেতা পড়ার মাঝখানেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমিতাে ভাই আর থাকতে পারছি না। জরুরি এ্যাপয়েন্টমেন্ট। প্রযােজক তাঁকে রাখতে চেষ্টা করছেন। তিনি রাজি হচ্ছেন না।
আসিফ মনে মনে ভাবল—অতটা অনাগ্রহ নিয়ে এরা নাটক কেন করে? তার। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
বজলু ভাই রাগী গলায় বললেন, ‘এসব তুমি কী বলছ লীনা আসবে না মানে? এর মানেটা কি? আসিফ বলল, ‘লীনার শরীরটা ভালাে না। ক‘দিন ধরেই শরীর খারাপ যাচ্ছে।
কালই তাে দেখলাম ভালাে।‘ বাইরে থেকে ভালাে মনে হয়েছে। আসলে ভালাে না। ‘সবাই যদি এ রকম অসুখ–বিসুখ বাঁধিয়ে বসে থাকে তাহলে নাটক চলবে কী ভাবে ? নাটক–ফাটক বন্ধ করে চল বাসায় চলে যাই।‘
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘প্রক্সি দিয়ে কোনাে মতে চালিয়ে নিন।
প্রক্সি দিয়ে এইসব হয়? প্রত্যেকের তার নিজের রােল আছে, প্রক্সিটা দেবে কে? মুভমেন্ট সিনক্রোনাইজ করতে হবে না?
‘বজলু ভাই, আপনার সঙ্গে একটু আড়ালে কথা বলা দরকার। আসুন বাইরে যাই।‘
‘আমার সঙ্গে আবার আড়ালে কথা কি? ফিসফিসানি, গুজগুজানি এর মধ্যে আমি নেই। চল কোথায় যাবে।‘
দু’জন রাস্তায় চলে এল। বজলু সিগারেট ধরালেন। তাঁর প্রেসার আছে। অল্পতেই প্রেসার বেড়ে যায়। সামান্যতম টেনশান সহ্য করতে পারেন না। এখন তাঁর টেনশান খুব বেড়েছে। আসিফ কী বলবে কে জানে।
একটা সমস্যা হয়েছে বজলু ভাই।” “কী সমস্যা?
লীনা অভিনয় করতে পারবে বলে মনে হয় না। ‘কী বলছ তুমি এসব। ‘ওর শরীরটা খারাপ।
শরীর খারাপ, শরীর ঠিক হবে। চিরজীবন কারাের শরীর খারাপ থাকে? আজ রাতটা রেস্ট নিক। দরকার হলে আগামীকালও রেস্ট নেবে। আজ রিহার্সেলের পর আমি তােমার সঙ্গে গিয়ে দেখে আসব।‘
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘ওর বাচ্চা হবে বজলু ভাই। আপনি তাে ওর অবস্থাটা জানেন। এর আগে দুটো বাচ্চা মারা গেছে। জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই বাচ্চাগুলাে মরে যায়। ডাক্তাররা বলছে পুরাে রেস্টে থাকতে।
‘তুমি তাে ভয়াবহ খবর দিলে আসিফ। আমার তাে মনে হচ্ছে হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাচ্ছে। শশা পিছিয়ে দিতে হবে। এ তাে মাথায় বাড়ি।
‘শাে পেছানাের দরকার নেই। অন্য কাউকে এই রােলটা দিন। এটা তাে খুব কমপ্লিকেটেড রােল নয়। যে কেউ পারবে।
‘এটা কি সাপ লুডু খেলা যে, যে কেউ পারবে। ফালতু কথা আমার সঙ্গে বলবে না তো। যে কেউ পারবে। যে কেউ পারলে তাে কাজই হত।
‘ঐ দিন যে মেয়েটি এসেছিল—পুষ্প, ও পারবে, ওকে....
মাথাটা তােমার কি খারাপ হয়ে গেল নাকি? অভিনয়ের অ জানে না যে মেয়ে, গলা দিয়ে স্বর বের হয় না...।‘
‘আমি ওকে শিখিয়ে–পড়িয়ে ঠিক ঠাক করে দিতে পারব।‘
‘আমার কাছ থেকে একটা জিনিস শিখে রাখ—ছবি আঁকা, গান গাওয়া আর অভিনয়, এই তিন জিনিস শেখান যায় না—ভেতরে থাকতে হয়।‘
‘ঐ মেয়ের মধ্যে অভিনয় আছে। খুব সহজে মেয়েটা ইনভলভড় হতে পারে। অভিনয় দেখতে দেখতে মেয়েটা কাঁদছিল।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
‘অভিনয় দেখেই যে কেঁদে ফেলে, সে আবার অভিনয় করবে কি?
‘কে অভিনয় পারবে, কে পারবে না, এটা আমি বুঝি বজলু ভাই। লীনাকে আমি অভিনয়ে নিয়ে এসেছিলাম। লীনা কিন্তু আগে কোনােদিন করে নি।
মেয়েটা রাজি হবে কি না কে জানে। যেতে বলছ? ‘া বলছি।
‘এখনই চলে যাই মীনাকে সাথে নিয়ে যাই। ওই প্রথম দিন মেয়েটিকে এনেছিল। তুমি বরং থার্ড সিন শুরু করে দাও।‘
বজলু আরেকটা সিগারেট ধরালেন।
তাঁর টেনশান যেমন দ্রুত আসে তেমনি দ্রুতই চলে যায়। এখন টেনশান একেবারেই নেই।
‘আসিফ, শাে কি সময় মতাে যাবে? ‘অবশ্যই যাবে। ‘টেনশান ফিল করছি।” ‘টেনশানের কিছু নেই।
‘জাতীয় উৎসব, বড় বড় দল আসবে। কোলকাতা থেকেও নাকি দুটো টিম আসছে।‘
‘আসুক না।‘
‘তােমাকে সত্যি কথা বলি আসিফ, নাটকটা আমার কাছে বেশি সুবিধার মনে হচ্ছে না। কোনাে কনফ্লিকট নেই। রিলিফ নেই। ক্লাইমেক্স নেই।
‘জিনিস কিন্তু ভালাে।‘ ‘ভালাের তুমি কী দেখলে?
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন স্বপ্ন ব্যাপার আছে। কঠিন কিছু কথা খুব নরম করে বলা।
নরম করে বললে এই দেশে কিছু হয় না। শক্ত করে বলতে হয়। পাছায় লাথি দিতে হয়।
‘সবাই তাে পাছায় লাথি দেয়া নাটক নিয়ে যাবে। আমরা না হয় একটা নরম নাটক নিয়ে যাই। নরম হলেও এটা খুব নামকরা নাটক বজলু ভাই। কবি এমিলি। জোহানের কাব্যনাটক। বাংলায় ভাবানুবাদ করা। সত্যি করে বলুন তাে আপনার ভালাে লাগে না?
আর আমার ভালাে লাগা। তােমাকে আরেকটা সত্যি কথা বলি আসিফ, আজ পর্যন্ত কাউকে বলি নি। তােমাকে বলছি নাটক ভাললা না মন্দ এটা আমি বুঝি না। আমি শুধু বুঝি অভিনয় ঠিকমতাে হচ্ছে কি না।
‘আপনি সবই বােঝেন। শুধু বােঝেন বললে কম বলা হবে, খুব ভালােই বােঝেন। দেখুন বজলু ভাই, আমি মানুষটা খুব অহংকারী, আমি অভিনয় ভালাে করি। নিজে সেটা জানি অভিনয়ের ব্যাপারে আমি কারাের কোনাে উপদেশ শুনি না, কিন্তু আপনার কথা আমি শুনি। বজলু ভাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে, আপনি চলে যান।
সাজঘর হুমায়ূন আহমেদ
রিহার্সেল শুরু হতে খানিকটা দেরি হল। প্রণব বাবুর বড় মেয়ে বৃত্তি পেয়েছে, সেই উপলক্ষে তিনি প্রচুর খাবার–দাবার এনেছেন। হৈ–হৈ করে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। গ্রুপের মেয়েরা কেউ নেই—সবাই বজলু সাহেবের সঙ্গে পুষ্প মেয়েটির কাছে গেছে।
এই সুযােগে জলিল সাহেব আদিরসের দুটো গল্প বলে ফেললেন।
(চলবে)