সাতশ পাহাড়ের দেশে  (২)-রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

একটি মেয়ের আখ‍্যান -রজত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

সাতশ পাহাড়ের দেশে  (২)

 

রজত বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯০১২৪

 

সেদিন সকাল সকাল অফিসে গিয়েছিলাম। কাগজপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার কথা। গন্তব্য শ’দেড়েক কিলোমিটার দূরে, পাহাড় আর শালের ঘন জঙ্গলে ভরপুর, প্রায় চার হাজার ফিট ওপরে সারাণ্ডার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়চূড়ো, কিরিবুরু।

 

রাস্তা বলতে একে তো সিঙ্গল রোড, তাতে আবার পুরোটাই ভাঙাচোরা। আমরা অফিসের কলিগরা ভালোবেসে নাম দিয়েছিলাম হাম্পটি ডাম্পটি রোড। সেবারের ট‍্যুর একটু লম্বা। কিরিবুরুতে SAIL-এর আয়রন ওর্ মাইন্সে যাব। তারপর ওদেরই মেঘাহাতাবুরু মাইন্স এবং শেষে IISCO-র চিড়িয়া মাইন্স ঘুরে তিনচারদিন পরে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরব, জামশেদপুর। অন্তত, সেরকমই ঠিক করে বেরিয়েছিলাম। আমাদের হাম্পটি ডাম্পটি রোড টাটানগর ষ্টেশনের পাশ দিয়ে বেরিয়ে, সিংভুম জেলার জেলাসদর চাইবাসা হয়ে, ঝিঁকপানির এসিসি সিমেন্ট কারখানার গা ঘেঁষে, টাটানগর থেকে বড়াজামদা রেল রুটের লেভেলক্রসিঙদের সঙ্গে মোট সাতবার কাটাকুটি খেলতে খেলতে বড়াজামদা পৌঁছে দেবে। সেখান থেকে প্রথম বাঁদিকটা ছেড়ে দিয়ে আরও কিছুটা সোজা এগিয়ে দ্বিতীয় বাঁদিকের রাস্তা ধরবো। সেই রাস্তার শুরু থেকে আঠেরো কুড়ি কিলোমিটার কিরিবুরু পযর্ন্ত পুরোটাই বেশ খাড়া ঘাট সেকশন। রাস্তা ভালো হলেও খাদের দিকে তখন কোনো গার্ড-ওয়াল ছিল না, একেবারে ন‍্যাড়া। অন‍্যদিকটায় গা ঘষটানো খাড়া পাহাড়। সবচেয়ে মুস্কিল হতো ডাম্পার ট্রাকগুলোকে নিয়ে। ওগুলোর ড্রাইভাররা গাড়ির ব্রেক ব‍্যবহার করাটাকে বোধহয় পাপ হিসেবে গণ্য করতো। এইসব কারণে কিরিবুরুতে রাতে থাকার ব‍্যাপার থাকলে আমরা চেষ্টা করতাম সূর্য ডোবার আগে সেখানে পৌঁছে যেতে।

 

যেকোনো অফিসই বোধহয় বাঘের খাঁচার মতো। একবার ঢুকে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা কখনো নিজের হাতে থাকেনা। যথারীতি আমারও সেদিন বেরোতে বেরোতে দুপুর হয়ে গেছিল। কাজেই সেদিন আর কিরিবুরু পৌঁছনোর চেষ্টা না করে ঠিক করেছিলাম রাত্তিরটা বারবিলে কাটিয়ে পরেরদিন সকালে যাব কিরিবুরু, Hills of Elephants। ওখান থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার নেমে আরেকটা আড়াই হাজার ফিটের পাহাড় মেঘাহাতাবুরু, Hills of Cloudsয়েও কাজ ছিল।

 

জামদা থেকে প্রথম বাঁদিকের রাস্তা ধরে চার-পাঁচ কিলোমিটার গেলে উড়িষ্যার বরবিল। ওখানে গিয়ে উঠেছিলাম পি ডবল্যু ডি গেষ্টহাউসে। মেন রাস্তার ওপরে। কুক কাম্ কেয়ারটেকার ছিল সন্তোষ। আগে থেকে বুকিং টুকিং করতাম না বা করার সুযোগ হতো না। ঘর খালি থাকুক বা না থাকুক, দশ টাকা নিয়ে সন্তোষ ওখানে যেমন করে হোক থাকার একটা ব‍্যাবস্থা করে দিত। একবারতো এক বর্ষার রাতে, ঘর খালি ছিল না বলে, ডাইনিং রুমে সুন্দর শোয়ার ব‍্যাবস্থা করে দিয়েছিল। রাতের খাওয়া বরবিলের বিখ্যাত এবং একমাত্র খাবার জায়গা, সর্দারজীর হোটেলে। ঐ হোটেলে আমার বরাবরের ফিক্সড মেনু ছিল তন্দুরি রুটির সঙ্গে কিমা-কলিজি। স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে, যদিও হোটেলের নামটা বহুদিন হলো আর মনে পড়ে না।

 

মনের মধ‍্যে একটা খচখচে ভাব নিয়ে পরের দিন সকাল সকাল কিরিবুরুর জন‍্য রওনা দিলাম। একে তো প্রথমবার ঘাটের রাস্তায় গাড়ি চালাতে হবে, তারওপর ড্রাইভার হিসেবে তখনো আমার হাত অতটা পাকেনি। বারবিল থেকে পাঁচ কিলোমিটার মতো গিয়ে বড়াজামদা বা জামদা। জামদায় ঢোকার ঠিক আগেই বাঁদিকে কিরিবুরুর জন‍্য ওপরে চড়ার রাস্তা শুরু।

 

আগেরবার গুয়া যাওয়ার সময় বুঝেছিলাম শালের জঙ্গলে ঢাকা, নিশ্ছিদ্র পাহাড়ে মোড়া সারাণ্ডা নিজেকে মেলে ধরতে চাইলে কাউকে প্রস্তুতির সময় দেয় না; আচমকা সামনে এসে দাঁড়ায়। এবারও ঠিক তাই হলো। বাঁদিকে ঘুরতেই নিজেকে পেলাম একেবারে পাহাড়ের নীচে, জঙ্গলের মধ‍্যে। মনে আছে খুব সাবধানে, ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছিলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ‍্যে শালগাছেরা লম্বায় আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে একসময় আচমকা মিলিয়ে গেছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, চোখের সামনে হঠাৎকরে ভেসে উঠেছিল চারদিকে হাল্কা সাদাটে মেঘের পলেস্তারার ভেতর ঢেউ খেলিয়ে ঘুরে বেড়ানো শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দৃষ্টির শেষ সীমানা পযর্ন্ত শুধু সেই দৃশ্য। সাদা, সবুজ আর নীল রং মিলিয়ে তৈরি অজস্র সব নাম-না-জানা রঙের সে কী দিগন্তবিস্তৃত এক ক‍্যানভাস! একটানা কিছুক্ষণধরে তাকিয়ে দেখতে দেখতে, মনে আছে, সারা শরীর জুড়ে কিরকম এক বিচিত্র অনুভূতি গ্রাস করেছিল, অনেকটা নেশাগ্রস্তের আড়ষ্টতার মতন। এই বোধহয় ছিল সেই ব্রহ্মমুহূর্ত, যখন থেকে প্রকৃতির সঙ্গে আমার প্রেম গভীর হতে আরম্ভ করেছিল।

 

যাইহোক্, আড়ষ্টতা কাটিয়ে আমার সম্বিত ফিরেছিল ওপর থেকে একটার পর একটা লাইন দিয়ে নেমে আসা গোটা দশেক ডাম্পার ট্রাকের বিরক্তিমাখা একটানা হর্ণের আওয়াজে। টেনেটুনে দুটো গাড়ির চলাচলের মতো চওড়া হলেও রাস্তাটা বেশ খাড়াই। তার মধ‍্যে ওদের ব‍্যাস্ততাময় সকালে, ওপর থেকে নীচে নেমে আসার সময় আমি আমার নতুন প্রেমের স্বাদ নিতে নিতে গাড়ি নিয়ে উল্টোদিক থেকে টুকটুক্ টুকটুক্ করে উঠছি। এতে যে কারুর পক্ষে বিরক্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। ওরা, মানে ঐ অঞ্চলের ড্রাইভার, খালাসি ইত্যাদি, যারা সবাই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। সারাণ্ডা তো আর ওদের কাছে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে দেখার জিনিস নয়। ওরা জন্মায় সারাণ্ডায়, ওরা সৃষ্টি করে সারাণ্ডায়, ওরা মরে সারাণ্ডায়। সারাণ্ডার শাল, জঙ্গল, বৃষ্টি, পাহাড়, রোদ, রং, পশু, পাখি সবকিছু ওদের অঙ্গপ্রতঙ্গ, ওদের পরিবার, ওদের পরিজন। ওরাই সারাণ্ডা।

 

দশটা নাগাদ কিরিবুরু পৌঁছে গিয়েছিলাম। সারাদিন কেটে গিয়েছিল ওখানকার আর মেঘাহাতাবুরুর অফিসের কাজকর্মে আর পাঁচমিশেলি গল্পগুজবে। বিকেল চারটেয় অফিস ছুটি। SAIL-এর কিরিবুরু গেষ্টহাউসে আমার রাত্রিযাপন। পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় তৈরি, সোজাসুজি পশ্চিমমুখো এই গেষ্টহাউস। বিল্ডিংয়ের সামনে লাগোয়া গাঢ় সবুজ লন্। ইতস্তত কয়েকটি টেবিল আর কিছু গার্ডেন চেয়ার ছড়ানো। লনের একেবারে সামনের দিকে লোহার রেলিংয়ে ঘেরা শক্তপোক্ত বাউণ্ডারী। তার ঠিক পরেই রেলিংয়ের গা ঘেঁসে অতল খাদ। ঝুঁকে দেখতে গেলে মাথা ঝিমঝিম করে। শেষ বিকেলের পশ্চিমের সূর্য সারাদিনের কাজ শেষে সেদিনের মতো ডুবে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, দৃষ্টিসীমানার একেবারে শেষেরদিকের পাহাড়গুলোর চূড়ায় চূড়ায় পায়চারি করতে করতে।

 

চা দিতে বলে রুমে গিয়ে বসেছিলাম চায়ের অপেক্ষায়। বেশ খানিকটা পরে বেয়ারা এসেছিলো, খালি হাতে। চা লনে সার্ভ করে দিয়েছে বলে জানাল। চলে যাবার আগে কয়েক সেকেন্ডের জিজ্ঞাসাপূর্ণ একটা চাউনি দিয়ে, নিঃশব্দ আওয়াজে বলে গেছিল ‘আজব লোক তুমি! এত আলো আর রং দিয়ে কেয়ারি সাজানো এই বিকেলে ঘরের ভেতরে বসে কেউ চা খায়?’ গিয়ে বসেছিলাম লনের শেষপ্রান্তে রাখা একটা গার্ডেন চেয়ারে। সামনে টেবিলে রাখা ছিল টী-কোজী ঢাকা টী-পটে চা আর সঙ্গে কিছু নোনতা। সূর্য তার শেষ রশ্মিটুকু নিয়ে প্রায় ডুবেই গেছে। এই জায়গাটা থেকে শালগাছ দেখা যায় না। তারা থাকে অনেক নীচে। ইতিমধ্যে কাছের, দূরের সব পাহাড়গুলোয় কালচে রং ধরেছে। গোধূলীর সেই চিরপরিচিত বিষণ্ণ আলোয় সারাণ্ডা তার সমস্ত সৌন্দর্য্য নিয়ে তখন কিছুটা বিমর্ষ।

 

পরের দিন কাকভোরে উঠে লনে গিয়ে আগের বিকেলের চেয়ারে বসেছিলাম। লোভ ছিল সারাণ্ডার নিদ্রাভঙ্গ দেখার। দেখেওছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে দেখেছিলাম কি অদ্ভুতভাবে, প্রায় অন্ধকারে, ধীরে ধীরে প্রথমে পাহাড়গুলোর রূপরেখা ভেসে ওঠে। তারপর সময় এগনোর সাথে সাথে তাল মিলিয়ে আস্তে আস্তে তাদের শরীরে রংয়ের ছায়া পড়তে শুরু করে। সেইসব ছায়া আবার খুব তাড়াতাড়িতে একটার পর একটা রং পাল্টায়। শেষে পুরো ক্যানভাস সূর্যের আলোয় আর তার রংয়ে ভরে যায়। অদ্ভুৎরকম স্নিগ্ধ এক ক্যানভাস। পাহাড়দের ঘুম ভাঙ্গা সেই আমার প্রথম দেখা।

 

ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিয়েছিলাম চিড়িয়ার উদ্দ্যেশে। সারাণ্ডার সে এক অন্য সন্তান।

 

গুয়া থেকে আরও অনেক অনেক গভীরে, মোটামুটি চল্লিশ কিলোমিটার মতো আরও ভেতরে গিয়ে চিড়িয়া। ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ লৌহ খনিজের ভাণ্ডার। অত গভীরে এলাকা বলে জঙ্গল ভীষণরকম ঘন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী অতি সামান্য সংখ্যক নজরে না পরা কিছু আদিবাসী, অসংখ্য, অসংখ্য হাতি, বুনোশূয়োর, বনমুরগী আর অজস্র রকমের পাখি। শোনা যায় এত পাখি থেকেই জায়গার নামকরণ হয়েছিল চিড়িয়া।

 

প্রায় তিনহাজার ফিটের কাছাকাছি উচ্চতার পাশাপাশি দুটি পাহাড়- বুধাবুরু এবং বায়চিংড়িবুরুর মধ‍্যিখানের উপত‍্যকায় চিড়িয়া। একটুখানি দূরে কয়রা নদী আর গা ঘেঁষে বয়ে গেছে হামসদাগর নালা। বাইরের পৃথিবীতে যাওয়া আসার দুটি রাস্তা। তিরিশ কিলোমিটার মতো দূরে, সাউথ ইষ্টার্ণ রেলের চক্রধরপুর আর রাউরকেল্লা ষ্টেশনের মাঝামাঝি মনোহরপুর ষ্টেশন। অন‍্য রাস্তা নিয়ে যায় প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে গুয়া। সত‍্যি কথা বলতে গেলে ‘রাস্তা’ সেরকম কিছু ছিল না বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না।

 

আমি কিরিবুরু থেকে চিড়িয়া গিয়েছিলাম গুয়া হয়ে। গুয়া পৌঁছে ওখানকার পারচেজ ম‍্যানেজার, আমাদের বন্ধু রামালিঙ্গমের সাথে দেখা করে জানতে পারলাম এদিক দিয়ে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে চিড়িয়া যাওয়ার পারমিশন নেই। তবে অন্যভাবে যাবার দুটো উপায় আছে। এক, ইস্কোর জিপে করে, নাহলে গুডস্ ট্রেণের ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে। ঐ ট্রেণগুলো চিড়িযা থেকে গুয়া পযর্ন্ত আয়রণ ওর্ বয়ে আনতে সারাদিনে দু থেকে তিনবার আসাযাওয়া করে। সময় কম লাগে বলে

ইস্কোর স্টাফদের ঐ ব্যবস্থাটাই বেশি পছন্দের ছিল। জঙ্গলে একটু বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পাওয়া যাবে বলে আমার ইচ্ছে ছিল জিপ নিয়ে যাওয়ার। নতুন প্রেমে রামা ইন্ধন জুগিয়েছিল, একদিনের জন্য নয়, পুরো দুদিনের জন্য। ও জিপের ব‍্যাবস্থা করে দিতেই আমরা রওনা দিয়েছিলাম। সারথী ছিল বছর পঞ্চাশের শংকর টোপনো। খুব আগ্রহ নিয়ে ফিসফিস আওয়াজে আমাকে জঙ্গল চেনাচ্ছিল, জঙ্গলে ওর সব অদ্ভুৎ অভিজ্ঞতার গল্প বলছিল। সঙ্গের দ্বিতীয়জন কিন্তু একদম চুপচাপ। লক্ষ্য করছিলাম সে সারাক্ষণ ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে ঐরকম ঘন জঙ্গলের মধ্যে কিছু একটা যেন খুঁজে যাচ্ছে। আমার বিভ্রান্তি দুর করেছিল টোপনো। রাস্তা পুরোটাই ছিল নামে মাত্র রাস্তা, গাড়ি চালাতে চালাতে চালকের রাস্তা থেকে চোখ সরানোর উপায় ছিলনা। মৌন ব্যাক্তির কাজ চারদিকে নজর বুলিয়ে হাতি বা বুনোশূয়োর দেখতে পেলেই সঙ্গে সঙ্গে চালককে সাবধান করা। তারপর দুজনে মিলে পরিস্থিতি বুঝে ব্যাবস্থা নেওয়া। টোপনোর কাছেই জানতে পেরেছিলাম চিড়িয়ার রাস্তায় যেকোনো গাড়িতে ড্রাইভারের সঙ্গে আরেকজন না থাকলে ট্রিপের পারমিশন দেওয়া হয়না। ব‍্যাক্তিটির নাম ছিল, যতদুর মনে পড়ে  দিলীপ।

 

নিশ্ছিদ্র জঙ্গলের মধ‍্যে চারদিকে অজস্র পাখির বিভিন্ন স্বরের এবং বিভিন্ন সুরের ডাক আর টোপনোর ফিসফিস গল্পের মধ‍্যে একটু অন‍্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। গাড়ি হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতে সম্বিত ফিরল। পাখির আওয়াজ, টোপনোর ফিসফিস, সব চুপ, সারাণ্ডা চুপ। দিলীপকে দেখলাম বিড়ালের মত নিঃশব্দে নেমে জিপের সামনের দিকে গিয়ে রাস্তায় নীচু হয়ে কিছু একটা করতে। পেছনের সীটে বসে থাকার কারণে ও ওখানে ঠিক কি করছিল দেখতে বা বুঝতে পারিনি। আমাকে উসখুস করতে দেখে টোপনো ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করেছিল। তারপর দিলীপরা নিজেদের মধ‍্যে নিজেদের ভাষায় খুবই নীচু স্বরে কিছু কথাবার্তা বলে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে অল্পক্ষণের মধ‍্যে চিড়িয়া পৌঁছে দিল। ওখানে পৌঁছে দিলীপের গলার আওয়াজ প্রথমবার শুনেছিলাম। জানতে পারলাম রাস্তায় হাতির পটি দেখে গাড়ি দাঁড় করানো হয়েছিল।  দিলীপ নেমে গিয়ে হাতের একসঙ্গে চারটে আঙ্গুল দিয়ে পটি ছুঁয়ে সেটার টেম্পারেচার থেকে আন্দাজ করে নিয়েছিল হাতির দল খুব কাছে না হলেও খুব একটা দূরে তখন ছিল না। ওরা কাছাকাছির মধ‍্যে থাকলে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে গুয়া ফিরে যেতে হতো। তারপর অপেক্ষা করতে হতো খবরের জন‍্য কবে, কখন হস্তিযূথ অন্য জায়গায় চলে গেছে।

 

যথারীতি গেষ্টহাউসে উঠেছি। সামনে, পেছনে, আশে, পাশে তাকালে শালগাছ আর শালগাছ। গাছের কাণ্ডগুলো অনেকটা উঁচু পযর্ন্ত সব বুনো জঙ্গল দিয়ে মোড়া। দৃষ্টি একটু ওপরদিকে তুলে দেখেছিলাম একদিকে বুধাবুরু আর অন‍্যদিকে বায়চিংড়িবুরু দুদিক থেকে কিভাবে আগলে রেখেছে চিড়িয়াকে। সন্ধ‍্যের সময় লনে গিয়ে বসেছিলাম। সামান্য ঠাণ্ডার আমেজ। সামনে রাখা গরম সুগন্ধি চা আর সঙ্গে কিছু স্ন‍্যাক্স। খানিকটা দূরে, সামান্য নীচের দিক থেকে ভেসে আসছিল ঊনিশসো সাল নাগাদ সাহেবদের এখানে নিয়ে আসা ষ্টীম ইঞ্জিনের সাণ্টিং করার হাল্কা আওয়াজ; নিস্তব্ধ সন্ধ‍্যেয় পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হামসদাগর নালায় পাহাড়ি জলের কুলকুল শব্দ। আর, চোখের মণির মতো ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে জ্বলজ্বল করছিল আকাশভর্তি তারা; হাত বাড়ালেই হয়ত ছোঁয়া যেত। সেই সন্ধ‍্যেয়, শুধু সন্ধ‍্যেটুকুর জন‍্য হলেও, আমি ছিলাম ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন মষ্তিস্ক নিয়ে বসে থাকা, বোধশক্তিরহিত এক মুক্ত মানুষ।

 

*********

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *