সুন্দরবন সর্ম্পকে বিস্তারিত জেনে নিন
যে কোনো পর্যটক সুন্দরবনের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। বনের ভেতরে প্রবেশ করার পর চারদিকে দেখা যাবে সবুজ আর সবুজ। বিধাতা যেন অপরূপ সাজে সজ্জিত করে রেখেছে। কী অপরূপ সৃষ্টি, তা সুন্দরবন দেখলেই বোঝা যায়। এই সুন্দরবনে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বানর, শূকর, গুঁইসাপ, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ এবং নানা প্রজাতির পাখি রয়েছে।
এখানকার নদ-নদীতে লোনা পানির কুমির, হাঙ্গর, চিংড়িসহ ২১০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের চেয়ে সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছ, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল এবং ১৩ প্রজাতির অকির্ড আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে।
সুন্দরবন পর্যটকদের অন্যতম স্থান হিসেবে সরকার শত শত কোটি টাকা উপার্জন করতে সক্ষম। অথচ সুন্দরবন সংলগ্ন তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করে একে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। সুন্দরবনের এই বিশাল বৃক্ষরাজির জন্যই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ তাই চিন্তিত। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ সুন্দরবন ধ্বংস হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বিলীন হবে সুন্দরবনের অতীত ঐতিহ্য, জীববৈচিত্র্য ও সুন্দরবনের গাছগাছালি। ভূগর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় ব্যবহার চারপাশের জমির উপরিভাগে মরুময়তা সৃষ্টি করবে। নির্গত কার্বন মানুষের মধ্যে দুরারোগ্য ক্যান্সার সংক্রমণ ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কা অনেকের।
এখানকার প্রধান গাছ সুন্দরী ও বন্যপ্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে। বায়ুমন্ডলের সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন যৌগগুলো থেকে সৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাস বনের জন্য অতি মারাত্ক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাতে পারে। সন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে বিভিন্ন মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অথচ এই সুন্দরবনকে নিয়ে সরকারের নেই কোনো মাস্টারপ্ল্যান। পর্যটন শিল্প বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক খাত হলেও সরকার পরিকল্পনায় আনতে পারেনি।
সুন্দরবনকে বিশ্বের বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়।
একে অবশ্য উত্তম মৎস্য চারণক্ষেত্রও বলা হয়। এমনিতেই পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এখাকার নদী-খাল শুকিয়ে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। সুন্দরবনকে নানাভাবে বিষিযে তুলছে অসাধু গোষ্ঠী। উপরন্ত প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো বড় হুমকি। যেভাবে বন ধ্বংস হচ্ছে তাতে অচিরেই এলাকাগুলো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের বড় ধরনের শিকারে পরিণত হতে পারে। সে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ। বিপন্ন হবে জাতীয় অর্থনীতি। দেশের মোট আয়তনের ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশ।
সুন্দরবনের মোট আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার সমগ্র সুন্দরবনের (৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ) এবং জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গ কি.মি. সমগ্র সুন্দরবনের (৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ)। বনে সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া, বাইন, পশুর, কাঁকড়া, গরান, গোলপাতা, হেতাল, ঝানা, অমুর, সিংড়া, খলসীসহ বিভিন্ন ধরনের ঘাস জন্মে।
জানা যায়, ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্বাধিকার অর্জন করে। এলটি হজেয ১৮২৯ সালে সুন্দরবনে প্রথম জরিপ চালান। ১৮৭৬ সাল পূর্ব পর্যন্ত তৎকালীন জমিদারের অধীনে ছিল সুন্দরবন। ১৮৭৮ সালে সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সালে সুন্দরবনের দায়িত্ব বন বিভাগের হতে তুলে দেওয়া হয়।
সমগ্র সুন্দরবন চারটি ফরেস্ট রেঞ্জ এলাকায় বিভক্ত।
এগুলো হলো- খুলনা, সাতক্ষীরা, চাঁদপাই এবং শরণখোলা ফরেস্ট রেঞ্জ। সুন্দরবনে প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল আছে। এই নদী এবং খালগুলো সমগ্র সুন্দরবনে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। পশুর, শৌলা, শিবসা, ভদ্রা, যমুনা, রায়মঙ্গল, ভোলা, মরজাত, আড়ুয়া শিবসা, বল এখানকার প্রধান নদী। উল্লেখযোগ্য খালগুলো হলো : শাপলা, মরাভোলা, কটকা, বাদামতলা, মৃগামারি, করমজল, জোংড়া, হরিণটানা, মরাপশুর, নন্দবালা, ধানসাগর, নিশাজখালী প্রভৃতি।
খুলনা কিংবা মংলা থেকে নৌপথে সুন্দরবনের গহিন অরণ্যে প্রবেশ করা যায়। মংলার অদুরেই ঢাইনমারীতে রয়েছে বন বিভাগের কার্যালয়। সেখান থেকে সুন্দরবনে প্রবেশের আনুষাঙ্গিকতা সারতে হয়। পর্যটকদের জনপ্রতি ৫০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৭০০ টাকা এবং ছোট ও বড় লঞ্চের জন্য আলাদা ফি দিতে হয়। পর্যটকদের সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা থাকলে অতিরিক্ত একশ’ টাকা বন বিভাগকে দিতে হয়। প্যাকেজ ট্যুরে গেলে এসব ঝামেলা পর্যটকদের পোহাতে হয় না। ট্যুরিজম লিমিটেডের লোকজনই আনুষাঙ্গিকতা সেরে নেয়। ট্যুরিজম কর্তৃপক্ষকে শুধু নির্ধারিত তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধ করলেই তিন রাত দু’দিন সুন্দরবনে ভ্রমণ ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে তারা। আর সরকারিভাবে যেতে চিইলে আছে কটকা ও কচিখালী গেস্ট হাউস। কটকার রেস্ট হাউসে ৮ জনের বেশি থাকা যায় না । কচিখালী গেস্ট হাউসে থাকা যায় ৬ জন। এসব রেস্ট হাউসের ভাড়া ৩ হাজার টাকা করে (কম-বেশি হতে পারে)। গেস্ট হাউস দেখাশোনার জন্য একজন বনকর্মী রয়েছেন। এসব গেস্ট হাউস ভাড়া নিতে হয় বাগেরহাটের ডিএফওর কাছ থেকে।