গত শতকের মোটামুটি ছ’য়ের দশক পযর্ন্ত্য মধ্যবিত্ত পরিবারের হাতে একটু পয়সাকড়ি জমলে তারা এখনকার মতো ব্যাঙ্কে FD কিনতে দৌড়ত না। এরা সাধারণত একজন রাজমিস্ত্রী ধরে এনে একটা বাড়তি ঘর বানিয়ে নিত অথবা টালির ছাদটা পাল্টে চূণ-সুড়কির ঢালাই ছাদ করিয়ে নিত; কিছু না হোক অন্তত পুকুরঘাটটা বাঁধিয়ে নিত; ইত্যাদি ইত্যাদি। যাদের হাতে বেশ অনেকটা পয়সা জমত, তাদের বেশিরভাগই কিছুটা জমিজমা কিনে নিত।
তা সেইরকম এক মানুষ ছিলেন আমার প্রমাতামহ, আমার দাদামশায়ের বাবা। পেশায় ছিলেন স্বনামধন্য উকিল। অতএব পসার ভালোই। হাতে বেশি জমলে মাইল পঞ্চাশেক ব্যাসার্দ্ধের মধ্যে ধান-জমি কিনতেন; আর কম জমলে বাড়িতে একটা করে ঘর বাড়াতেন। প্রথমটাতে সমস্যা ছিল না, দ্বিতীয়টাতে ছিল। সেটা হল বাড়ির প্লটের আকৃতি। সামনেটা বড়জোর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ ফিট মতো, আর গভীরতায় ছ’শ ফিটের ওপর। গিন্নিমায়ের আলো হাওয়ার সখ রাখতে সামনের এক-তৃতীয়াংশে ঘরদোর আর বাকি অংশটুকু, যদিও বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই, তবুও একেবারে খোলামেলা। একতলায় উঠোন, ওপরের দুটো তলাতেই খোলা ছাদ। এসবের পরে বাকি জমিতে ছিল প্রায় দিঘি সাইজের একটা পুকুর। বাড়িটা ছিল তিনতলা। উচ্চতায় এখনকার প্রায় পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সমান। একতলায় রান্নাঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘর, পূজোর ঘর, আঁতুড় ঘর, কাজের লোকের ঘর, অফিস ঘর, উঠোন, কুঁয়োতলা, কয়লা রাখার জায়গা, ভাঙা, অপ্রয়োজনীয়, পুরনো, ব্যবহারের অযোগ্য জিনিসপত্র রাখার দরজাহীন খোলা গুদামঘর, ধানের তিনটে গোলা এবং একদম শেষ প্রান্তে এক কোনায় ‘প’এর জায়গা। দোতলায় তিনটে ঘর, টানা বারান্দা আর খোলা ছাদ, তিনতলায় দুটো ঘর আর খোলা ছাদ। তখনকার তৈরী অধিকাংশ বাড়িগুলোতে দুটো জিনিসের প্রাধান্য বা গুরুত্ব কম থাকত। প্রথমটা ছিল সিঁড়ি। দ্বিতীয়টি তার চেয়েও কম গুরুত্বের – স্নানের ঘর। তৃতীয়ও একটা ছিল, ঐ যে বললাম যেটা ‘প’ দিয়ে শুরু, সেটার কথা যত কম বলা যায় ততোই ভালো। এই বাড়িতেই আমাদের বড় হয়ে ওঠার বছরগুলো কেটেছে।
অত কম জায়গায় তিনতলা পর্যন্ত ওঠার ব্যবস্থা করতে সিঁড়ির ধাপগুলো এতো উঁচু করতে হয়েছিল যে কখনো সখনো গুলিয়ে যেত সিঁড়ি দিয়ে নামা-ওঠা করছি না কি কারুর বাড়ির পাঁচিল টপকাচ্ছি। এছাড়াও সিঁড়িতে উঠতে-নামতে আচমকা দু-একটা করে নব্বই ডিগ্রির ব্লাইণ্ড টার্ণও ছিল। ঐ টার্ণগুলো গ্রীষ্মের নিঃঝুম দুপুরে একটু গা ছমছম ব্যপার ছিল; আর সারা বছর সন্ধ্যের পর রীতিমতো গলা শুকিয়ে যাবার। খুব ছোটবেলায় আমরা যখন সেই বাড়িতে বড়ো হয়ে ওঠার জন্য গিয়ে উঠি, আমাদের ভাইবোনদের সেই বাড়ির প্রকাণ্ডতা, সিঁড়িতে আচমকা সব নিঃশ্বাস ভারী করে দেওয়া ডাঁয়ে বাঁয়ে টার্ণ’, বিশাল বিশাল উঁচু সব সিলিং, অত দূরে ‘প’য়ের জায়গা, সন্ধ্যে থেকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার কালো বিস্তীর্ণ খোলা ছাদ, গোটা একতলা জুড়ে বিকেল থেকে শুরু হয়ে যাওয়া একটা ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস পড়া থমথমে ভাব – এইসবের সঙ্গে ধাতস্থ হতে অনেক অনেক সময় লেগেছিল। ভোজবাড়ীতে শেষ পাতে পানের মতন এই বাড়িতে ছাদের একেবারে শেষ দিকটা, যেখানটা সূর্য ডোবার পর আর দেখা যেত না, সেখানটা ঢেকে রাখত পুকুড়পার থেকে উঠে আসা অস্বস্তিকররকম বিশাল আকৃতির এবং ছত্রাকার হয়ে বেড়ে ওঠা এক নিম গাছ। অস্বস্তিকর পরিবেশ কয়েক গুণ বেড়ে যেত সন্ধ্যের পর। লোডশেডিংয়ের বদান্যতায় কেরোসিন লণ্ঠনের আলোর রমরমা ছিল। আর কেরোসিনের আলো মানেই আলো আঁধারির খেলা, লম্বা লম্বা কিম্ভুতকিমাকার ছায়া, নিজের ছায়াকেই নিজের সন্দেহ করা। সব মিলিয়ে সোনায় সোহাগা।
অবশ্য ধাতস্থ হতে আমাদের এতটা সময় লাগার একমাত্র কারণ হিসেবে শুধু প্রমাতামহের স্থাপত্যজ্ঞানকে দায়ী করলে সেটা ঘোর অন্যায় হবে। সত্যিকারের কারণ ছিল যারা, তাদের নাকি প্রায় কখনোই চোখে দেখা যেত না, তাদের কখনো ছায়া পড়ত না; কখনো সখনো শুধুমাত্র অনুভব করা যেত। এরা নাকি সেই বাড়ি তৈরি হওয়ার আগে থেকে সেই মাটির বাসিন্দা। কাউকে শুধু দোতলার সিঁড়ির একটা বিশেষ টার্ণেই কখনো সখনো দেখা যেত; তাও পুরো নয়, শুধুমাত্র তার বাঁহাতটা। তাই তার আনুমানিক বয়েস বা লিঙ্গের সম্বন্ধে কোনো সম্যক ধারণা করা সম্ভব ছিল না। একটু বয়স্ক, ধুতি আর বুশশার্ট পরা একজন মুণ্ডহীন লোককে মাঝেমধ্যে দোতলার ভেতরের বারান্দায় রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে পায়চারি করতে দেখা যেত। আবার শেষ রাত আর ভোরের মধ্যে যে সময়টাতে দড়ি টানাটানি হয়, ঠিক ঐ সময়টাতে কারুর চটির দোতলা থেকে একতলায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার ফটফট আওয়াজ অনেকেই প্রায় দিন শুনতে পেত। ঝিরঝিরে বৃষ্টিওয়ালা, হাড়-দোমড়ান শীতের মাঝরাতে, কুঁয়ো থেকে জল তোলা এবং তার ঠিক পরে পরেই হড়হড় করে মাথায় জল ঢেলে স্নান করার আওয়াজ দোতলা বা তিনতলায় মশারির ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা যেত। পাথরের দেশে জষ্ঠিমাসের গরমে কেউ রাত্তির বেলা ছাদে শুতে চাইতো না। কারণ ‘তারা’ ঐসময়টাতে সারারাত ধরে বাড়ির লাগোয়া পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরত। জাল ফেলার আওয়াজে ঘুমনো নাকি মুস্কিল হতো।
তিনতলার দুটো ঘরের মধ্যে একটা ঘর ছিল বাড়ির নববিবাহিতদের জন্য অথবা VIP আত্মীয়দের জন্য রিজার্ভ। ঐ ক্যাটিগরির মধ্যের কেউ না থাকলে তখন বাড়ির অন্যরা সেটা ব্যবহার করতো, টেম্পোরারি ব্যবস্থায়। তবে অন্যরা পারতপক্ষে এমনিতেই তিনতলার ঘরে যেতে চাইতো না, প্রধানত তিনটে কারণে। প্রথমত, সিঁড়ি ভাঙা আর পাহাড়ের ওঠার ফারাক বোঝা যেত না। দ্বিতীয়ত, ঐ ঘরের খাটের তলায় লোহার তৈরী একটা ছোট্ট মোড়ার ওপর প্রমাতামহের জীবদ্দশায় ব্যবহৃত এবং বিগত প্রায় তিরিশ পঁয়তিরিশ বছরের অব্যবহৃত, চকচকে কালো রংএর, চামড়ার তৈরী একজোড়া চটি রাখা থাকত। সেটি কিছুদিন পর পর পালিশ করানো হতো। খাটে উঠতে নামতে ওটার নজর এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না। বড়দের কনভিন্স করে চটিজোড়া ঐ ঘর থেকে সরাতে আমাদের প্রায় বছর দশ-বারো লেগেছিল। তৃতীয় কারণটি ছিল সবচেয়ে মারাত্মক; রাত্তিরে ঘরের লাইট জাললে রেড্ অক্সাইডে পালিশ করা মেঝেতে মাঝেমাঝে ছোট্ট বাচ্চার হেঁটে যাওয়া ভেজা পায়ের ছাপ দেখা যেত।
এরকম আরও অনেক ভিন্ন ভিন্ন রকমের ঘটনার কথা আমরা জেনেছিলাম। সবগুলো লিখতে গেলে সেটা জায়গা এবং সময় দুটোই জবরদখল করার সমান হবে।
সৌভাগ্যবশতঃ, ওপরে লেখা অথবা না-লেখা অভিজ্ঞতাগুলোর কোনোটারই কোনদিন আমরা ভাইবোনেরা প্রত্যক্ষদর্শী নই। সবগুলোই পরিবারের বড়দের কাছ থেকে শোনা, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী থেকেছেন।
সেই বাড়িটা আজ আর নেই। ‘তারা’ এখন কোথায় থাকে বা কোন পুকুরে রাত্তিরবেলা মাছ ধরে তাও জানা নেই। তবে এটা বলতেই হয় যে ‘তারা’, সে ‘তারা’ যারাই হয়ে থাকুক না কেন, ছোটদের প্রতি অত্যন্ত সহানভূতিশীল ছিল।