সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৪

 অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে আর সাড়াই পেলুম না। আমার ডাকাডাকিতে জয়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে? ব্যাপারটা বললে সে বলল, “ছেড়ে দাও। শুয়ে পড়াে গে।” কিন্তু আমি তাে ভুল শুনিনি। যাই হােক, দক্ষিণের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি, সবে শুক্লপক্ষের চস্টা উঠেছে, সেই ফিকে জ্যোৎস্নায় দেখলুম, দাদার ঘরের ও পাশের ব্যালকনির লাগােয়া ঘােরানাে লােহার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নেমে যাচ্ছে। ওদিকটায় গিয়ে চেঁচিয়ে বললুম “জয় নাকি?” লােকটা জবাব না দিয়ে জোরে নামতে থাকল। তারপর বাগানের দিকে দৌড়ে চলে গেল। তখন আচমকা মনে পড়ল, দাদার ম্যাস্টিক কুকুরটা এই ব্যালকনিতে বাঁধা থাকে। সে কেন চুপচাপ আছে? যাই হােক, সকালে দাদাকে ব্যাপারটা জিগাস করলে বলল, “কই! আমি তাে কিছু জানি না। ছপেগ হুইস্কি টেনে বেঘােরে ঘুমােচ্ছিলুম”…তাহলে দেখুন কর্নেল, ব্যাপারটা বড় রহস্যময় কি না।”

কর্নেল সমগ্র 

শুনতে শুনতে কর্নেল অভ্যাসমতাে পর্যায়ক্রমে টাক ও দাড়িতে হাত বুলােচ্ছিলেন এবং চোখদুটি ছিল বন্ধ। হঠাৎ উঠে ঝাপিয়ে পড়লেন ডানপাশে একটা রাকের মাথায় টবে রাখা একটা ফুল সিন্থেসিয়া লতার ওপর। তারপর 

কী একটা ধরে ফেললেন খপ করে। গর্জন করে ডাকলেন, “যষ্ঠা! অ্যাই হতচ্ছাড়া!” । 

বিজয় হকচকিয়ে গিয়েছিল কাণ্ড দেখে। চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। ষষ্ঠীর সাড়া পাওয়া গেল না। কর্নেল গজগজ করছিলেন, “তখনই আমার বােঝ উচিত ছিল, ব্যাটাছেলে একটা গণ্ডগােল বাধিয়েছে। এতে আঙুলে ছােপ দেখেও তলিয়ে ভাবিনি। আসলে আমার মন তখন বিজয়ের সঙ্গে আলাপের জন্য ব্যর্থ! হতভাগা বাঁদর! উক?”। 

বিজয় বলল, “কী হয়েছে কর্নেল ?” 

কর্নেল তার হাতে ধরা একটা প্রজাপতি দেখিয়ে বললেন, “ভাগ্যিস এসব প্রজাপতি জন্মান্ধ। আর ফুলের টবটা এখানে ছিল। নইলে দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে ঠিক জানালার খোজ পেত আর উড়ে চলে যেত। ষষ্ঠী নিশ্চয় কাচের খাচার ঢাকনা খুলেছিল। রােসস, দেখাচ্ছি মজা?”। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৪

বিজয় বলল, “কর্নেল। প্রজাপতিটা পালিয়ে গেলেও ক্ষতি ছিল না। কানাজোলে গঙ্গার ধারে টিলাপাহাড়ের ঝােপে অবিকল এইসব প্রজাপতি প্রচুর দেখেছি। তবে ওরা অন্ধ, তা জানি না।” 

কর্নেল কোনার দিকে সচ্ছিদ্র কাচের খাচায় প্রজাপতিটা ঢুকিয়ে রেখে এসে বললেন, “এই প্রজাপতি প্রকৃতির এক বিস্ময়। চোখ নামে কোনাে ইন্দ্রিয় এদের নেই। শুড় দিয়েই ঘ্রাণের সাহায্যে এরা উড়ে বেড়াতে পারে। কানাজোলে এসব প্রজাপতি সত্যিই কি তুমি দেখেছ?” | ‘মনে হচ্ছে। ডানার ওপরটা লাল, তলাটা কালাে আর হলুদ, শুড়গুলাে লম্বাটে–” 

কর্নেল হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, “তাহলে তােমার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব। তােমার দাদার রহস্যের চেয়ে প্রজাপতিগুলাের রহস্য আমার কাছে অনেক বেশি জোরালাে। তবে যাবার আগে যষ্ঠী হনুমানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে যাব।” 

এতক্ষণে ষষ্ঠী নেপথ্য থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মরার মতাে পড়ে আছে দেখে রেকজামিং করতে গিয়েছিলাম। আমার কী? এরপর কেউ মরে পড়ে থাকলে কিয়েও দেখব না। তখন যেন বলবেন না, কেন খবর দিসনি ? কেনই বা রেকজামিং করিসনি?—ই, তখন আর বলতে আসবেন না 

যেন।” | কর্নেল হাে হাে করে হেসে উঠলেন। “না, না। রেকজামিং করবি বৈকি। তবে ঢাকনা খুলবিনে। সাবধান!” 

বিজয় অবাক হয়ে বলল, “কর্নেল, রেকজামিং জিনিসটা কী? 

কর্নেল আরও হেসে বললেন, “বুঝলে না? ওটা আমার ষষ্ঠীর ইংলিশ। একজামিন—পরীক্ষা-ষষ্ঠীর এমন অজস্র ইংলিশ আছে।” 

॥ কানাে মুখােশ ॥ 

শিপ্রদাস মুখুয্যে রাজবাড়ির একতলায় ড্রয়িং রুম বা হলঘরের পাশের ঘরে 

নি। চিরকুমার বলেই তাকে সবাই জানেন। বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। কিন্তু এখনও শক্তসামর্থ মানুষ। স্বপাক খান। নিত্য প্রাতঃভ্রমণের অভ্যাস আছে। সালে বাইরে থেকে হাঁটাচলা করে এসে ঘরে ঢুকেছেন, এমন সময় জয়া এল। 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৪

জয়া বলল, “কাল রাত্তিরে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কাকাবাবু। কিন্তু ভীষণ মাথা ধরার জন্য চুপচাপ শুয়েছিলুম। রাগ করেননি তাে?” 

বিপ্রদাস একটু হেসে সস্নেহে বললেন, “তােমার ওপর রাগ কখনও যে নি, এমন কথা বলব না। তবে কাল রাত্তিরের জন্য রাগ করিনি। রঙ্গিয়া লেছিল, তােমার শরীর খারাপ।” 

জয়া আস্তে বলল, “কেন ডেকেছিলেন কাকাবাবু?” বিপ্রদাস গম্ভীর হয়ে জানালার বাইরে মিনিটখানেক তাকিয়ে থাকার পর ললেন, “তুমি কলকাতা থেকে একজন ডিটেকটিভ আনিয়েছ—” 

জয়া দ্রুত বলল, “ডিটেকটিভ! কে ডিটেকটিভ?” 

“সে কী! তুমি–তাহলে যে বিজয় বলল, তুমিই বলেছিলে ওকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ আনিয়ে শরদিন্দুর মৃত্যুর ব্যাপারটা তদন্ত করতে! তাই সে ওই 

দ্রলােককে নিয়ে এসেছে।” | জয়া অবাক হয়ে বলল, “ওই বুড়াে ভদ্রলােক বুঝি ডিটেকটিভ? ছােড়া আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলে সাম কর্নেল বলে। উনি নাকি রিটায়ার্ড মিলিটারি অফিসার। পাখিপ্রজাপতি এসব নিয়ে প্রচণ্ড হবি। কানাজোলে নাকি কানা প্রজাপতি আছে। তাই দেখতে এসেছেন। তবে কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি। প্রজাপতি কি কানা হয়?” 

কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৪

বিপ্রদাস হাসবার চেষ্টা করে বললেন, “কাল সন্ধ্যায় বিজয়ের সঙ্গে এসেছে দ্রলােক। সামান্য আলাপ হয়েছে। তখন ভেবেছিলুম বিজয়ের পরিচিত উনি। মাজোলে বেড়াতে এসেছেন ওর সঙ্গে। পরে বিজয় আমাকে চুপিচুপি বলল, আলােক বিখ্যাত ডিটেকটিভ। তােমারই তাগিদে শরদিন্দুর ব্যাপারটা—যাই হক, তুমি যখন কিছু জানাে না, তখন বুঝতে পারছি, শরদিন্দুর মৃত্যু সম্পর্কে বিয়ের মনে কোনাে সন্দেহ আছে।” 

“সন্দেহ তাে আমারও আছে।” জয়া শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল। “কিন্তু সেজন্য গােয়েন্দা ডাকার কথা আমি ভাবিনি। ছােড়দা কেন মিথ্যে বলল আপনাকে ? সত্যি কথাটা বলতে পারত। 

“হয়তাে আমি ওকে বকব ভেবে তােমার নাম করেছে।” “আমাকে বুঝি আপনি বকতে পারেন না?” বিপ্রদাস একটু হাসলেন, “পারি। কিন্তু বকলেও তো তুমি আমার কথা 

শুনাবে না। তাই বিজয় তােমার নাম করেছে। যাই হােক, এ নিয়ে আর মাথাব্যথা করে লাভ নেই। ছেড়ে দাও।” 

জয়া একটু চুপ করে থেকে বলল, “ব্যাপারটা টের পেলে বড়দা ভীষণ রাগ করবে। আমার ভয় হচ্ছে, বড়দা ওই ডিটেকটিভ ভদ্রলােককে না অপমান করে 

বসে।” 

Read more

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৫

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *