বিপ্রদাস গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যা—তাও ঠিক। আমার মতে, জয়কে কথাটা বােলাে না। আমিও বলব না। আর বিজয়কেও নিষেধ করে দেব। ওকে একবার পাঠিয়ে দাও তাে!”
“ছােড়দা কর্নেল ভদ্রলােককে নিয়ে বেরিয়ে গেছে ভােরে। এখনও ফেরেনি।” বিপ্রদাস স্বগতােক্তির ভঙ্গিতে বললেন, “কানাপ্রজাপতি দেখাতে।”
জয়া চলে আসছিল। বিপ্রদাস হঠাৎ ডাকলেন, “জয়া শােনাে !” জয়া ঘুরে দাঁড়াল। বিপ্রদাস একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমি দুদিনের জন্য একটু ভাগলপুর যাব। জরুরি দরকার। একটা জিনিস তােমার কাছে রেখে যেতে চাই। জিনিসটা খুব দামি। তুমি গােপনে লুকিয়ে রাখবে। কেমন?”
মাথাটা একটু দোলাল, বলল, “আপনি কখন যাবেন জয়া?”
“এখনই।” বলে বিপ্রদাস তার হাফহাতা পাঞ্জাবিটা তুলে কোটের কাছ থেকে একটা ছােট্ট কৌটো বের করে চাপা স্বরে বললেন, “এক্ষুনি লুকিয়ে ফেলাে। সাবধান!”
জয়ার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল। দম আটকানাে তার হাত একটু-একটু কাপছিল। সে ভেলভেটমাড়া শক্ত এবং ছােট্ট কৌটোটা ব্লাউসের ভেতর চালান করে দিল।
বিপ্রদাস আস্তে বললেন, “ঠিক আছে লুকিয়ে রাখােগে। সাবধান!” বলে বাস্তভাবে একটা সুটকেস গােছাতে থাকলেন। জয়া বেরিয়ে এল ৪ থেকে। অন্দরমহলের ভেতরকার প্রাঙ্গণে ইদারা থেকে জল তুলছিল রঙ্গিয়া। সে জয়াকে লক্ষ্য করছিল না। কলাবতী রান্নাশালে বৈজ ঠাকরের সঙ্গে কী নিয়ে তর্ক করছিল, তারাও লক্ষ্য করল না। রাজবাড়ি এই সকালে খুবই স্তব্ধ মনে হচ্ছিল। পায়রার বকবকম, কলাবতী-বৈজুর তর্ক, ইদারায় বালতির শব্দ সেই গভীর স্তব্ধতায় কোনাে আঁচড় কাটতেই পারছিল না।
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৫
দোতলায় গিয়ে জয়া বড়দা জয়ের ঘরের দিকে তাকাল। জয়ের ঘরের দরজা বন্ধ। জয়ের এখন ‘চিড়িয়াখানায় থাকার কথা। নিজের ঘরে ঢুকে জয়া নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করল। তারপর তার ইচ্ছে হল, কৌটোটা খুলে দেখে নেয় দামি জিনিসটা কী। কিন্তু লােভ সংবরণ করল অতি কষ্টে। সে ঠোট কামড়ে ভাবতে থাকল, এটা কোথায় লুকিয়ে রাখবে।
জয়া গণ্ডগােলে পড়েছিল। যেখানে রাখতে যায়, মনে হয়, সেখানটা তত
পদ নয়। আলমারির লকার, পুরনাে আমলের সিন্দুক, দেয়ালের গুপ্ত তাক, পালঙ্কের শিয়রের তলার বাকসাে,—কোনাে জায়গাই তার মনঃপূত হচ্ছিল না।
ঠিক সেই সময় দরজায় কেউ টোকা দিল। অমনি জয়া ঝটপট কৌটটা আবার ব্লাউসের ভেতর লুকিয়ে ফেলল ! রাত্রে হলে সে জিগােস না করে
জা খুলত না। কিন্তু এখন সকাল প্রায় নটা। তাছাড়া এভাবে তার দাদারাই জায় নক করে তাকে ডাকতে পারে, যদিও সেকথা জয়া সে-মুহূর্তে ভাবল না। সে বরং বিরক্ত হয়েছিল। কিছুটা খাপ্পাও হয়েছিল। সেই ঝােকেই দরজা
খুলে দিল।
দরজার ভারী পর্দা ফাক করতে গিয়ে জয়া বুকে ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এল। তাল সামলানাের মুহুর্তে সে লােকটাকে একপলক দেখে নিল। ছাইরঙা স্পাের্টিং ণের ওপর কালাে একটা কুৎসিত মুখােশ। ঘরের ভেতরটা আবছা বলে এক সেকেন্ডের জন্য এর বেশি কিছু দেখা সম্ভব হল না এবং পরের মুহুর্তে
ঝালাে অথচ মিঠে একটা গন্ধ টের পেল জয়া। তারপর অতল শূন্যতায় গুলিয়ে গেল সে।
॥ বােবা কাকাতুয়া ॥
গলার পাড় ধরে ছােট্ট টিলার ওপর রাজবাড়ির আউটহাউসে বা জয়ের চিড়িয়াখানার দিকে হেঁটে আসছিলেন কর্নেল আর বিজয়। ওদিকটায় রাজবাড়ির লাগানে ঢােকার ছােট্ট ফটকটা বহুকাল আগে বন্ধ রাখা হয়েছে। পাশে একখানে পাঁচিলের খানিকটা ধসে গেছে। বিজয় বলল, “দেখুন কর্নেল, এখানটা দিয়ে ঢুকতে পারবেন নাকি?”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৫
কর্নেল প্রকাণ্ড মানুষ। এখন তার প্রশস্ত টাক ঢেকে ধূসর টুপি। গলায় বাইনােকুলার আর ক্যামেরা ঝুলছে। পিঠে ছােট্ট কিটব্যাগ আটকানাে। হাতে ছড়ির মতাে দেখতে প্রজাপতি ধরা জালের হ্যান্ডেল। চোখে সানগ্লাস। বিজয়ের পর কাত হয়ে পাচিলের ফোকর গলে ভেতর ঢুকতেই ঘ্রাড় ঘ্রাউ করে উঠল কোথায় একটা কুকুর। বিজয় চাপা গলায় বলল, “সর্বনাশ! দাদার কুকুরটা ছাড়া আছে দেখছি।”
কর্নেল দেখলেন, ঝােপঝাড়ের ভেতর দিয়ে টিলার আউটহাউস থেকে শাদারঙের লম্বাটে একটা কুকুর নেমে আসছে। বিজয় জোরালাে শিস দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল, “জয় ! তােমার কুকুর সামলাও!”
কোনাে সাড়া এল না। বিজয় বলল, “থাক কর্নেল ! জয়ের চিড়িয়াখানায় পরে যাওয়া যাবে। চলুন, আমরা বাগানের ভেতর দিয়ে বাড়ি ফিরি।”
কর্নেল একটু হেসে পিঠের কিটব্যাগের চেন খুলে একটা টিউবের গড়নের শিশি বের করলেন। তারপর বললেন “এস বিজয়! তােমাকে একটা ম্যাজিক দেখাই।”
বিজয় ভয় পাওয়া গলায় বলল, “ওদিকে যাবেন না কর্নেল! সনি আমাকেও খাতির করে না। ও একটা সাংঘাতিক কুকুর।”
কর্নেল গ্রাহ্য না করে টিলায় উঠতে থাকলেন। টিলার গায়ে প্রচুর ঝােপঝাড়। কিন্তু তার মধ্যে অসংখ্য ঝােপ যে ফুল বা সৌন্দর্যের খাতিরে একসময় বাপ্পাদিত্য লাগিয়েছিলেন, তা বােঝা যায়। অযতে সেগুলাে এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। ভেতরে উকি মারছে এখনও কিছু ভাঙাচোরা ভাস্কর্যও। কোথাও-কোথাও নানাগড়নের পাথরও দেখা যাচ্ছে। কুকুরটা একলাফে সামনের একটা পাথরে এসে পৌছেছিল। তারপর কর্নেলের দিকে ঝুঁপিয়ে এল। বিজয় একটু তফাত থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “কর্নেল ! চলে আসুন! চলে আসুন!”
কর্নেল সমগ্র ২য় খণ্ড এর অংশ-৫
তারপর সে দেখল, কর্নেল সেই টিউব-শিশির ছিপি খুলে এগিয়ে গেলেন। অমনি একটা মিরাকল ঘটে গেল যেন। কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গেল এবং লেজ গুটিয়ে কুঁউ-কুঁউ শব্দ করতে করতে উধাও হয়ে গেল। কর্নেল হাসতে হাসতে ঘুরে ডাকলেন, “চলে এস বিজয়!”।
বিজয় দৌড়ে কাছে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “আশ্চর্য তাে!”
কনেল টিউব-শিশিটা পিঠের কিটব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন, “এই ওষুধটার নাম ফরমুলা সিনিক টোয়েন্টি-সংক্ষেপে ফরমুলা ২০। সিনিক কথাটা গ্রিক। সিনিক মানে কুকুর। যাই হােক, জয়ের প্রহরী সনিবাবাজি এরপর আমাকে দেখলেই লেজ গুটিয়ে লুকিয়ে পড়বে।”
“জিনিসটা কী?” “কিছু না। একরকম উৎকট দুর্গন্ধ। কুকুরের পক্ষে অসহ্য।”
চিড়িয়াখানার অংশটা এই ছােট্ট টিলার মাথায়। তারের জাল দিয়ে ঘেরা খানিকটা খােলা জায়গা। তার পেছনে ঘিরের একতলা বাড়ি। ওপরে করগেটশিট চাপাননা। কালাে হয়ে গেছে শিটগুলাে। মরচে ধারে ভেঙে গেছে।
সে-সব জায়গায় টুকরাে টিন বা খড় ওঁজে মেরামত করা হয়েছে।
বিজয়ের ডাক শুনে জয় কবে তার প্রিয় কাকাতুয়া বাজাকে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সনিকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। জয় সগর্বে বলল, “আসুন কর্নেলসায়েব! আমার জু দেখুন।”
Read more