কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। নাটকের নাম ‘পুরগাছা।
পরগাছার প্রতি আমার খেয়ালি প্রকৃতিবিদ বন্ধুর আসক্তিকে প্রায় পাগলামি বলা চলে। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিরল প্রজাতির পরগাছার খোঁজে দুর্গম বনজঙ্গল পাহাড়ে হন্যে হয়ে ঘােরা ওঁর স্বভাব। কিন্তু এক্ষেত্রে ওঁর সেই প্রিয় উদ্ভিদটি তাে নিছক একটি নাটকের নাম! নামটিই কি ওঁকে টেনেছিল?
প্রশ্নটি অবশ্য নাটক দেখে বেরিয়ে আসার পর তুলেছিলাম। তবে তার আগে নাটকটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বলা উচিত।
মঞ্চের মাঝখানে একটি ক্ষয়াখবুটে গাছ, যার অল্প কিছু বিবর্ণ পাতা বোঁটায় কে আছে মাত্র। গাছটার তলায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে একটা আধপাগলা লােক। সে মাঝে মাঝে বেসুরাে গলায় অদ্ভুত কী সব গান গায়। মঞ্চের ডানদিকে কয়েকটি কুঁড়েঘরের অংশ দেখে বােঝা যায় একটি ছােট্ট গ্রাম। গ্রামের লােকের ীবনের সঙ্গে গাছটার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।
কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -১
কাজকর্মের শেষে তারা গাছটার তলায় এসে ভিড় জমায়। আড্ডা দেয়। রসিকতা করে। আধপাগলা লােকটাকে নিয়েও তাদের হাসি-তামাশা চলে। | এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। হঠাৎ একদিন গ্রামের লােকের তুমুল কৌতুক মার হাসিতে অতিষ্ঠ সেই আধপাগলা বুড়াে চেরা গলায় ঘােষণা করে, ‘সাবধান! এ গাছই তােদের জীবন। এর একটি করে পাতা তােদের একেক জনের জীবনের মায়ু। একটি করে পাতা ঝরবে। তারা একজন করে মারা পড়বি।
অবিশ্বাসের হা হা হা হা অট্টহাসির মধ্যে দেখা যায় একটা পাতা খসে পড়ল এবং আচম্বিতে একটা লােক বুক চেপে ধরে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
এবার নাটকের গতি হয়ে উঠল জোরালাে। প্রথমে সন্দেহ এবং দ্বিধা, তারপর খে মুখে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড আতঙ্ক। আবার একটা পাতা খসে পড়ে। একটা মৃত্যু আসে। বিভীষিকার প্রতীক হতে থাকে জীর্ণ প্রাচীন সেই গাছ। একটার পর একটা লা ঝরে যায়। একের পর এক জীবনের পতন ঘটে। আধপাগল লােকটা বারবার
গলায় ঘােষণা করে, সাবধান ! সাবধান! রাগী যুবকরা কুড়ুল হাতে ছুটে আসে। আধপাগলা লােকটা বলে, ‘খবর্দার! টা কেটে ফেললে একসঙ্গে তােরা সবাই মারা পড়বি।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র
যুবতীরা ঘটে জল নিয়ে এস বলে, তাহলে আমরা একে বাঁচিয়ে তুলি। তারা গাছের গােড়ায় জল ঢালে। গাছটিকে ঘিরে তারা নেচেনেচে গান গায়। আধপাগলা লােকটা বলে, ‘ভুল! ভুল! তােদের জলে গাছটায় নতুন পাতা গজাবে, আর তােদের গর্ভে আসবে সন্তান। কিন্তু তারাও বাঁচবে না। পাতা ঝরবে। তারা মরবে। ‘তা হলে উপায়?
এবার নাটকের ক্লাইম্যাক্স। লােকটা আঙুল তুলে বলে, ‘ওই দ্যাখ সবাই। গাছের ডালে একটা বিষাক্ত পরগাছা গজিয়ে আছে। গাছের সব রস শুষে নিয়ে ডাগর হয়ে ফুল ফোটাচ্ছে। ওই পরগাছা ওপড়াতে হবে। তবেই তােরা বাঁচবি।
যাই হােক, আরও কয়েকটি মৃত্যু এবং প্রবল হাঙ্গামার পর পরগাছাটা ওপড়ানাে হলাে। হাততালির মধ্যে নাটকও শেষ হলাে। পাশের এক দর্শককে বলতে শুনলাম, ‘সর্বহারা শােষিতশ্রেণী এবং পরগাছারূপী শােষক শ্রেণীর সংগ্রাম হে কালীপদ! বুঝলে তাে? | কালীপদ কী বলল শুনতে পেলাম না। কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে ভিড় ঠেলে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। ওঁর মুখটা রীতিমতাে গম্ভীর।
অক্টোবর মাসের রাত সাড়ে আটটায় টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সবে। গাড়িতে উঠে কর্নেল চুরুট ধরালেন। স্টার্ট দিয়ে বললাম, বােগাস! একেবারে প্রচারধর্মী। তবে নাচগান অভিনয় দিয়ে জমিয়েছে বেশ।
কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘হুঁ, নাটক মানে তাে তাই। ‘কিন্তু আমার অবাক লাগছে। পরগাছা আপনার প্রিয়, তা জানি। তাই বলে পরগাছা নামের রদ্দি তত্ত্বে ঠাসা নাটক দেখতে আপনার এত উৎসাহ রহস্যময়।
কর্নেল তেমনই গম্ভীরমুখে বললেন, ‘রহস্যময় বলতেও পারাে। তবে বিষয়টি সত্যি সিরিয়াস।
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কর্নেল সমগ্র প্রথম খন্ড এর অংশ -১
অবাক হয়ে বললাম, তার মানে ?
নাটকটার অন্য একটা মাত্রা আছে। আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ‘ওই মাত্রাটা অত্যন্ত বাস্তব এবং সত্যি ভয়ঙ্কর। বিষাক্ত পরগাছা ! হ্যা, জয়ন্ত। কোনও কোনও পরগাছায় লাক্ষা জাতীয় কীটের জীবাণু থাকে। আমি দেখেছি, লাক্ষার লােভে ওই অর্কিড জাতীয় পরগাছা এনে বিশাল গাছের ডালে আটকে দেওয়া হয়। কালক্রমে গাছটা শুকিয়ে মারা পড়ে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমশ পাশের গাছগুলােতেও সেই বিষাক্ত অর্কিড ছড়িয়ে পড়ে।
কী ভাবে বলি। একটা অর্কিডের ফুলের রেণু থেকে প্রায় ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা বাতাসে ছড়িয়ে যায় গাছ থেকে গাছে এভাবে অর্কিড় ছড়ায়। তাে আমি দেখেছি, এক অসাধু লাক্ষা ব্যবসায়ী লাক্ষার লােভে একটা রাস্তার ধারে অসংখ্য গাছ ওই বিষাক্ত অর্কিডের সাহায্যে মেরে ফেলেছে। লাক্ষাটা তার লাভ। শুকনাে গাছগুলাে কাঠের ব্যবসায়ীর লাভ। তুমি যদি তােমার খবরের কাগজের কাজে কখনও মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে সড়ক ধরে কান্দি যাও, লক্ষ্য কোরাে সারবন্দি গাছের কঙ্কাল
Read More