–না দেখেছি তাে কি বানিয়ে বলছি ? গজপতি গম্ভীর মুখে বলেন। আমার বয়েস বারাে–তেরাে হবে। ক্লাস এইটে পড়ি। মাধুরীদির ছেলেপুলে ছিল না বলে আমাকে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন। খাটে শুয়ে পিট পিট করে তাকিয়ে ওইসব কাণ্ডকারখানা দেখতুম । বলতুমও কে দিদি, যাকে হজমি গুলি দিলে ? মাধুরীদি বলতেন, চুপ, চুপ। বলতে নেই।
ভবভূতি বলেন—সে বাড়িটা এখনও নিশ্চয় ?
–হু আছে। মাধুরীদি অবশ্য বেঁচে নেই। —বাড়িতে কে থাকে এখন?
এবার গজপতি বাঁকা হেসে বলেন—যাবে নাকি? বাড়িটা খালি “পড়ে আছে। হানাবাড়ি হয়ে গেছে। কতবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হল কাগজে। সস্তায় বেচে দিতে চেয়েছিল মাধুরীদির বড় জায়ের ছেলে ত্রিলােচন। সেই এখন বাড়ির মালিক। কিন্তু বাড়ির বদনাম শুনে সবাই পিছিয়ে যায়। তাই বাড়িটা তেমনি খালি পড়ে আছে।
ভবভূতি বলেন-বাড়িটা আমি কিনব ।
-বলো কী?
-হ্যা। কিছুদিন থেকে আমি নিরিবিলি জায়গায় একটা বাড়ি খুঁজছি। ইচ্ছে আছে, সেখানে একা থাকব এবং কিছু এক্সপেরিমেন্ট করব।
–কিসের এক্সপেরিমেন্ট, শুনি।
ভবভূতি ফের নিজস্ব বাঁকা হাসিটা হেসে বলেন—নিশ্চয় ভূত নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট নয়, কুকুর নিয়ে।
গজপতি প্রায় আকাশ থেকে পড়ার মতাে বলেন—কুকুর নিয়ে মানে?
তােমাকে বলিনি। কিছুদিন থেকে আমি কুকুর নিয়ে একটু – আধটু গবেষণা করছি। আমার গবেষণার বিষয় হচ্ছে, কুকুরের ভাষা। ওদের যে নিজস্ব ভাষা আছে, তাতে কোন ভুল নেই। সেই ভাষা আমার শেখা চাই-ই।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১১
গজপতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পর বলেন—তা হঠাৎ এই আজগুবি ব্যাপারটা তােমার মাথায় চাপল কেন শুনি?
ভবভূতি গম্ভীর মুখে বলেন-তুমি তাে সারাজীবন খালি আইনের প্রকাণ্ড কেতাব পড়েই কাটালে ! আদালত আর জজসায়েব ছাড়া কি বােঝও না। কৌতূহলী গজপতি বলেন—আহা, বুঝিয়ে বলাে না একটু।
বললেও বুঝবে কি? তুমি তাে ঋগ্বেদ পড়ােনি। সরমা “ছিলেন কুকুরদের মা। সরমার ছেলেমেয়েদের নাম তাই সারমেয়।
দেবতাধিপতি ইন্দ্র সরমাকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন | গজপতি বাধা দিয়ে বলেন—আহা হলােটা কী তাতে?
ভবভূতি চটেমটে বলেন—হলাে তােমার মাথা আর মুণ্ডু! সেযুগে কুকুররাই দূতের কাজ করত বুঝতে পারছ না? তাদের যদি ভাষা না থাকবে তাহলে তাদের দূত করা হল কেন? তা ছাড়া ঋগ্বেদের আরেক জায়গায় আছে, একদল কুকুর কোরাস গাইছে । ভাষা না থাকলে ফের গজপতি বাধা দিয়ে খিক খিক করে হেসে বলেন-হু, এখন আমাদের পাড়ায় রাতদুপুরে কুকুরেরা কোরাস গায়। বাপস! সে কী কোরাস।
ভবভূতির এবার গর্জনের পালা।-তুমি মূখ ! শাস্ত্রজ্ঞানহীন নিতান্ত ইয়ে। নইলে মহাভারতের মহাপ্রস্থান পর্বে স্বর্গপথে যুধিষ্ঠিরের পেছন পেছন কুকুর যাওয়ার কারণটাও তুমি বুঝতে ! বলাে তাে, কেন কুকুর পেছন পেছন যাচ্ছিল ?
কুকুর এখনও পেছন-পেছন যায়। সেদিন আমি কিলােটাক পাঁঠার মাংস কিনে আনছি, একটা কুকুর পিছু ধরেছিল। গজপতি হাসতে হাসতে বলেন, নিশ্চয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাঁঠার মাংস ছিল। স্বর্গে তাে জীবহত্যা নিষেধ। তাই মর্ত থেকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
ভবভূতির পক্ষে এটা অসহ। রেগেমেগে বেরিয়ে গেলেন ভক্ষুণি। গজপতির পরে হুশ হল। তখন বেরিয়ে গিয়ে আদুরে স্বরে ডাকেন—ভবী! ভব! ও ভবা !
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১১
কোথায় ভবভূতি ? তঁর মান্ধাতার আমলের খনখনে বিলিতী গাড়ির লেজের ডগাটুকু মােড়ে একবারের জন্যে দেখতে পেলেন গজপতি।
খুব রেগেছে। তা রাগুক। গজপতি মনে মনে বললেন। একটু পরে জল হয়ে যাবে । দুই বন্ধুর এমন রাগারাগি দৈনিক পাঁচসাতবার হয়। আবার মিল হতেও দেরি হয় না! তবে অন্যবারে রাগ পড়তে ভবভূতি যতটা সময় লাগে, এবার লেগেছিল তারও কম ।
এর এক নম্বর কারণ, গজপতির পিসতুতাে দিদির সেই হানাবাড়ি কেনার ইচ্ছে !
দু নম্বর কারণ, ভবভূতি ভূত বিশ্বাস করেন না। গজপতির কাছে প্রমাণ করতে চাইছিলেন, ভূত বলতে কি নেই। সুতরাং গজপতি মিথ্যক।
তিন নম্বর কারণ, ভবভূতির কুকুর নিয়ে নিরিবিলি গবেষণা। বাড়িটার মালিক ত্রিলােচন থাকে হাজারিবাগে। ভবভূতির তর সইছিল না। গজপতিকে বলে টেলিগ্রাম করিয়ে তাকে কলকাতায় আনালেন এবং রাতারাতি বাড়িটা কিনে ফেললেন ! সস্তায় কিনলেন, বলা যায়। ত্রিলােচন যা পেল, ভাই লাভ। ঘুঘুডাঙা রেল ইয়ার্ডের ওদিকে কোন ভদ্রলােক গিয়ে বাস করতে চাইবেন ? রেল ইয়ার্ডে হরদম ট্রেন মালগাড়ি আর ইঞ্জিনের বিকট বাজখাই চেঁচামেচি, তার ওপর ভূত ওরফে ব্ৰহ্মদৈত্যর গুজব।
তবে হ্যা, কারখানার জন্যে কেউ কিনতেও পারতেন। কিন্তু ত্রিলােচনের কাকিমা মাধুরীদেবী নাকি বলে গিয়েছিলেন-কলকারখানা হলে উনি অর্থাৎ ব্রহ্মদৈত্য মশায় রিফিউজি হয়ে যাবেন। খবরদার বাবা তিলু, এই কম্মটি কোরাে না। এতে পাপ তাে হবেই, তার ওপর উনি রেগে গিয়ে তােমাদের পিছনে লাগবেন।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১১
তিলু বা ত্রিলােচন গজপতির মতাে ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী। এছাড়া সে ছেলেপুলে নিয়ে ঘরসংসার করে। ব্রহ্মদৈত্য-মশাইয়ের চেহারার যা বর্ণনা শুনেছে সে, তাতে তার হাজারিবাগে ছােট্ট বাড়িটার ওপর তিনি গিয়ে একখানা পা রাখলেই পৌরাণিক গল্পের সেই তিনপেয়ে বামনাবতারের বলিরাজার মাথায় পা চাপানাের ব্যাপারটাই ঘটে যাবে। অর্থাৎ চিড়েচ্যাপটা যাকে বলে । . যাই হােক, বাড়ি তাে কিনে ফেললেন ভবভূতি। খুব পছন্দসই বাড়ি। কতকটা সেকালের কুঠিবাড়ির গড়ন। একতলা এবং উচু এ ছাদ।
সাত-আটটা পাশাপাশি ঘর আছে। তার সঙ্গেই স্নানঘর, রান্নাঘর ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। বাড়ির চারদিকে লম্বাচওড়া প্রচুর জায়গা। গাছপালা আছে। ঝোপঝাড় গজিয়ে জঙ্গল হয়ে আছে। চারদিকের পাঁচিল যথেষ্ট উচু। একদিকে মস্তো গেট, অন্যদিকে খিড়কির দরজা। গেটের সামনে খােয়াঢাকা অনেককালের অব্যবহৃত রাস্তা আছে একফালি। সেটা গিয়ে মিশেছে রেল ইয়ার্ডের কাছে চওড়া বড় রাস্তার সঙ্গে। সেইদিকে একটু এগােলে ঘুঘুডাঙা রেলস্টেশন।
বিশাল উঠোনের কোণায় পাচিল ঘেষে সেই প্রকাণ্ড বেলগাছটা দেখতে পেলেন ভবভূতি। আনন্দে নেচে উঠলেন।
Read More