সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৩

হঠাৎ চমকে উঠলেন। তাহলে কি ওটা খড়মের শব্দ? অর্থাৎ বেলগাছের ব্ৰহ্মদৈত্য ?

নিঝুম রাতের আতঙ্ক

তাহলে কি সত্যি ব্ৰহ্মদৈত্য বলে কিছু আছে ? এবং সেই ব্ৰহ্ম দৈত্যই কি কুকুরগুলােকে রাতে কিছু খাইয়ে বশ করে ফেলেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে ? অথচ সকালে যখন দুধ পাঁউরুটি খাওয়াতে গেলেন, তখন ওর শান্তভাবে ছিল। এর মানে কী? 

ভবভূতির মনে হল, নেহাত খাবার লােভে তখন জন্তুগুলো তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেনি। নেমকহারাম লােভী স্বার্থপর ! ভবভূতি যত ভাবলেন ব্যাপারটা, বিচলিত বােধ করলেন। ঠিক আছে, আজ রাতে তিনি জেগে থেকে পাহারা দেবেন। নরহরিকে সঙ্গে নেবেন। এ রহস্যের ফর্দাফাই না করলেই চলে না। 

নরহরিকে ডেকে সব খুলে বললে তার মুখ যেন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তাকে ওই বেলগাছের ব্যাপারটা এতদিন বলেননি। 

এটাকে যে হানাবাড়ি বলতাে লােকে, তাও জানে না সে। কেমন করে জানবে ? সে সেই বাঁকুড়ার লােক। ভবভূতির জামাই তাকে শ্বশুরের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। জামাই ওখানে রােডস দফতরের ইঞ্জিনিয়ার। শ্বশুরমশায়ের নানান উদ্ভট বাতিকের কথা জানেন তিনি। কেমন লােক পছন্দ হবে, তাও জানেন। ভবভূতির কোন কথায় না। করবে না এবং কোন ব্যাপারে অবাক হবে না—এমন লােক চাই।। সেদিক থেকে নরহরি উৎকৃষ্ট। সবেতেই মুণ্ডু কাত করে বলে—ইয়েস স্যার ।

 নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৩ 

কর্তাবাবুর কথার বিরুদ্ধে অন্য কথা বলার যাে নেই। সে মুখে সায় দিল। বরং জাক দেখিয়ে বলল—বেহ্মদত্যির টিকি আর টাক 

দুই-ই কেড়ে নেব স্যার। 

খুশি হয়ে ভবভূতি বললেন–একখানা মােটা লাঠি জোগাড় করে রাখাে। আর একটা বস্তায় পাটকেল রাখখা। টিকি আর টাক কাড়তে গিয়ে মামলায় পড়বে হে! গবু উকিল তাক করে বসে আছে ওদিকে। 

ওদিকে কুকরগুলো উপােস করছে। করুক। ভবভূতি রাতের খাওয়া শেষ করে নরহরিকে সঙ্গে নিয়ে চুপিচুপি ওপাশের দরজায় বের হলেন। জ্যোৎস্না রাত। সৰ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বেলগাছটার একটু তফাতে একটা জঙ্গল-হয়ে-যাওয়া জবাগাছের আড়ালে দুজনে ওঁৎ পেতে বসে রইলেন। সঙ্গে একটা বন্দুকও নিয়েছেন। লাঠি আর পাটকেলের বস্তাও আছে। 

বসে আছেন তাে আছেন। সব নিস্তব্ধ। চাদের আলােয় ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পশ্চিমের রেলইয়ার্ড থেকে রেলগাড়ির শব্দ কিংবা হুইসেল , শােনা যাচ্ছে। আবার সব চুপ। হেমন্তকাল। শিশিরে ঘাস গাছপালা ভিজে জবজব করছে। হাল্কা কয়াশা জমেছে গাছপালায়। কিছুক্ষণ পরে বেলগাছ থেকে একটা পেঁচা ডাকল– ক্রাও! ক্রাও ! ক্রাও! 

তারপর মনে হল বেলগাছটায় হঠাৎ ঘূর্ণি হাওয়া এসেছে শনশন করে ডালপালা নড়ছে। তারপরই ভবভূতি দেখতে পেলেন, ঠিক মগডালে কালাে প্রকাণ্ড একটা মানুষের মতাে কে উঠে দাড়াল এবং চাঁদের দিকে তাকিয়ে যেন হাই তুলে বার তিনেক বুড়াে আঙুল ও তর্জনীর সাহায্যে তুড়ি দিল।। 

তারপর হেড়ে এবং চাপা গলায় সেই মূর্তিটা বলে উঠল—হরি হে দীনবন্ধু। পার করাে হে ভবসিন্ধু ।”তারা! ব্ৰহ্মময়ী মা গো! জগদম্বা বলো মন হে ! জগদম্বা বলাে! 

নিজের চোখকানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না ভবভূতি। তাঁর পিছনে বসে নরহরি ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে চিমটি কেটে সাবধান করে দিলেন একবার। 

 নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৩ 

একটু পরে মূর্তিটা গাছের ডগা থেকে লাফ দিয়ে নামল। মাটি কেঁপে উঠল যেন। জ্যোৎস্নায় এলে স্পষ্ট দেখা গেল, তার পরনে কেঁাচা করে পা খাটো ধুতি, খালি গা, বুকে পৈতে রয়েছে। মাথার চুল ছােট করে কাটা। একটা প্রকাণ্ড টিকি আছে। 

হ্যা, খড়মের শব্দ হচ্ছে। খট খট খট খট! ভবভূতি দেখলেন সে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। শিউরে উঠলেন। কিন্তু তিনি এক সময়কার শিকারী মানুষ। এমনিভাবে বন্দুক হাতে কতবার গহন অরণ্যে বাঘের এলাকায় রাত কাটিয়েছেন। এ কিছু নতুন ব্যাপার নয় তাঁর কাছে। দেখা যাক। অবশ্য এবার বাঘ নয়, ব্ৰহ্মদৈত্য এই যা। 

ব্রহ্মদৈত্যকে কাছে থেকে ভাল করে দেখবেন বলে চুপচাপ বসে আছেন ভবভূতি। নরহরির সাড়া নেই। চোখ বুজে ফেলেছে। নাকি ভিরমি গেল, ভবভূতির ঘুরে দেখার সময় নেই। 

ব্ৰহ্মদৈত্য এসে ভবভূতির মাথার ওপর জবাগাছ থেকে টুপ করে একটা জবাফুল পেড়ে নিল। নিয়ে টিকিতে বোঁটাটা গিট দিয়ে বাঁধল। কী বোঁটকা গন্ধ। ভবভূতির অসহ্য লাগল। নাকে আঙুল ঢুকিয়ে দিলেন। আর এতক্ষণে দেখলেন, ব্ৰহ্মদৈত্যের হাতে একটা হাড়ি রয়েছে। তারপর দেখলেন ব্রহ্মদৈত্য তঁার কুকুরশলার দিকেই চলেছে। খড়মের শব্দ হচ্ছে খট খট খটাং হাঁড়িতে কী থাকতে পারে? তাছাড়া ঘরে ঢুকবেই-বা কী ভাবে? ভেবেই পেলেন না ভবভূতি। 

কুকুরশালার বাইরের দরজার কাছে গিয়ে ব্ৰহ্মদৈত্য হেঁড়ে গলায় ফের বলে উঠল—হরি হে দীনবন্ধু ! পার কর হে ভবসিন্ধু ।•••তারা। তারা। ব্ৰহ্মময়ী মা গাে••জগদম্বা বলাে মন হে, জগদম্বা বলো

তারপর যেন তিনবার তুড়ি দিল সে। অমনি অবাক কাণ্ড! দরজা খুলে গেলতখন ব্ৰহ্মদৈত্য হাড়িটা উচু করে ধরে যেই ঢুকতে যাচ্ছে, ভবভূতি আর সহ্য করতে পারলেন না। গর্জে উঠলেন— খবর্দার ! 

সঙ্গে সঙ্গে আকাশ মুখখা বন্দুক তুলে ছুড়লেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন—নরহরি ! ঢিল ছােড়লাঠি চার্জ করেএক হাতে ঢিল, অন্য হাতে লাঠি

 নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৩ 

 ঘুরে দেখেন, কোথায় নরহরি? কেউ নেই পিছনে। পাটকেলের বস্তা আর লাঠিটা পড়ে আছেরাগে ভবভূতি বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে এবং লাঠি ও বন্দুক বগলদাবা করে উঠে দাড়ালেন। 

ওই অবস্থায় দৌড়ে গিয়ে ফঁকায় দাড়ালেন। ওদিকে ব্ৰহ্মদৈত্য তখন দরজা থেকে কেটে পড়েছেখড়ম পায়ে দৌড়ে আবার বেল গাছটার দিকে তাকে যেতে দেখলেন ভবভূতি। 

একলাফে বেলগাছে উঠে পড়েছে ব্ৰহ্মদৈত্য। 

ভবভূতি বস্তা নামিয়ে গাছের দিকে পাটকেল ছুড়তে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে জাতে থাকলেন—গেট ডাউন! গেট ডাউন রাস্কেল! নেমে এস বলছি। 

বস্তার পাটকেল শেষ হয়ে আসছে, এমন সময় গাছ থেকে ব্ৰহ্মদৈত্য করুণ স্বরে বলে উঠল-ভবভবী! ভবুআর ঢিল ছুড়ােনা ভাই! মাইরি, মরে যাবভবভূতি চমকে উঠলেন। 

গলাটা এতক্ষণে চেনা মনে হচ্ছে। দৌড়ে গাছতলায় গিয়ে বললেনকে? কে তুমিআবার করুণ স্বরে জবাব এল-আমি, আমিউহুহুহু! গেছিরে বাবা। 

কে আমি ? নেমে এস বলছি! নৈলে এবার লাঠিপেটা করব! বলে ভবভূতি সেই ইয়া মােটা লাঠিটা বাগিয়ে ধরল ব্ৰহ্মদৈত্য কান্নার সুরে বলল—নামতে পারছি না। তােমার ঢিল লেগে হাটুর বাতটা হঠাৎ চাগিয়ে উঠেছে উহু হু হু !

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৪

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *