এতক্ষণে ভবভূতির সংশয় ঘুচল। লাঠি ও বন্দুক মাটিতে রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হহ হহা করে হেসে বললেন—রাস। হাত বাড়াও। ধরে নামাচ্ছি।
ব্ৰহ্মদৈত্য গুড়ির ওপরে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে দিল। ভবভূতি তার হাত ধরে সাবধানে নামতে সাহায্য করলেন। নেমেই ব্ৰহ্মদৈত্য হাঁটুর ব্যাথা ভুলে চেঁচিয়ে উঠল—এই সেরেছে। হাড়িটা পড়ে আছে যে! সর্বনাশ! নির্ঘাৎ ব্যাটা এতক্ষণ আদ্ধেক সাবাড় করেছে। বলে সে কুকুরশালার দরজার দিকে দৌড়ল। ভবভূতিও তার সঙ্গে দৌড়লেন।
গিয়ে দেখেন, ব্ৰহ্মদৈত্য নরহরির কঁাধ আঁকড়ে ধরেছেন, আর নরহরি হাঁড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। টানাটানিতে তাকে নড়ানাে যাচ্ছে না। ভবভূতি দেখেশুনে গম্ভীর হয়ে বললেন—রসগােল্লা নাকি ?
—হ্যা। পাকা তিন কিলাে মাল। ব্যাটা সব সাবাড় করে ফেললে দেখছ না ? এ যে আস্ত রাক্ষস।
-বেশ করেছে। ভবভূতি রেগে বললেন। ব্রহ্মদৈত্য বলল–ইয়ার্কি? ওর জন্যে এনেছিলুম নাকি ?
ভবভূতি গর্জে উঠলেন—তােমার নামে মামলা করব। তুমি আমার কুকুরগুলােকে রসগােল্লা খাইয়ে আমারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছ। সকাল হতে দাও। দেখাচ্ছি মজা। সটান ঘুঘুডাঙা আদালতে গিয়ে তােমার নামে মামলা করব। ব্ৰহ্মদৈত্য, হাসল। হু! আমাকে মামলার ভয় দেখাচ্ছ। আমি চল্লিশ বছর ওকালতি করেছি জানাে না বুঝি ?
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৪
হ্যা, তাও বটে। ভবভূতি ভড়কে গেলেন। বললেন—তাই বলে এই বুড়াে বয়সে কেলেঙ্কারি করতে তােমার লজ্জা হল না ? ছিঃ ।
–কিসের লজ্জা? ব্রহ্মদৈত্য অর্থাৎ সাক্ষাৎ স্বয়ং গজপতি বাঁকা হেসে বললেন। তুমি যে ব্ৰহ্মদৈত্য মানাে না! এবার মানলে
তাে ? | ভবভূতি পাল্টা বাঁকা হেসে বললেন—হুউ, মানলুম। তবে যাও, এখন চান করে গায়ের কালাে কালিগুলাে ধুয়ে এস। নৈলে তােমায় বিছানায় শুতে দেব ভেবেছ ? ছ্যা ছ্যা! | নরহরি ঠাকুর হাঁড়ি শেষ করে এতক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে বলল–– আসুন গাে। টিউবেল থেকে জল টিপে দিই। চান করবেন। আমারও তেষ্টা পেয়েছে।•••
এই ঘটনায় দুটো ফল হল। এক ঃ নরহরি গােপনে গজপতির চক্রান্তে যােগ দিয়েছিল এবং কুকুরশালার চাবিও চুরি করে ওকে দিয়েছিল বলে তার এখানকার চাকরি গেল। সে অবশ্য গজপতির বাড়ি ফের চাকরি পেল । তাই কথা ছিল গজপতির সঙ্গে।
দুই ও ভবভূতিকে কুকুরগুলাের জন্যে দৈনিক তিন কিলো করে রসগােল্লার ব্যবস্থা করতে হল। রসগােল্লার মজা ওরা পেয়ে গেছে। একদিন না পেলে ভবভূতির বিরুদ্ধে সেদিনের মতাে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখায়।
ভবভূতি নতুন লােক বহাল করেছেন। তার নাম কালীপদ।। ডাক নাম কালাে। বছর বিশ বাইশ বয়সের এক ছােকরা। ভারি। অমায়িক এবং বিশ্বাসী। তাকে কুকুরগুলো বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। এটা ভবভূতিরও বাড়তি লাভ বলা যায়।
” আর গজপতির সঙ্গে সম্পর্ক ? এবার চিড় খেয়েছে সত্যিসত্যি। গজপতির সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া হয়ে গেছে ভবভূতির। ব্ৰহ্মদৈত্য আছে তা প্রমাণের জন্যে যে এমন কাণ্ড করতে পারে, সে কি মানুষ? সে নিজেই ভূত। অতএব ভূতে–মানুষে কি বন্ধুত্ব হয়? কিংবা হয়ে গেলেও কি তা বেশিদিন টেকে?
ভবভূতি মন দিয়ে কুকুরের ভাষা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। গজপতিকে মন থেকে একেবারে মুছেই ফেলেন।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৪
কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ মনে হয়, আচ্ছা—বেলগাছে যদি গজ– পতির বদলে সে রাতে সত্যিসত্যি ব্ৰহ্মদৈত্যকেই দেখতে পেতেন, তাহলে কী ঘটত ? একটু শিরশির করে শরীর। বিশেষ করে কোন কোন রাতে লনে পায়চারি করতে–করতে বেলগাছটার দিকে তাকালে যেন মনে হয় কেউ ওর মধ্যে ঘাপটি পেতে বসে আছে। বাগে পেলেই ঘাড় মটকাবে। তখন ভবভূতি বন্দুকটা নিয়ে এসে খামােক আকাশে একটা গুলি ছােড়েন। সেই আওয়াজে ভয় পেয়ে বেলগাছের পেঁচাটা চাচাতে চাচাতে উড়ে পালায়।
ততদিনে কুকুরের ভাষা নিয়ে গবেষণায় অনেকটা এগিয়েছেন ভবভূতি। ইয়া মােটা লাল কাপড়ে বাঁধানাে খেরাের খাতায় কুকুরের ডাকগুলো টুকেছেন এবং তার পাশে বাংলা অনুবাদও করে ফেলেছেন।
এমন কি ওদের সঙ্গে ইদানীং ওদের ভাষাতেই কথা বলার চেষ্টা করছেন।
অ্যালসেশিয়ানের খাঁচার সামনে গিয়ে বলেন, গররর গঁ। অর্থাৎ কেমন আছ হে ?
সে জবাব দেয়—গঃ গরুর গাঃ। ভালই আছি। তবে খাঁচায়, আটকে থাকাটা ভাল মনে হচ্ছে না।
ভবভূতি একটু হেসে বলেন—গঃ ঘঃ। ঠিক আছে। শিগগির ছেড়ে দেব।
টেরিয়ার দুটো তাকে দেখে বলে—ঘেঃ ঘেঃ। ছেড়ে দাও না ব্রাদার।
ভবভূতি বললেন—ঘ। সবুর, সবুর। দেব বইকি।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৪
গ্রে হাউণ্ড ভারি রাগী। বলে-খা খা খা খুঃ! ছেড়ে দাও, নয়তো ভালাে হবে না বলে দিচ্ছি। যা ভবভূতি বলেন—চুঃ চুঃ ! সােনার ছেলে, লক্ষ্মীছেলে ? স্বাগ করে না।
দিশি কুকুর বাঘা, খেকি এবং নেড়ি তাকে দেখে চাচামেচি করে বলে-ভৌ ভৌ ভেউ ভু-উ-উ-উ। কেন আটকে রেখেছ ! আমাদের কষ্ট হচ্ছে না বুঝি ?
ভবভূতি জবাব দেন—ঘেউ ঘেউ ঘেক্ ঘেক্ থুঃ ? বেশি চেচিও তাে বাপু। সময় হলেই ছাড়ব।
নতুন রাঁধুনী-কাম-চাকর কালীপদ ব্যাপারস্যাপার দেখে হতভম্ব। আজকাল কর্তাবাবু আপন মনে ঘরের মধ্যে পায়চারি করেন আর কুকুরের মতাে ডাকেন। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না তাে?
সেদিন কালীপদ গেছে চা নিয়ে। বই পড়তে পড়তে বললেন গেঃ গঃ ! ঘেউ–উ–উ-উ !!
কালীপদ হতভম্ব হয়ে বলেন—কী বলছেন স্যার?
ভবভূতি একটু হেসে বললেন–তাইতো ! তুমি এ ভাষা জানােনা না বটে। শােন কালীপদ, আমি কুকুরের ভাষায় দিব্যি কথা বলতে পারি। একটা বই লিখব ভাবছি। ওটা পড়লে সবাই এ ভাষা শিখে নেবে। তা শােন তুমি বরং আমার কাছে রোজ এ ভাষাটা শিখতে থাকে। বেশি কথা খরচ করতে হবে না। একটুও ক্লান্ত হবে না কথা বলতে । কত সহজে একটা শব্দে অনেক বেশি কথা বলা যায় জানাে?
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৪
কালীপদ ছেলেটি ভারি সরল। বলল তাহলে আজই শেখাতে শুরু করুন স্যার।
ব্যস, ভবভূতি ওকে নিয়ে পড়লেন। রােজ দু ঘণ্টা করে মনােযােগী ছাত্রের মতাে সে কর্তাবাবুর কাছে বসে কুকুরের ভাষা শেখে। রান্না ঘরে গিয়ে আপন মনে অভ্যাস করে। জিভ তালুতে ঠেকিয়ে কিভাবে
কিভাবে ঘেউ করতে হয়, সহজেই রপ্ত করে নেয়। রান্নাঘর থেকে অনেক সময় তার সেই ঘেউ শোনা যায়। ভবভূতি তঁার ঘর থেকে সাড়া দিয়ে বলেন—ঘেউ ঘেউ ঘোঃ। বাঃ! বহুত আচ্ছা। ঠিক হচ্ছে।
কিছুদিন পরে দেখা গেল, দুজনে আর মানুষের ভাষায় কথা বলছেন না। স্রেফ কুকুরের ভাষায় কথা চলছে।
কারণ ভাষাশিক্ষার তাই নিয়ম ! যেমন কিনা ইংরাজি স্কুলে যারা পড়ে, তাদের সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয়। তাছাড়া সেই যে একটা কথা আছে—যদি ইংরেজি শিখতে চাও, তাহলে ইংরেজিতে কথা বলাে, ইংরেজিতে স্বপ্নও দেখ।’
কুকুরের ভাষায় আজকাল দুজনে স্বপ্ন দেখতেও চেষ্টা করেন বইকি ?
Read More