গজপতির দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই। বেরিয়ে গিয়ে রােদে দাড়িয়েছেন। সবে শীত পড়েছে। বেশ আরাম লাগে ।
হঠাৎ কানে এল, বেলগাছ থেকে কে সুর ধরে আওড়াচ্ছে । ‘গর, র, র, মানে এস এস
ভেউ মানে কে রে ? ঘেউ মানে খবৰ্কার যাব নাকি তেড়ে ? খাক মানে কামড়াব ভাক্ মানে যাঃ । অভি মানে পেটে ব্যথা কিছু খাব না…’
গজপতি পা টিপে টিপে এগােলেন! নিশ্চয়ই ভবভূতির কোন ছাত্র শান ভাষায় পড়া মুখস্থ করছে। পরীক্ষার সময় ছাত্ররানিরিবিলিতে এমনি করেই তাে মুখস্থ করে। গজপতি বেলতলায় গিয়ে মুখ তুলে দেখলেন, ঘনডাল ও পাতার আড়ালে কালাে কুচকুচে একটি বেঁটেখাটো টিকিওয়ালা মূর্তি আপন মনে বসে পড়াশুনো করছে। গজপতি বললেন-কে হে তুমি? গাছের ডালে বসে ও কী মুখস্থ করছ ?
মূর্তিটা পাতা সরিয়ে গজপতিকে দেখেই ফিক করে হাসল। তারপর হনুমানের মতাে সড় সড় করে নেমে এসে বলল-গজু না তুমি? সেই অ্যাউকুন দেখেছি-ওরে বাবা! কত বড়াে হয়েছ তুমি ? কত বুড়াে হয়েছে। সেই যে তােমার দিদি রাতের বেলা জানলায় দাড়িয়ে পান চিবুতে চিবুতে আমার সঙ্গে গল্পগুজব করত আর তুমি বিছানায় শুয়ে টুক টুক করে তাকিয়ে দেখতে। সে কি আজকের কথা? এস গজু, তােমায় আদর করি।
ওরে আমার গজু ছােনারে ! তােমার চুল কেন পাকল ? ওরে গজু রে ভজু রে !•••• | গজপতি ততক্ষণে গেটের কাছে। গেট বন্ধ ! তখন পাঁচিলে উঠে পড়লেন কোনরকমে। তারপর লাফ দিলেন। তারপর পড়ি-কী মরি করে দৌড়। একদৌড়ে ঘুঘুডাঙ্গা স্টেশনে। আর এ জীবনে ও বাড়িতে নয় বাপস! | ব্ৰহ্মদত্যি দুঃখিত মনে বেলগাছে উঠে আবার পড়ায় মন দিল।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৭
গজপতি আর সত্যিই আসেন না ঘুঘুডাঙায় ভবভূতির ‘সরমা ভবনে। ভবভূতি, ডাঃ হাউর আর কালীপদ, আর সতেরটা কুকুর, আর বেলগাছের •••ব্ৰহ্মদত্যিমশাই দিব্যি কাটাচ্ছে। কুকুরগুলো আজকাল মানুষের ভাষায় কথা বলতেও পারে নাকি! তােমরা কেউ ইচ্ছে করলেই ঘুঘুডাঙা হাজির হতে পারে। তবে সাবধান, ব্ৰহ্মদত্যি মশায়ের জন্য সন্দেশ নিয়ে যেতে ভুলাে না। নয় তাে বেলগাছ থেকে শ্বানভাষায় গর্জন শুনবে-ঘেউ গর, র, র, র !•••
বকুলগাছের লোকটা এ আমার ছেলেবেলার কাহিনী। ইচ্ছে হলে বিশ্বাস না করতেও পার কেউকিন্তু সত্যি ঘটেছিল।
এক শীতের সকালে পুবের বারান্দায় ঝলমলে রােদ্দর খেলছে। আমি আর আমার বােন ইলু সতরঞ্জি পেতে বসে খুব চেচিয়ে চেচিয়ে পড়া মুখস্থ করছি। কদিন বাদেই বার্ষিক পরীক্ষা কি না। তার ওপর মেজকাকা বলে দিয়েছেন, যত জোরে চেচিয়ে পড়া মুখস্থ করবি, তত ভাল রেজাল্ট হবে। ইলু তাে গলা ভেঙে ফেলল উৎসাহের চোটে। কিছুক্ষণ পরে শুনি, ফাস ফঁাস আওয়াজ বেরুচ্ছে বেচারীর গলা থেকে। সে মাঝে মাঝে বই থেকে মুখ তুলে করুণ চোখে তাকিয়ে যেন মেজকাকাকেই খুঁজছে।
মেজকাকার পাত্তা নেই। আমি বললুম-ইলু, বরং জল খেয়ে আয়।
ইলু ফঁাসাসে গলায় বলল—যদি মেজকাকু এসে পড়েন।
—তুই ঝটপট খেয়ে আয় গে না ! আমি বলব মা ইলুকে ডেকেছেন।
এই শুনে ইলু জল খেতে গেল ভেতরে। আমি আবার চেচিয়ে পড়তে শুরু করেছি, ‘মােগল সম্রাট আকবর•••মােগল সম্রাট আকবর•••, সেই সময় কোত্থেকে হেঁড়ে গলায় কে বলে উঠল–কী পড়া হচ্ছে খােকাবাবু?
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৭
আমাদের বাড়ির এদিকটায় বাগান। বাগানের ওপাশে ধান খেত। সবে পাকা ধান কেটে নিয়েছে চাষীরা। সেদিকে দূরে ঘন নীল কুয়াশা ভাসছে, যেন বুড়াে মাঠ আলােয়ান গায়ে দিয়ে এখন ঘুম-ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে। বায়ান্দা থেকে কয়েক মিটার তফাতে আছে একটা ঝাঁকড়া বকুলগাছ। মনে হল, আওয়াজটা এসেছে ওই
গাছ থেকেই। তাই মুখ তুলে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। খুজছি
কে কথা বলল।
হঠাৎ দেখি, বকুলগাছ থেকে হনুমানের মতো ধুপ করে নীচে লাফিয়ে পড়ল একটা বেঁটে নাদুস-নুদুস গড়নের লোক। হাঁটু অব্দি পরা ধুতি, খালি গা, কুচকুচে কালো রঙ। বুকের ওপর দিয়ে একটা পৈতে ঝুলছে। তার মাথার কঁচাপাকা চুলগুলাে ছােট করে ছাঁটা, খোঁচাখোঁচা হয়ে আছে। টিকিতে ফুল গোজা। তার গেফিগুলোও সেইরকম বিচ্ছিরি। হাতে একটা হুকোও আছে। পায়ে খড়ম আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসল । তারপর এগিয়ে আসতে লাগল। আমি তো অবাক। হা করে তাকিয়ে আছি। নাকে ভুর ভুর করে তামাকের মিঠে গন্ধ ভেসে আসছে। আমাদের পাঠশালার পণ্ডিতমশাই ঠিক এমন সুগন্ধি তামাক খেতেন।
কিন্তু বকুলগাছে অমন হুকো খাওয়া বিদঘুটে চেহারার লােক থাকাটা যদি বা মেনে নেওয়া যায়, তার এভাবে পড়া-ডিস্টার্ব করতে আসাটা মােটেও উচিত হয়নি। মেজকাকা থাকলে নিশ্চয় আপত্তি করতেন | সে হুকোয় গুড় গুড়ক আওয়াজ করে টান দিতে দিতে আমার একটু তফাতে পা ঝুলিয়ে বসল। তারপর হুকো নামিয়ে । হাতে ধরে রেখে বলল—কী ? ওটা কী পড়া হচ্ছে ?
গম্ভীর মুখে জবাব দিলুম-ইতিহাস।
এই শুনে সে খিকখিক করে হেসে উঠল।—ইতিহাস? সে আবার কেমন হাঁস খােকা? অা? টের টের হাঁসের নাম শুনেছি। ইতিহাস নামে কোনাে হাসের কথা তাে শুনিনি।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৭
কী বোেকা লােক রে বাবা! হাসি পেল। বললুম-না, না, হাস নয়। ইতিহাস।
লােকটা বলল—সেই তাে বলছি গো! পাতিহাঁস, এলেহাস, বেলেহাঁস, জলহাঁস, রাজহাঁস, বুনােহাঁস-কত রকম হাস আছে।
সে সব ছেড়ে ওই উদ্ভুটে ইতিহাস নিয়ে পড়াটা সুবিধের নয়। বরং ওই যে কী বলে পাতাল হাঁস নাকি হাসপাতাল—সেটাও মন্দ নয়। এবার একটু রাগ হল। বললুম—তুমি কিসু বােৰঝা না !
বুঝি না? আমি বুঝি না? লােকটাও চটে গিয়ে মুখখানা তুম্বাে করে ফেলল।আমি বুঝি না তাে কে বােঝে শুনি? কোথায় থাকে | তােমার ইতিহাস ?
বইয়ের পাতা দেখিয়ে বললুম—এই তাে এখানে থাকে।
সে আবার ফিক করে হাসল।-ওই শুকনাে খসখসে বইয়ের পাতায় ইতিহাস থাকে ? বলছ কী খােকা! খায় কী ? এখানে ততা দেখছি জলটল একফোটা নেই। সাঁতার কাটছেই বা কেমন করে ? | বুঝলুম, বকুলগাছের এই হুকোথাের লােকটা একটি মুখ। লেখাপড়াই জানে না। তাই ওকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেবার জন্য বললুম-ইতিহাস নয়, ইতিহাস। এর মানে কী জানাে?
সে আপত্তি করে বলল—আমাকে মানে বােঝাতে এসাে না। বিস্তর হাসি দেখে-দেখে বুড়ো হয়ে গেলুম। দিনরাতে ঝাঁকে ঝাঁকে ডানা শনশন করে কত হাঁস আসছে-যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। কত রকম গানও গায়, জানেন? শােনাে। বলে সে হেড়ে গলায় গুনগুন করে গেয়ে উঠল ।
Read More