‘তেপান্তরের মধ্যিখানে
মস্তো একটা বিল আছে কলমিদামে শালুক পানায়
কত যে ফুল ফুটতাছে শামুক বুড়ো চিংড়ীবুড়ি
বড় সুখে রােদ পােহায় যে যাবি ভাই আয় রে সাথে শনশনিয়ে আয় রে আয় | গানটা কেমন ঘুমঘুম সুরে ভরা। শুনতে-শুনতে হাই ওঠে। দুলুনি চাপে। শীতের লম্বা রাতে বেজায় লম্বা ঘুমের পর এই মিঠে রােদের সক্কালবেলা আবার ঘুমিয়ে পড়াটা বিপজ্জনক। মেজকাকা। এসে টের পেলেই চুল খামচে ধরবেন।
গান শেষ করে লােকটা চোখ নাচিয়ে বলল—দারুণ গান, তাই ? বলে সে আবার গুড়ক গুড়ক আওয়াজ করে হুকো টানতে থাকল।আমি ঘােরলাগা চোখে তাকিয়ে বললুম—গানটা ভাল লাগল। তবে বড্ড ঘুম পায় যে। ওগাে লােকটা, তুমি বরং রাতে শােবার সময় এস। এখন যাও। পড়ায় ডিসটার্ব কোরাে না। মেজকাকা বকবেন ।
—কে তােমার মেজকাকা? ঢ্যাঙা রােগমতাে ছােকরাটা বুঝি ?
-চুপ! ও কথা বােললা না। মেজকাকাকে রােগা বললে আগুন হয়ে ওঠেন। মেজকাকার একটা কুকুর আছে, জাননা তাে? তার নাম কালু। কালুকে
এ পর্যন্ত শুনেই লােকটা যেন চমকে উঠল। চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল–কালু এখন বাড়িতে আছে নাকি ?
বললুম–মনে হচ্ছে না। থাকলে এতক্ষণ তােমাকে ওরে বাবা ! বােলো না, বােলো না।
ওকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা লাগল। বললুম-তাই তাে বলছি, পড়ায় ডিসটার্ব না করে তুমি কেটে পড়াে। এক্ষুণি কালু এসে পড়তে পারে। বােধহয় মেজকাকার সঙ্গে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছে।
লােকটা উঠে দাড়াল। তারপর বলল—তাহলে আসি। আমার কথা কাকেও বােলা না যেন। পরে সময়মতাে এসে তােমাকে আরও হাঁসের গান শােনাব। ইচ্ছে করলে দেখতে যেতেও পারাে হাসের কোথায় থাকে। কিন্তু তাই বলে সেখানে তােমার ওই ইতিহাস দেখতে পাবে ভেবাে না। তােমার পড়ার বইতে মিথ্যে লিখেছে ! বরং ওই যে কী বলে পাতালহাঁস বা হাসপাতাল সত্যি হলেও হতে পারে।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮
এই বলে সে খড়ম পায়ে চাপা খটখট শব্দ তুলে বকুলগাছে দিব্যি চড়ে গেল এবং ঝকড়া ডালপালার মধ্যে অদৃশ্য হল। আমি অবাক হয়ে বসে রইলুম। আমাদের বাগানের বকুলগাছটাতে এমন কেউ
থাকে তা তাে শুনিনি। বাবা মা মেজকাকা সেজকাকা ছােটকাকা – কেউই বলেননি ?
ইলু এতক্ষণে এসে ফঁাসফেঁসে গলায় বলল—কী রে বিশু? কী দেখছিস অমন করে ? সেই লেজঝোলা পাখিটা?
উহু, বকুলগাছের লােকটা পই পই করে বারণ করেছে। কাকেও ওর কথা বলব না।
-কী রে বিলু? বলছিস না যে! বারবার জিগ্যেস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে না বুঝি ?
ইলুকে পাত্তা না দিয়ে আবার পড়া শুরু করলুম : মােগলসম্রাট আকবর মােগলসম্রাট আকবর ইতিহাস না—পাতিহাঁস এলেহাস বেলেহাঁস, রাজহাঁস পুষতে ভালবাসতেন। তাই তিনি
ইলু অবাক হয়ে বলল—কীপড়ছিস রে। দাড়া মেজকাকা আসুক–
বকুলগাছের লােকটার কথা আমি কাকেও বলিনি। সেই যে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেল, তারপর কতবার এই বারান্দা কিংবা বাগানে একলা হলেই সে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। কতরকম মজার মজার গল্প শুনিয়েছে। কত অজব ছড়া!
কিন্তু মুশকিল বাধাচ্ছিল মেজকাকার কুকুর কাল। বেশ দুজনে কথা বলছি, হঠাৎ কালটা কোথায় ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, অমনি লোকটা বকুলগাছে লুকিয়ে পড়ে। কালটা মহা পাজী। গাছটা চক্কর দিয়ে ওপরে মুখ তুলে কতক্ষণ ঘেউ ঘেষ্ট করে। আমি ওকে তাড়াতে গেলে দাত বের করে আমাকেই কামড়াতে আসে। আমি ঢিল ছুড়ে তাড়াই।।
একদিন বিকেলে স্কুল থেকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে বাগানে একলা দাড়িয়ে ওর একটা গল্প শুনছি। গল্পটা দারুণ মজার। আমাদের গায়েরই এক শাকতােলানী বুড়ি গেছে তেপান্তরের মাঠের মধ্যিখানে সেই হাসচরা বিলে। বুড়িটা ছিল বড় কুঁদুলী। লােকে বলত পাহাড়কুঁদুলী। কারণ পাড়ার লােকের সঙ্গে হুট করতেই কেঁদল সেই পাড়াকুঁদুলী বুড়ি আপন মনে হচিরা বিলে কলমী শাক তুলছে। তার স্বভাব যাবে কোথায় ? একটা শামুকের শু’ড়ে ওর ঠ্যাঙে সুড়সুড়ি লেগেছে বলে বুড়ি তার সঙ্গে কেঁাদল জুড়ে দিয়েছে।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮
বুড়ি নেচেনেচে ছড়া গেয়ে কেঁদল করছে :
‘তাের মুণ্ডু খাই, তাের কত্তাবাবার খাই। কড়মড়িয়ে খাই আমি মড়মড়িয়ে খাই ।
খেয়েদেয়ে ড্যাডেঙ্গিয়ে নাতির বাড়ি যাই— এদিকে হয়েছে কী, জলার ধারে থাকে এক শখিচুন্নী। সেও পেত্নীপাড়ার নামকরা কুঁদুলী। শথি, গুগলি, কঁদড়া আর শামুক তার খাদ্য। এ বুড়ি যেমন পেটের জ্বালায় শাক তুলতে গেছে সেই শখিচুন্নীও তেমনি পেটের জ্বালায় গুগলি, শামুক খুঁজতে গেছে। শাকতােলানীর গলা পেয়ে সে ট্যাঙস্ ট্যাঙস করে সেখানে হাজির হয়েছে। হয়ে বলেছে—কী কী কী?
ব্যস! দুই কুঁহুলীতে বেধে গেছে তুমুল কেঁাদল। কেউ থামবার নয়। পরস্পর আঙুল তুলে পরস্পরকে শাসাচ্ছে। সে কী চিলচাচানি! সে কী নাচনকেদিন!
হেন সময়ে জলার হাসদের রাজার কানে গেছে সেই খবর। – হাঁসের রাজা রাজহাঁস খাপ্পা হয়ে বলল :
‘প্যাক প্যাক প্যাকোর প্যাক– শিগগির গে’ দ্যাখ তাে কারা দেখায় কি রে কাট তাদের নাক তবু না থামে যদি, কাটিস চুল আর দুকানের লতি প্যাক প্যাকোর প্যাক শিগগির দ্যাখ তাে••.হকুম পেয়েই জলার যত পাতিহাঁস বেলেহাস শনশনিয়ে ডানা কঁপিয়ে ঝাঁকেঝাঁকে আসতে লেগেছে। আকাশ বাতাসে হলস্থল। জলার জল ঢেউয়ে তােলপাড়। তারপর কিনা•••
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮
আচমকা ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ। বাড়ির ভেতর থেকে হতচ্ছাড়া কালটা বেরিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পড়ল এবং তাকে দেখেই আমার বকুলগাছের কোখেকো বন্ধুবেচারা এক লাফে গাছে চড়ে অদৃশ্য হল। তার হ‘কোটা পড়ে গেল হাত ফসকে। কলকে উল্টে ছাই পড়ল গড়িয়ে। আগুনের ফুলকি উঠল চিড়বিড়িয়ে। বগবগ করে
একটু জলও হকোর খােলের ফুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল। | কাল; চেচামেচি করে গাছ চক্কর দিচ্ছে। এমন সময় মেজকাকা বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। এসেই কালকে ধমক দিয়ে বললেন শাট আপ! শাট আপ।
কাল, থামবার পাত্র নয়। সে মেজকাকর কাছে এসে হাঁটুর কাছে মুখ তুলে কেঁউমেউ করে কী বলল। তারপর আবার দৌড়ে গেল গাছতলায়।
Read More