সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮

‘তেপান্তরের মধ্যিখানে 

মস্তো একটা বিল আছে কলমিদামে শালুক পানায় 

কত যে ফুল ফুটতাছে শামুক বুড়ো চিংড়ীবুড়ি 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক

 বড় সুখে রােদ পােহায় যে যাবি ভাই আয় রে সাথে  শনশনিয়ে আয় রে আয় | গানটা কেমন ঘুমঘুম সুরে ভরা। শুনতে-শুনতে হাই ওঠে। দুলুনি চাপে। শীতের লম্বা রাতে বেজায় লম্বা ঘুমের পর এই মিঠে রােদের সক্কালবেলা আবার ঘুমিয়ে পড়াটা বিপজ্জনকমেজকাকা। এসে টের পেলেই চুল খামচে ধরবেন। 

গান শেষ করে লােকটা চোখ নাচিয়ে বলল—দারুণ গান, তাই ? বলে সে আবার গুড়ক গুড়ক আওয়াজ করে হুকো টানতে থাকল।আমি ঘােরলাগা চোখে তাকিয়ে বললুম—গানটা ভাল লাগলতবে বড্ড ঘুম পায় যেওগাে লােকটা, তুমি বরং রাতে শােবার সময় এসএখন যাওপড়ায় ডিসটার্ব কোরাে না। মেজকাকা বকবেন । 

কে তােমার মেজকাকা? ঢ্যাঙা রােগমতাে ছােকরাটা বুঝি

-চুপ! ও কথা বােললা নামেজকাকাকে রােগা বললে আগুন হয়ে ওঠেনমেজকাকার একটা কুকুর আছে, জাননা তাে? তার নাম কালুকালুকে 

এ পর্যন্ত শুনেই লােকটা যেন চমকে উঠলচাপা গলায় জিজ্ঞেস করল–কালু এখন বাড়িতে আছে নাকি ? 

বললুমমনে হচ্ছে নাথাকলে এতক্ষণ তােমাকে ওরে বাবা ! বােলো না, বােলো না। 

ওকে ভয় পেতে দেখে খুব মজা লাগল। বললুম-তাই তাে বলছি, পড়ায় ডিসটার্ব না করে তুমি কেটে পড়ােএক্ষুণি কালু এসে পড়তে পারেবােধহয় মেজকাকার সঙ্গে পাড়া বেড়াতে বেরিয়েছে। 

লােকটা উঠে দাড়ালতারপর বলল—তাহলে আসিআমার কথা কাকেও বােলা না যেনপরে সময়মতাে এসে তােমাকে আরও হাঁসের গান শােনাবইচ্ছে করলে দেখতে যেতেও পারাে হাসের কোথায় থাকে। কিন্তু তাই বলে সেখানে তােমার ওই ইতিহাস দেখতে পাবে ভেবাে না। তােমার পড়ার বইতে মিথ্যে লিখেছে ! বরং ওই যে কী বলে পাতালহাঁস বা হাসপাতাল সত্যি হলেও হতে পারে। 

 নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮

এই বলে সে খড়ম পায়ে চাপা খটখট শব্দ তুলে বকুলগাছে দিব্যি চড়ে গেল এবং ঝকড়া ডালপালার মধ্যে অদৃশ্য হল। আমি অবাক হয়ে বসে রইলুমআমাদের বাগানের বকুলগাছটাতে এমন কেউ 

থাকে তা তাে শুনিনি। বাবা মা মেজকাকা সেজকাকা ছােটকাকা কেউই বলেননি

 ইলু এতক্ষণে এসে ফঁাসফেঁসে গলায় বলল—কী রে বিশু? কী দেখছিস অমন করে ? সেই লেজঝোলা পাখিটা

উহু, বকুলগাছের লােকটা পই পই করে বারণ করেছেকাকেও ওর কথা বলব না। 

-কী রে বিলু? বলছিস না যে! বারবার জিগ্যেস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে না বুঝি ? 

ইলুকে পাত্তা না দিয়ে আবার পড়া শুরু করলুম : মােগলসম্রাট আকবর মােগলসম্রাআকবর ইতিহাস না—পাতিহাঁস এলেহাস বেলেহাঁস, রাজহাঁস পুষতে ভালবাসতেনতাই তিনি 

ইলু অবাক হয়ে বলল—কীপড়ছিস রে। দাড়া মেজকাকা আসুক– 

বকুলগাছের লােকটার কথা আমি কাকেও বলিনিসেই যে ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেল, তারপর কতবার এই বারান্দা কিংবা বাগানে একলা হলেই সে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেছেকতরকম মজার মজার গল্প শুনিয়েছে। কত অজব ছড়া! 

কিন্তু মুশকিল বাধাচ্ছিল মেজকাকার কুকুর কালবেশ দুজনে কথা বলছি, হঠাৎ কালটা কোথায় ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, অমনি লোকটা বকুলগাছে লুকিয়ে পড়েকালটা মহা পাজীগাছটা চক্কর দিয়ে ওপরে মুখ তুলে কতক্ষণ ঘেউ ঘেষ্ট করে। আমি ওকে তাড়াতে গেলে দাত বের করে আমাকেই কামড়াতে আসেআমি ঢিল ছুড়ে তাড়াই। 

একদিন বিকেলে স্কুল থেকে শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফিরে বাগানে একলা দাড়িয়ে ওর একটা গল্প শুনছিগল্পটা দারুণ মজার। আমাদের গায়েরই এক শাকতােলানী বুড়ি গেছে তেপান্তরের মাঠের মধ্যিখানে সেই হাসচরা বিলে। বুড়িটা ছিল বড় কুঁদুলী। লােকে বলত পাহাড়কুঁদুলীকারণ পাড়ার লােকের সঙ্গে হুট করতেই কেঁদল সেই পাড়াকুঁদুলী বুড়ি আপন মনে হচিরা বিলে কলমী শাক তুলছেতার স্বভাব যাবে কোথায় ? একটা শামুকের শু’ড়ে ওর ঠ্যাঙে সুড়সুড়ি লেগেছে বলে বুড়ি তার সঙ্গে কেঁাদল জুড়ে দিয়েছে। 

 নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮

বুড়ি নেচেনেচে ছড়া গেয়ে কেঁদল করছে

‘তাের মুণ্ডু খাই, তাের কত্তাবাবার খাই। কড়মড়িয়ে খাই আমি মড়মড়িয়ে খাই । 

খেয়েদেয়ে ড্যাডেঙ্গিয়ে নাতির বাড়ি যাই— এদিকে হয়েছে কী, জলার ধারে থাকে এক শখিচুন্নী। সেও পেত্নীপাড়ার নামকরা কুঁদুলীশথি, গুগলি, কঁদড়া আর শামুক তার খাদ্যএ বুড়ি যেমন পেটের জ্বালায় শাক তুলতে গেছে সেই শখিচুন্নীও তেমনি পেটের জ্বালায় গুগলি, শামুক খুঁজতে গেছে। শাকতােলানীর গলা পেয়ে সে ট্যাঙস্ ট্যাঙস করে সেখানে হাজির হয়েছেহয়ে বলেছে—কী কী কী

ব্যস! দুই কুঁহুলীতে বেধে গেছে তুমুল কেঁাদলকেউ থামবার নয়পরস্পর আঙুল তুলে পরস্পরকে শাসাচ্ছেসে কী চিলচাচানি! সে কী নাচনকেদিন

হেন সময়ে জলার হাসদের রাজার কানে গেছে সেই খবর। – হাঁসের রাজা রাজহাঁস খাপ্পা হয়ে বলল

প্যাক প্যাক প্যাকোর প্যাক– শিগগির গেদ্যাখ তাে কারা দেখায় কি রে কাট তাদের নাক তবু না থামে যদি, কাটিস চুল আর দুকানের লতি প্যাক প্যাকোর প্যাক শিগগির দ্যাখ তাে••.হকুম পেয়েই জলার যত পাতিহাঁস বেলেহাস শনশনিয়ে ডানা কঁপিয়ে ঝাঁকেঝাঁকে আসতে লেগেছে। আকাশ বাতাসে হলস্থল। জলার জল ঢেউয়ে তােলপাড়তারপর কিনা••• 

 নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৮

আচমকা ঘেউ ঘেউ ঘেউ ঘেউ। বাড়ির ভেতর থেকে হতচ্ছাড়া কালটা বেরিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পড়ল এবং তাকে দেখেই আমার বকুলগাছের কোখেকো বন্ধুবেচারা এক লাফে গাছে চড়ে অদৃশ্য হল। তার কোটা পড়ে গেল হাত ফসকে। কলকে উল্টে ছাই পড়ল গড়িয়েআগুনের ফুলকি উঠল চিড়বিড়িয়েবগবগ করে 

একটু জলও হকোর খােলের ফুটো থেকে গড়িয়ে পড়ল| কাল; চেচামেচি করে গাছ চক্কর দিচ্ছেএমন সময় মেজকাকা বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকেএসেই কালকে ধমক দিয়ে বললেন শাট আপ! শাট আপ। 

কাল, থামবার পাত্র নয়সে মেজকাকর কাছে এসে হাঁটুর কাছে মুখ তুলে কেঁউমেউ করে কী বলল। তারপর আবার দৌড়ে গেল গাছতলায়।

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৯

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *