সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৯

এবার মেজকাকা সন্দেহাকলে চোখে গাছটা দেখতে দেখতে বললেন—গাছে হনুমান আছে নাকি রে বিল

বললম–না মেজকাক। কাল একটা কাঠবেড়ালি দেখেছে। 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক

হঠাৎ গাছতলায় উল্টে পড়ে থাকা হকোটার দিকে চোখ গেল মেজকাকারহুকোটা তুলে নিয়ে অবাক হয়ে বললেন—এ কার হকো রে বিল ? 

আমি তাে জানিনে মেজকাকু। 

মেজকাকা ধমক দিয়ে বললেন—জানাে না? এখনও কলকের আগুন রয়েছেকে হুকো খাচ্ছিল বল্ হতভাগা

—জানিনে মেজকাকু। 

আলবৎ জানিস !—বলে হ’কোটা তুলে ভুড়ক ভুড়ক করে কয়েকটা টান মেরে মেজকাকা ফুরফুর করে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলেন । বাএ তাে ভারি সুগন্ধি তামাক । 

-ও মেজকাক! ছ্যা ছ্যা। তুমি হুকো খাচ্ছ ? বলে দেব বাবাকে ? 

মেজকাকা চোখ টিপে বললেন—চুপ। লেবেনচুষ দেব। তারপর মনের আনন্দে হুকো খেতে থকিলেম। ততক্ষণে কাল; মেজকাকার কাছে ফিরে এসে মুখ তুলে যেন তামাকের গন্ধ শুকছে। কালার মুখটা বেজায় গম্ভীর। চোখে সন্দেহের চাউনি।। 

 তারপর কাল; আমার কাছে এসে বেজায় ধমক দিল বার তিনেক। আমি অবিকল মেজকাকার গলায় বললাম-শাট আপ কাল! শাট আপ। 

কাল যেন ককরের ভাষায় পাল্টা ধমক দিয়ে বলল—চালাকি কোরো না বিল। সব বুঝতে পেরেছি আমি। তারপর সে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে লেজ তুলে বাড়ির ভেতর চলে গেল। 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৯

মেজকাকা তারিয়ে তারিয়ে হুকো খাওয়ার পর চাপাস্বরে বললেন -এই বিল, আরাে দুটো লেবেনচুষ দেব। বল না, কার হুকো এটা? 

বলব, না বলব না ভাবছি—হঠাৎ বিদঘুটে ব্যাপার ঘটে গেল। ততক্ষণে শীতের বেলা ফুরিয়ে এসেছে। বাগানে আর একটুও দিনের আলাে নেই। আবছায়া ঘনিয়েছে। গাছগুলাে গায়ে কুয়াশার চাদর টেনে নিয়েছে। সেই ধূসর কুয়াশা আর আবছা অন্ধকারে বকুলগাছটা থেকে একটা মস্তো লম্বা কালো হাত বেরিয়ে খপ করে মেজকাকার হাত থেকে কোটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল । 

অমনি মেজকাকা আঁতকে উঠে গোঁ গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। 

আর আমিও এতদিন পরে এতক্ষণে ঝটপট বুঝে নিয়েছি, বকল গাছের বন্ধুটি খুব সহজ লােক নয়। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি সঙ্গে সঙ্গে। 

আমার চেচামেচিতে বাবা বেরিয়ে এলেন। মা এলেন। আর সৰ কাকারা এলেন। সে এক হুলস্থলস ব্যাপার। আলাে আন! জল আন। পাখা আন !  

পরদিন সকালে বুধু ওঝাকে ডেকে আনা হলসে নাকি ভূত প্রেতের যম। লােকে বলে বুধু ওস্তাদ। সে মেজকাকাকে খুব ঝাড়ফুক করে বললবলুন, নেই । 

মেজকাকা মিনমিনে স্বরে বললে—নেই । 

তারপর বুধু গাছটার চারপাশে ঘুরে দেখেশুনে বাবাকে বলল বড়বাবু। এই গাছটা আজই কেটে ফেলুনগাছে ব্ৰহ্মত্যি আছে। 

বাবা ভয় পেয়ে বললেন—বলো কী হে ওস্তাদ!

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৯

 

—আজ্ঞে হ্যা বড়বাবুবলে বুধু আমার দিকে যেন চোখে তাকিয়ে ফের বলল—আমার মনে হচ্ছে, খােকাবাবুর দিকেও নজর পড়েছে ওনারকেমন যেন শুকনাে-শুকনাে দেখাচ্ছে—খােকা বাবুর চোখে ব্ৰহ্মদত্যিমশাইকে দেখতে পাচ্ছিওই তাে হুকো টানছে গুড়ক গুড়ক করে। 

মা সভয়ে আমাকে টেনে নিয়ে বললেন—হ্যা, হ্যাখোকা কিছুদিন থেকে ভাল করে খাচ্ছেটাচ্ছে নাখালি বকুলতলায় মন পড়ে থাকেকী যেন ভাবে আর বিড়বিড় করে কথা বলে । 

আমি বললাম—ভ্যাটু। আমার কি হয়নি। 

বুধু আমার বুকে তার কড়ে আঙুল ছুইয়ে বিড়বিড় করে কী মন্ত্র পড়ল। তারপর ঘুরে বকুলগাছটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ধমক দিলযা, যা ! ভাগ

সেদিন দুপুরে দেখি, মকবুল কাঠুরেকে ডেকে আনা হয়েছে। সে কড়ল নিয়ে গাছটার কাছে যেতেই আমি কান্নাকাটি জুড়ে দিলাম। মেজ কাকা আমাকে থাপ্পড় তুলে ধমক দিলেন—শাট আপ ! শাট আপ। 

আমার চোখের সামনে নিষ্ঠর মকবুল কাঠুরে গাছটার গােড়ায় কোপ মারতে শুরু করল। দুঃখে রাগে আমি অস্থির। কিছুক্ষণের মধ্যেই অত সুন্দর বকলগাছটা মড়মড় করে ভেঙে পড়লমকবুল দাত বের করে হেসে বলল—এবারে শীতের রােদ্দর অনেকটা পাবেন বাবুমশাইএখানে ফুলের গাছ লাগাবেনদেখবেন, কেমন রাঙারাঙা ফুল ফুটবে । 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১৯

শূলপাণি গদাধর এক যে আছে নদী। নদী, নাকি নদীর বাচ্চা। এখনও কলকলবু লিই শেখেনিহাঁটি-হাঁটি পা-পা করে বয়ে যায় । টলতে টলতে এই পড়ি ওই পড়ি করে মাটি আঁকড়ে গাছগাছালির শেকড়বাকড় খামচে বাঁকে বাঁকে টাল সামলে বয়ে যায়। কোথায় যায় ? | সে খবর জানত বিরাং পাটনীএখন সে ঘাটে নেইপালিয়েছে বেচারার বরাত। মাঝে মাঝে তাকে ঘাট ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হয়। 

আর ওই ভগল, ধােপ—যে সকাল সন্ধে নদীর ঘাটে কাপড় কাচে। সেও পালিয়েছে। মাঝে মাঝে তাকেও পালাতে হয়। 

কেন পালাতে হয় ওদের, সেই নিয়েই এই গল্প। 

এই বাচ্চানদীর একপাড়ে থাকেন শূলপাণি, অন্যপাড়ে গদাধরদুজনে যখন ভাব থাকে, তখন ভয়ের কিছু নেই। বিরাং পাটনী কাই রে মাই রে করে গান গেয়ে নৌকো চালায় ! ভগল; ধােপও তাইরে নাইরে গাইতে গাইতে কাঠের পাটায় কাপড় কাচে। 

কিন্তু শূলপাণিগদাধরে বিবাদ লাগলেই অবস্থা ঘােরালাে হয়এখন সেই বিবাদ চলছেতাই ঘাট ফঁকাশঙ্খচিলেবুড়ি মা, যে রােজ দুপুরে এখানে সুর ধরে কঁদতে আসত, সেও আসতে পারেনি

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-২০

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *