সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-২০

অথচ কিছুদিন আগেও কী ভাব ছিল গদাধরশূলপাণির। নদীর দুপাড়ে দুজনে দাড়িয়ে এইসব কথাবার্তা হয়। 

-এই যে! শূলপাণি মুচকি হেসে বলতেন-এই যে! গদাধরও ফিকফিক হেসে বলতেন

নিঝুম রাতের আতঙ্ক 

হু, হু…খুব যে ইয়েঅা? শূলপাণি চোখ নাচিয়ে বলতাে। 

এবার গদাধর একটু বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলতেন—তা যাই বলো, তােমার ওই ইয়েটা কেমন যেন একটু ইয়ে। 

শূলপাণি গতিক বুঝে বলতেন না নামানে তােমার শরীরটা বেশ নাদুসনুদুস হয়েছে। রঙটাও চেকনাই হয়েছেখাচ্ছটা কি শুনি

গদাধরের এবার হু হু করার পালা। সগর্বে বুক ফুলিয়ে বলতেন —খাচ্ছি কী ? বাঘের দুধ। খাঁটি সেঁদরবনের বাঘ। বুঝলে তাে ? তুমিও খেওআমার মতাে পালােয়ান হয়ে উঠবেস্বাদও তােফা। অবিকল কোকাকোলার মতােবরং এককুচি এলাচ মিশিয়ে নিও।। 

শূলপাণি আঁতকে উঠে বলতেনওরে বাবা ! ভােরাডের দাগওয়ালা জিনিসকে আমার বড় ভয় করে যে! নৈলে বাঘের দুধ খেতে আমি পিছপা নইকোকাকোলার মতো স্বাদ বলছ যখন। 

গদাধর বলতেন—বলাে তাে, হটুরু গয়লাকে পাঠিয়ে দেবচোখের সামনে দুধ দুয়ে দেবে। 

না ভাই, না। বরং হটুরুকে বলে দিও, রােজ এক গেলাস, করে দিয়ে যাবে| শােনা যায়, গদাধর শূলপাণির জন্যে হটুরুকে দিয়ে বাঘের দুধের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং শূলপাণি সে-দুধ খেয়েছিলেনও; কিন্তু গায়ে একরত্তি মাংস লাগেনি। উল্টে পেটের গণ্ডগােল হয়েছিল । 

তবে গ্রীষ্মকাল এলে গদাধরের এক জ্বালা। মােটা মানুষ। গরমে আইঢাই অবস্থা। নদীর ধারে গিয়ে শূলপাণির সঙ্গে দেখা হলে বলতেন—শূললএখন বুঝেছি, রােগা হওয়ার কত সুবিধেবলে দাও না ভাই, কী খেয়ে এমন রােগা হয়ে আছ ?

শূলপাণি বলতেন—কিছু নাস্রেফ চামচিকের রােস্টরােজ. সকালে খালিপেটে একটা। 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-২০

কিন্তু এপাড়ে যে চামচিকেই নেই। খালি বাদুড়। 

ভেবাে না। আমার ঘরে অসংখ্য চামচিকে। রোজ একটা করে পাঠিয়ে দেব। 

চামচিকের রােস্ট খেয়েও নাকি গদাধর রােগা হতে পারেননি। মাঝখান থেকে গায়ের রঙটা বেজায় কালো হয়ে গিয়েছিল । এইতে গদাধর মনে মনে চটে শােধ নেবার ফিকিরে ছিলেন। শীতকালে শূলপাণি একদিন নিজের শীতকাতুরে দশার কথা তুললে গদাধর তাকে হাতির মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেন। শূলপাণি সাহস পাননি একে তাে পেটের রুগী, সবসময় হজমিগুলি চোষেন। 

নদীর দুপাড়ের এই দুই বন্ধুর মধ্যে ছােটখাটো রাগারাগি না দেখা গেছে, এমন নয়। তাতে বন্ধুত্ব চটেনি। এমনকি গত বর্ষার সময় প্রায় একটা সংঘর্ষ বাধতে বসেছিল । তাও শেষ অব্দি মিটে যায়। 

হয়েছিল কী, নদীতে বর্ষার ঢল বইছে, আর ভেসে যাচ্ছে ফুলবাবুর মতাে একটা মড়া। দুই বন্ধু দুই পাড়ে দাড়িয়ে দেখছেন। তাে সেই ফুলবাবু মড়াটা ছিল বড় ফাজিল। হঠাৎ মাথা তুলে ফিক করে হাসল। তারপর যেমন ভাসছিল, তেমনি ভাসতে ভাসতে । চলল। শূলপাণি বললেন—ও গদাই, ব্যাটা হেসে গেল কেন বলো তো? 

গদাধর বললেন—তাই তাে হে শূলে।। হাসল কেন বলাে তাে ? 

শূলপাণি মিটিমিটি হেসে বললেন-বুঝেছি। তােমাকে দেখে ওর হাসি পেয়েছিল। 

-কেন, কেন? গদাধর চোখ কটমট করে তাকালেন। 

শূলপাণি বলেই ফেললেন—তুমি যে হোদল কুতকুত ! দেখলে কার না হাসি পায়। আমারই তাে পাচ্ছে। হি হি হি হি.•• 

-হা হা হা হা। গদাধর ভেংচি কাটলেন। ভগলু ধােপা কাপড় কাচছিল। শূলপাণি আর গদাধর দুই 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-২০

পাড়ে দাড়িয়ে পরস্পরকে ভেংচি কাটছেন দেখে সে ভয় পেয়ে বলে উঠল—ও বাবুমশাইরা ! তার চে’ মড়াটার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলেই তাে হয়। 

কথাটা মনে ধরল। তখন দুজনে দুই পাড় ধরে দৌড়লেন। ততক্ষণে মড়াটা বাঁকঅব্দি এগিয়ে একটা কচুরিপানার দামে ঢু মারছে। দুই বন্ধু সামনাসামনি গিয়ে দুই পাড় থেকে এক গলায় পেঁচিয়ে ডাকলেন–ও দাদা! শােন, শােন। 

কচুরিপানা নিয়ে ব্যস্ত মড়া তেতেমুখে বলল–কী, কী, কী ? 

কাকে দেখে তখন হেসে এলে বলে যাও না দাদা ? –বলব কেন? লেবুনচুষ দাও। 

শূলপাণির পকেটে তাে হজমিগুলি সবসময় থাকে। টুপ করে ছুড়ে দিলেন। মড়াটাও খপ করে লুফে নিয়ে গালে পুরল । গদাধর তখন মিছিমিছি পকেট হাতড়াচ্ছেন। তােত মিঠে ঝাঁঝালাে হজমিগুলি চুষতে চুষতে শ্ৰীমান মড়া গদাধরের দিকে বুড়াে আঙুল তুলে বলল 

মানুষ না টানুষ না ভূত না মাহুত না। 

ওটা একটা হাতি পাঁকে পড়লেই খায়। 

চামচিকের লাথি ॥~ শুনে শূলপাণির সে কী তিড়িংবিড়িং নাচ। হি হি হি গদাই– হি হি হি! গদাধর রেগে কই। ঢিল কুড়ােন আর ছােড়েন। ভাসমান ফুলবাবু ততক্ষণে বাঁক পেরিয়ে উধাও। তখন গদাধর আঙুল তুলে শূলপাণিকে শাসাতে শাসাতে বাড়ি চললেন। 

পরদিন লােকেরা দেখল, গদাধর একটা প্রকাণ্ড গদা কাঁধে নিয়ে নদীর পাড়ে এসে গর্জাচ্ছেন—কই শূলাে, কোথায় শূলাে? তারপর খবর পেয়ে শূলপাণিও এলেন, হাতে মস্তো শূল। মুখে বিকট হুঙ্কার। গদাধর করছেন সঁত কড়মড়। বাচ্চা নদী ভয়ে চুপ। আকাশে 

নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-২০

মেঘমেঘালি চোখ বুজেছেবাতাস বইছে না। গাছগাছালির ঠোটে আঙল। পাখপাখালি ডাকছে নাশূলপাণি শূল নেড়ে হাঁকেন চলে আয়, দেখাচ্ছি মজা। গদাধর গদা ঘুরিয়ে ধুলাে উড়িয়ে ডাকেন—চলে আয়, দেখাচ্ছি মজা। 

তারপর রাগের চোটে শূলপাণি ছােড়েন শূল, গদাধর গদা। আর, কোথেকে একটা চিল এসে ছোঁ মেরে শূল নিয়ে পালায়কোথেকে কোলাব্যাঙ এসে গদা নিয়ে ভুস করে ডুব মারেচিল আর একটা কোলাব্যাঙের স্বভাবই এই। ক্ষীর নদীর কূলে মাছ ধরতে গিয়ে খােকনের হয়েছিল একই অবস্থা। 

তাে অস্ত্র নেইযুদ্ধটা হবে কিসে? তার চেয়ে বড় কথা, যুদ্ধশাস্ত্রে আছে : কদাপি নিরস্ত্রকে বধ করিবে না। মহা পাপ হয়তাই ভেবে চিন্তে গদাধর বললেন—আয় রে শুলো, সন্ধি করি। শূল পাণিও অগত্যা বললেনতাই হােকসন্ধি। 

এই সন্ধির ফলে দুই পাড়ের লােকেরা পেটপুরে ভােজ খেতে পেয়েছিল। সে কী ভােজ ! ভগল; ধােপা দূরের গায়ে জামাইবাড়ি গিয়ে গল্প করছিলএকশাে আটান্নরকম ব্যাঙের মুড়িঘণ্ট, টিকটিকির ডিমের ডালনা, তেঁতুলের আরকে মাখানাে তরমুজভাজা আর সরষেবাটা দিয়ে গুগলির চোখআর শূলােবাবু বস্তাবস্তা হজমিগুলিও বিলিয়েছিলেন। তাতে নাড়; ডাক্তার খাপ্পা। একদিনেই কত রুগী পাওয়া যেতসব হাতছাড়া হয়ে গেল কি না।— 

এবার বলি এই সেদিন যে বিবাদটা হয়েছে, তার কথাবিবাদ কিন্তু আরও সাংঘাতিকএত সাংঘাতিক যে আর কখনও দুজনের ভাব হবে বলে মনেই হয় নাতবে এই প্রচণ্ড ব্যাপারটার পিছনে যেটুকু আছে, না বললে কি বােঝা যাবে না। 

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক শেষ খন্ড

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *