গত বর্ষায় হল কী, এক সন্ধেবেলা উরুলিঝুরুলি বৃষ্টি পড়ছে। শূলপাণি উদাস হয়ে বসে আছেন ঘরে। নদীর ধারে যাওয়া হল না। গদাধরের সঙ্গে কথাবার্তা হল না। মন খারাপ। এমন সময় হঠাৎ শূলপাণির কানে এল কুঁই কুঁই শব্দ। বাড়ির পিছন থেকে
শব্দটা আসছে। ওদিকটায় একসময় আস্তাবল ছিল। এখন ভাঙ্গাচোরা দশা তাে ছাতি মাথায় শূলপাণি সেখানে গিয়ে দেখেন কী, চারঠ্যাংওয়ালা এটুকুন একটা প্রাণী কুঁইকুই করে কঁদছে। এটা যখন আস্তাবল, তখন প্রাণীটা ঘােড়ার বাচ্চা ছাড়া আর কী হতে পারে। দয়াল; শূলপাণি ওটাকে নিয়ে এলেন। আহা, কতকাল আর ঘােড়ায় চাপা হয় না। পুষে ফেলে একে বড় করতে পারলে কাজে লাগবে ।
কিছুদিন পরে এসেছে হটুরু গয়লা দুধ দিতে। বাবুমশাই চারঠেঙা টাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন দেখে সে ভাবল, বাবুমশায়ের আদরের জিনিসটার একটু প্রশংসা করা উচিত। সে বলল-বাবু মশাই, আপনার কোলে যেন সূয্যি উঠেছে গাে! আহা হা, দেখলে চক্ষু জুড়ােয়।
শূলপাণি সগর্বে বললেন—দেখছিস কী হটুরু! এ আমার পক্ষিরাজের বাচ্চায়ে!
হটুরু হেঁট হয়ে আঙুল তুলে বলল—তাই বটে! ওই দুটো বুঝি ডান বাবুমশাই ?
নিঝুম রাতের আতঙ্ক শেষ খন্ড
-আঁা। শূলপাণি ধাধায় পড়ে গেলেন। মাথার দুপাশে এই যে দুটো চ্যাপ্টা লম্বা পাতলা জিনিসকে কান ভেবেছিলেন। শূলপাণি বললেন—তাই মনে হচ্ছে নাকি হটুরু?
-হুউ। ডানাই হবে—বলে ধূর্ত হটুরু কেটে পড়ল। সেদিন দুধে দিয়েছে অচেল জল। তাই শূলপাণিকে খুশি করতে চেয়েছিল।
কিন্তু শূলপাণির এই স্বভাব। যা মাথায় ঢুকবে, সহজে বেরুবে । রােজ প্রাণীটার মাথার দুপাশে ওই চ্যাপ্টা পাতলা জিনিস দুটোকে সর্ষের তেল দিয়ে ডলাইমলাই করেন। শিগগির-শিগগির বাড়ুক। শূলপাণি তবে না রাজপুত্তরটি হয়ে কোমরে তরােয়াল ঝুলিয়ে তেপান্তরমুখখা উড়বেন। | শূলপাণির চাকর বেচুরাম একদিন আর থাকতে পারল না। বলল –কর্তামশাই, ভয়ে বলি কী নির্ভয়ে ? শূলপাণি একগাল হেসে অভয় দিলেন।—নির্ভয়ে বল বাবা বেচু।
–কর্তামশাই, এটা মনে হচ্ছে নেড়ি কুকুর। —কী বললি, কী বললি? —আজ্ঞে, ঘােড়া হলে তাে চিহি করত।
তাও তাে বটে। শূলপাণি একটু ভেবে বললেন—হু, শেখানাে হয়নি, তাই চিহি করছে না। ঠিক আছে। তুই আমাদের পণ্ডিত মশাইকে ডেকে আন্ এক্ষুণি।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক শেষ খন্ড
খবর পেয়ে পণ্ডিতমশাই এলেন। চোখে ভাল দেখেন না। নাকের ডগায় চশমা পিছলে যায়। সুতাে দিয়ে টেনে রাখেন। দেখে শুনে বললেন—উহু, চিহি বলে কোন ভাষা নেই। তবে হ্রেষা নামে ভাষা আছে, তারই ব্যাকরণের নাম চিহিকরণ। বাবা শূলে, তােমার এই পক্ষিরাজশাবকের হ্রেষাশিক্ষার ভার আমি নিলুম। ভেবাে না, কত গাধা ঠেঙিয়ে ঘােড় করলাম। আর এতে ঘােড়া হয়েই আছে। কিন্তু ওর একটা নাম চাই যে। ছাত্রদের হাজিরা খাতায় লিখতে হবে তাে ! বলে পণ্ডিতমশাই প্রাণীটাকে চারপাশে ঘুরে–ঘুরে দেখে নিয়ে বললেন-ওর কান দুটো দেখছি বেজায় লম্বা। তাই নাম দিলাম লম্বকর্ণ ।
শূলপাণি বলতে যাচ্ছিলেন, ওদুটো কান নয়—ডানা, বলার সুযােগ পেলেন না। পণ্ডিতমশাই আদরের পড়ুয়াটিকে বগলদাবা করে প্রায় দৌড়চ্ছেন। পাঠশালায় ঘুঘু চরছিল। যাক্ গে, একটা ছাত্র তাে পাওয়া গেছে।
ওদিকে নদীর ওপাড়ে গদাধর এসব খবর পেয়েছেন। পেয়ে চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। শূলে। তঁাকে টেক্কা দেবে যে! এপাড়ের লােকের কাছে মাথা হেঁট হয়ে যাবে না বুঝি ? তাই ঠিক করলেন, শূলপাণি যখন পক্ষিরাজের বাচ্চা পুষেছেন, তখন তিনি পুষবেন হাতির বাচ্চা। কিন্তু পক্ষিরাজ তাে ওড়ে, হাতি কি ওড়ে ? গদাধর একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন।
Read More