রাস্তাটা ডাইনে ঘুরছে এবার। সামনে গেট দেখা যাচ্ছে। তার ওপাশে বাংলো মতাে একটা বাড়ি। গেটের কাছাকাছি যেতেই ভবভূতি দেখলেন, আচমকা কী একটা ঢ্যাঙা লিকলিকে মূর্তি সটান ঝােপ ঠেলে রাস্তায় এল এবং তাঁদের সামনে একটু তফাতে সঁাড়িয়ে, গেল। ভবভূতি ফিসফিস করে উঠলেন—গজু। ওটা কী ?
গজপতি দাড়িয়ে গেছেন। তেমনি ফিসফিসিয়ে বললেন-এই সেরেছে। কিছু খাবার আনা উচিত ছিল। তাই তাে ! অন্তত একটুখানি শুকনাে গােবর •••
মুখের কথা মুখেই থাকল গজপতির, সেই মূর্তিটা হি হি হি হি করে বেজায় হেসে উঠল। ভবভূতি বিড়বিড় করতে থাকলেন—ট্রাম, ট্রাম ট্রাম ট্রাম•••
তারপর টের পেলেন রামের বদলে ট্রাম বলছেন। তারপর শুধরে। নিয়ে রামনাম শুরু করলেন। আর গজপতি বিকট চেঁচিয়ে আর্তনাদের সুরে বলে উঠলেন—ও ভূতো-ও-ও, ভূতত রে-এ-এ! তাের কী একটা ট্যাঙা লিকলিকে মূর্তি সটান ঝোপ ঠেলে ঘটোৎকচকে সামলে নে। বেরিয়ে পড়েছে-এ-এ।
বাংলাে বাড়ি থেকে আলাে হাতে বেরিয়ে কে সাড়া দিল—কোন্ বেটারে ? নাম ধরে ডাকছিস! স্পর্ধা তাে কম নয়।গজপতি বললেন—বাবা ভূতাে, আমি–আমি। তাের মামা ২ গজপতি।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৩
আলো হাতে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল একটা লােক। তাকে দেখে রাস্তা আটকে দাঁড়ানাে সেই মূর্তিটা একলাফে ঝােপঝাড় ডিঙিয়ে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আচমকা যেন ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল । গজপতি ফিসফিস করে জানালেন—পাহাড়ী দেশের ভূত, বুঝলে তাে? তারপর ভবভূতির হাত ধরে পা বাড়িয়ে বললেন-বাবা ভূতাে, তােকে খবর দিয়ে আসতে পারিনি। এদিকে ট্রেনটাও. লেট করেছিল।
গেট খুলে ডঃ ভূতনাথ বললেন –মামা নাকি ? আসুন, আসুন । কী সৌভাগ্য। উনি কে? আমার বন্ধু ভবভূতি পতিতুণ্ডু। তােকে এনার কথা বলেছি, মনে নেই হয়তাে। ইনি একসময় নামকরা শিকারী ছিলেন। আর ভবভূতি, এ হচ্ছে সেই ডঃ ভূতনাথ পাত্র। ডঃ ভূতনাথ নমস্কার করে বললেন–আসুন, আসুন! কী সৌভাগ্য!•••
বাংলোঘরের মধ্যে একটা হ্যাজাগ জ্বলছে। লণ্ঠনটা দম কমিয়ে বারান্দায় রেখে ডঃ ভূতনাথ ওঁদের নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। কোনার টেবিলে একটা কালাে বেঁটে মােটাসােটা হাঁড়িমুখাে লােক খাতায় কী সব লেখালেখি করছিল। একবার মুখ তুলে দেখল। ভবভূতির গা। শিরশির করে উঠল লােকটাকে দেখে। মানুষ বটে তাে? কেমন যেন ভুতুড়ে চেহারা।
পাশের ঘরের দরজা খুলে ডঃ ভূতনাথ বললেন—এক মিনিট। মােমবাতিটা জ্বেলে নিই। ভবভূতি বললেন-লোডশেডিং বুঝি ?
–না। এখানে ইলেকট্রিসিটির বালাই নেই। কেন নেই, পরে, বলব’খন •••বলে ডঃ ভূতনাথ মােমবাতি জ্বেলে দিলেন। ডাকলেন আসুন মামা। আপনারা ভেতরে এসে বসুন। আমি চায়ের যােগাড়।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৩
ঘরটা বেশ বড়। ভবভূতি ও গজপতি আরাম করে বসলেন। ডঃ ভূতনাথ বাইরে চলে গেলেন। বাইরে তার গলা শােনা গেল। কাকে ডাকাডাকি করছেন।
গজপতি বললেন—ইলেকট্রিসিটি কেন নেই জানাে? ভূতদের , ওই আলাে সয় না। লণ্ঠন, হাসাগ অব্দি বড়জোর সয়। ওই ইলেকট্রিসিটির জ্বালায় তাে ভূতবংশ লােপ পেতে বসেছে। | ভবভূতি দমে গেছেন এখন। সায় দিয়ে মাথাটা নাড়লেন শুধু। তারপর বারবার জানলার দিকে তাকাতে থাকলেন।
বলা যায় না, . কখন কী বিতিকিচ্ছিরি ভুতুড়ে চেহারা জানলায় উকি দিয়ে ওইরকম একখানা পিলে চমকানাে হাসি হাসবে হয়তাে। মনে হচ্ছে, রাইফেলটা আনলে ভাল হত। কিন্তু রাইফেল কি এরা ছুড়তে দিত? তার চেয়ে বড় কথা রাইফেলের গুলি ভূতের গায়ে লাগত কি না তাই বা কে জানে। কখনও তাে পরীক্ষার সুযােগ। পাননি।•••
কিছুক্ষণ পরে চা খেতে–খেতে ভবভূতি এই অভয়ারণ্যের ভাত বৃত্তান্ত বেশ মনোেযােগ দিয়ে শুনছিলেন।
গজপতির ভাগ্নে ডঃ ভূতনাথ পাত্র অমায়িক মানুষ। বােগা সিড়িঙে চেহারা। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। চুলগুলো ঘােট এবং সজারুর কাটার মতাে খাড়া। গোঁফটাও তাই। এই শরতের ভ্যাপসা গরমেও স্যুট-টাই পরে আছেন। গজপতির চোখ নাচছে অনবরত। যেন বলতে চাইছেন, দেখছ তাে-আমি কেমন ভাগ্নের মামা ? ভাগ্নে, পাক্কা সায়েব।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৩
ডঃ ভূতনাথ বলেছিলেন-আপনি তাে শিকারী মিঃ পতিতুণ্ডু।
আপনি ব্যাপাটা বুঝবেন ভাল । আপনার যেমন বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বাঘের ব্যাপারে তীব্র কৌতূহল ছিল বললেন—আমারও ছেলেবেলা থেকে ভূতের ব্যাপারে ভীষণ আগ্রহ ছিল। যাই হােক, হঠাৎ একদিন কাগজে দেখলুম মেকসিকো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূততত্ত্বে এ গবেষণার জন্যে সেখানকার সরকার বৃত্তি দিচ্ছেন। অমনি কপাল ঠুকে
দরখাস্ত করে দিলুম। ইন্টারভিউয়ে ডাক পড়ল। পাস করে গেলুম । তারপর তাে দেখতেই পাচ্ছেন। শুনেও থাকবেন।
সাগ্রহে ভবভূতি বললেন—শুনেছি। কিন্তু এই প্রকল্পে কীভাবে ভূত এনে জড়াে করেছ, সেই কথা বলাে তাে বাবা, শুনি। | ডঃ ভূতনাথ একটু হেসে বললেন—সে অনেক হাঙ্গামা। কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হয়েছিল—কেউ কোথাও ভূতের খোঁজ পেলে জানান পুরস্কৃত করা হবে। বিস্তর চিঠি এসেও ছিল।
কিন্তু বেশির ভাগ জায়গায় গিয়ে দেখি, মিথ্যে ভােগাচ্ছে। তবে কিছু জায়গায়—যেমন ধরুন, কলকাতার পুরনাে কয়েকটা বাড়ির ছাদ, চিলেকোঠা, সিড়ি হাতড়ে তিন রকম প্রজাতির ভূত পেয়েছিলুম। এরা সবাই কিন্তু মানুষ ভূত। কেউ আত্মহত্যা করে ভূত হয়েছে। কেউ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কেউ খুন হয়ে মরেছে।
গজপতি বললেন—ভালভাবে না বােঝালে ভবভূতি বুঝতে পারবে না।
—তাহলে শুনুন। ভূতজাতি মূলত তিনটি উপজাতিতে বিভক্ত। মানুষভূত অর্থাৎ যাকে বলা হয় প্রেত। আর প্রকৃত ভূত-যারা মানুষ বা কোন জন্তুর অশরীরী আত্ম নয়। স্রেফ ভূত।
Read More