তৃতীয় উপজাতি হচ্ছে প্রাণীজ ভূত অর্থাৎ মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণী মরে যে ভূতের জন্ম। যেমন ধরুন, গরু মরে যে ভূত হয়েছে, তার নাম ‘গােদানাে’।
ভবভূতি আরও কৌতূহলী হয়ে বললেন—সবরকম ভূতই তাে এখানে রয়েছে ?
ভূতনাথ বললেন—হুউ । তবে সবসময় দেখা পাওয়া মুশকিল। আপনি তত সুন্দরবন অভয়ারণ্যে গেছেন। কবার বাঘ দেখতে পেয়েছেন, বলুন?
ভবভূতি সায় দিয়ে বললেন—তা ঠিক। তবে ওরা একটা টাওয়ার বানিয়ে রেখেছে জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে গিয়ে
বাধা দিয়ে ডঃ ভূতনাথ বললেন—এখানেও বানিয়েছি আমরা। নিয়ে যাব আপনাদের। তবে সাবধান, কথা বলবেন না কিন্তু । চুপচাপ বসে থাকতে হবে।
ভবভূতি বললেন-আমি শিকারী। ও কি নতুন কথা আমার কাছে?
শুনুন গ্রামাঞ্চলে কীভাবে ভূত খুজে এনেছি। গ্রামে খবরের কাগজ ক’জন পড়ে ? তাই ট্যাড়া পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়াও হয়েছিল। তার ফলে অসংখ্য জায়গা থেকে নানারকম ভূতের খোঁজ পাওয়া গেল। যেমন ধরুন, বীরভূমের একটা দিঘির এক কোনায় শাকচুন্নীর খোঁজ পেলুম। তক্ষুণি বেরিয়ে পড়লুম। কিন্তু ওদের ধরে আনলে কীভাবে?
ডঃ ভূতনাথ একটু হেসে বললেন—খুবই সােজা, খুবই সােজা। শুধু জানতে হয়, কোন প্রজাতির ভূতের কী খাদ্য। ব্যস! বীরভূমের সেই শাকচুন্নীর আড্ডায় একরাত্রি গিয়ে বসে রইলাম। ওর প্রধান খাদ্য মাছ। মাছ দেখে তক্ষুণি ওর নােলায় জল ঝরতে লাগল। ঘােমটার ফঁাকে বলল—একটা মাছ দেন ভাই।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৪
আমি অমনি উঠে চলতে শুরু করলুম। সারাপথ ও পেছনে চাইতে চাইতে আসে, আর আমি বলি—আর একটু গিয়ে দেব, চলে আয়। ব্যস! এই করে এখানে নিয়ে এলুম। এখানে পুকুর বানিয়ে অঢেল মাছ ছেড়েছি। শাকচুন্নীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যা খাবার খাচ্ছে। বাকিটা আমরা কলকাতায় চালান দিচ্ছি।
এই শুনে গজপতি মন্তব্য করলেন—সেইসব মাছই তাে কলকাতার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্বাদেই বােঝা যায়। শাকচুন্নীরা শুকে ফেলে দেয়, তাই ওরকম। বুঝলে তাে ? ভবভূতি বললেন—আচ্ছা বাবা ভূতনাথ ! দুধ, রসগােল্লা, পাকা কল। এসব সুখাদ্য কোন্ ভূত খায় ? ভূত নয় ভূতিনী বলুন। এর প্রেত উপজাতির অন্তর্গত। অর্থাৎ কোন পেটুক মেয়ে মরে ভূত হয়েছে।
যেই কথাটা বলা, অমনি জানলার বাইরে থেকে খ্যানখেনে গলায় কে বলে উঠল কী, কী কী বঁললি? শুধু মেয়েরাই ওসব খায় ?
ভবভূতি আঁতকে উঠে দেখলেন—নির্ঘাৎ ভূতিনীই বটে, চুলের যা ছিরি—তার পরনে শাড়ি, কতরকম গয়নাও পরা, জানালায় মাড়িয়ে চোখ কটকটিয়ে তাকিয়ে আছে।
ডঃ ভূতনাথ ধমক দিয়ে বললেন—পেঁচোর মা ! এখন চলে যাও তাে এখান থেকে। আমরা কথা বলছি, দেখছ না? কিছু বলার থাকলে পরে এসাে। না হয়, দরখাস্ত কোরাে।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৪
ভুতিনী জিভ বের করে, কেন কে জানে ভবভূতির দিকেই ভেংচি কেটে সরে গেল। গজপতি খিকখিক করে হেসে বললেন—পেঁচোর মা সেবার আমাকে বাগবাজারের রসগােল্লা আনতে বলেছিল। ভুলে গেছে নিজেই।
-পেঁচোর মা! মানে? ভবভূতি জিজ্ঞেস করলেন।
জবাবটা দিলেন ডঃ ভূতনাথ।-ওর ছেলে পেঁচোও যে ভূত। তার মানে, প্রেত। ট্রেনে চাপা পড়ে মারা গেছে।
ভবভূতি বললেন–আচ্ছা বাবা ভূতনাথ, এত যে ভূত রেখেছ ‘অভয়ারণ্যে, তুমি কিংবা তােমার কর্মচারীরা কেউ কখনও বিপদে পড়ােনি তাে ?
ডঃ ভূতনাথ বললেন-নাঃ। বুঝতে পারছেন না? বেছে বেছে কর্মচারী রাখা হয়েছে। রীতিমতাে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। ভূত নিয়ে কাজ করা তাে সহজ নয়।
এই সময় ভবভূতির মনে হল তাঁর পাঞ্জাবির পকেটে কী যেন ঢুকেছে। ঘুরেই আঁতকে উঠলেন। চেয়ারের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে একটা বছর নয়–দশ বয়সের ছেলে-কিন্তু সত্যি কি ছেলে?
তঁার পকেটে একটা কালাে কুচকুচে লিকলিকে হাত ঢুকিয়ে – হাতড়াচ্ছে। ভবভূতি কাপতে কাঁপতে বললেন,কে, কে ?
ডঃ ভূতনাথ ধমক দিলেন—অ্যাই পেঁচো ! কী হচ্ছে ? শ্ৰীমান পেঁচো বলল—কোলেট খুজছি ভূতুমামা! হাত বের কর বলছি। বের করে নে হাত! ডঃ ভূতনাথ উঠে দাঁড়ালেন। ছিঃ ! ওই নােংরা হাত তুই কোন্ আক্কেলে পকেটে ঢােকালি ? মুখে চাইলেই পারতিস।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৪
পেঁচো হি হি করে হেসে হাত বের করে নিল। তারপর চেয়ারের। পেছন থেকে উঠে দাড়িয়ে ভবভূতির গলায় দুহাত আঁকড়ে আব্দেরে গলায় বলল—একটা ঊকোলেট দাও না দাদু। সেই সঙ্গে বেজায়, রকম কাতুকুতুও দিতে থাকল।
কী প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাত! ভবভূতির দম আটকে যাচ্ছে। ভয়ে কাপতে কাপতে গোঁ গোঁ করতে করতে শেষ পর্যন্ত তাের মতােই হি হি হি হি হি হি করে হেসে উঠলেন।
ভবভূতি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর উঠে বসলেন। দেখলেন নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। ঘরে সকালের রােদ ঢুকেছে। তার নাতি রুনু বলল-ও দাদু, এখনও ঘুমােচ্ছ তুমি ? আমি কখন উঠেছি।
ভবভূতি আগে ভালভাবে দেখে নিলেন রুনু, না পেঁচো। তারপর শুধু বললেন -হু।–ও দাদু, একটা চকোলেট দাও না। ভবভূতি চমকে উঠলেন। এও যে চকোলেট চায়। কিন্তু না, মনের ভুল। স্বপ্নই দেখছিলেন বটে। কাল সন্ধ্যায় গজপতির সঙ্গে ভাত নিয়ে বেজায় তর্ক হয়েছিল, মনে পড়ছে।
ডাকিনীতলার বুড়াে যখ আমাদের বাড়ির পিছনে একটা বাগান, তারপর ধূ–ধূ মাঠ। মাঠের মধ্যিখানে ছিল একটা বটগাছ। গায়ের লােক বলত ডাকিনীতলা।
নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-৪
ডাকিনীতলা, তার মানে ওই ধূ-ধূ তেপান্তরের একলা পঁাড়ানাে বটগাছটার দিকে দুপুরবেলা তাকিয়ে থাকতুম যদি ডাকিনীটাকে দেখতে পাওয়া যায়। রােদ্দর চনমন করত মাঠে। জন নেই মানুষ নেই। খা খা চারদিক। কথায় বলে, “ঠিকঠাক দুকর বেলা, ভতপেরেেেত মারে ঢেলা।
দুপুরবেলায় ভূতপ্রেত–ডাকিনীরা পাড়া গায়ের গাছগুলিতে ওঁৎ পেতে থাকে কিনা। একলা দোকল। গাছতলায় যেই গেছ, টুপটাপ ঢিল পড়বে গায়ে। ঢিলও দেখতে পাবে না তুমি, কে ঢিল ছুড়ল তাকেও দেখবে না। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি ।
অতদুর থেকে একটা ছােট্ট ছেলেকে ডাকিনীতলার গেছে ডাকিনী ঢিল ছুড়ে মারবে, সেই গায়ের জোর ডাকিনীটার নিশ্চয় ছিল না। বটতলায় গেলে তাে?
কিন্তু ওরা নাকি সবই দেখতে পায়। যতদূরেই থাকো, চোখে পড়বেই। একদিন হয়েছে কী, দুপুরবেলা রােজ যেমন বাগানের ধারে দাড়িয়ে দুরে ডাকিনীতলার দিকে তাকিয়ে থাকি—সেই রকম তাকিয়ে আছি, হঠাৎ চোখ পড়ল হাজরা–মশায়ের ছেলে নীলু হাফপেন্টল পরে খালি গায়ে মাঠের দিকে চলছে।
নীলু আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। ক্লাসের সবচেয়ে ভীতু ছেলে—আবার তেমনি বেহদ্দ গােবেচারা। তাই তাকে অমন হনহন করে ডাকিনী তলার দিকে যেতে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলুম। এই রে! নির্ঘাৎ ও মরবে।
Read More