হিম আগুন-সমরেশ মজুমদার

হিম আগুন-সমরেশ মজুমদার

গত কয়েকদিনের মধ্যে গত রাতেই বোধহয় ঠান্ডাটা কট্টর ছিল। আজ বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না। জানালার কাঁচ খোলা, বাইরের পৃথিবীটা আড়ালে। কিন্তু যেহেতু ঘড়ি বলছে এখন সকাল দশটা তাই অস্বস্তি শুরু হল। ঠিক এই মুহূর্তে যদি ঘড়িতে সময় সাড়ে ছয় বা সাত থাকত তাহলে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম। যেই জানলাম বেলা বেশ হয়ে গেছে অমনি শরীরের অন্য প্রয়োজনগুলো প্রকট হল, টয়লেটে ছুটতেই হবে যখন তখন বিছানা ছেড়ে উপায় কী।

মিনিট পনেরো বাদে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা নিয়ে দরজা খুলে আবার কাঠের বারান্দায়। এসে দাঁড়ালাম। পাহাড় তো বটেই, সামনের রাস্তাটাও কুয়াশায় ঢেকে গেছে। কাঠের বারান্দায় কুয়াশারা দাগ রেখে গেছে। ওখানে পড়ে থাকা বেতের চেয়ার এখন বেশ স্যাঁতসেঁতে। সেটায় বসে যে মগে আরাম করে চুমুক দেব তার উপায় নেই।

এখন আমার শরীরে যাবতীয় শীতবস্ত্র। এই এলাকাটা একেই বেশ নির্জন, তার ওপর শীত এবং কুয়াশা বাড়লে অথবা বৃষ্টি বাড়লে মনে হয় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। অনেক তল্লাশির পর এরকম জায়গা খুঁজে পেয়েছি আমি।

চারপাশে তাকালাম। তাকাতেই মনে হয় এই মেঘ, কুয়াশা, ছায়ায় সময় যেন বেড়ে ওঠার আগেই ফুরিয়ে যায়। হঠাৎ আলো নিভল অন্ধকার জানান দিল আর বোঝা গেল এখন রাত। তার আগে কখন যে দুপুর-বিকেল গলে গেল তা টেরই পাওয়া যায় না।

খুব কাছের বাড়িটা মিনিট আটেক দূরে। এই রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে। একজন প্রাক্তন নাবিক থাকেন সেখানে। ভদ্রলোক অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক হল। তার ছয়মাস আগে বিয়ে করেছিলেন একজন গোয়ানিজ মহিলাকে। এটি ওঁর তৃতীয় বিয়ে। এই বিয়ের পর তাঁর প্রথম দু-পক্ষের সন্তানরা সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। ওই গোয়ানিজ মহিলাও এতদিন স্বামীর কাছে আসেননি। শেষপর্যন্ত পদার্পণ করেছেন মাস দুয়েক হল। প্রায় তিরিশ বছর পরে জন্মানো স্ত্রী বাড়িতে আসার পর নাবিক ভদ্রলোককে খুব কমই বাড়ির বাইরে দেখা যায়। ভদ্রমহিলার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। নইলে রোজ দু-বেলা সমুদ্রের গর্জন শুনতে হত পাহাড়ে বসে।

আমার এই বাড়ি থেকে বাজার পাক্কা এক মাইলের পাহাড়ি পথ। ওখানটা বেশ জমজমাট। বাস টার্মিনাল, সিনেমা হল, দোকানপাট-বাজারগুলো যেমন হয় আর কী। সপ্তাহে একদিন যেতে হয় আমাকে। সাতদিনের খাবার, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, সিগারেট, ওষুধ দিনে এক মাইল। পাহাড়ি পথ ভাঙতে ইচ্ছে হয় না বলেই ট্যাক্সি নিই। এক মাইলের জন্যে তিরিশ টাকা চাইলে ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না। এরকম নির্জনে জোরে কথা বলাও ঠিক নয়। এই বেশ আছি। চা শেষ করলাম আমি। বারান্দার আর এক কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখন থেকে সূর্য ঠিকঠাক আলো ফেললে, বরফের চূড়াগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু আজ তার সুযোগ নেই। বাজারের হোটেল থেকে বাড়ির খোঁজ করতেই একজন সন্ধান দিয়েছিল। যাঁর বাড়ি তিনি থাকেন সমতলের শহরে। বছরে দিন-সাতেকের জন্যে এখানে আসেন ছুটি কাটাতে। শর্ত হল, তিনি যখন আসবেন তখন তাঁকে বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। দিন-সাতেকের জন্যে এই শর্ত মেনে নিয়েছি। ইতিমধ্যে একটি বছর কেটেছে আর ভদ্রলোক সস্ত্রীক ঠিক সাতটা দিন এখানে থেকেছিলেন। ওই সময় আমি চলে গিয়েছিলাম পাহাড়ের ওপরের ফরেস্ট বাংলোয়। পরিবর্তনটা মন্দ লাগেনি। ফিরে এসে দেখলাম আমার যাবতীয় জিনিস ঠিকঠাক রয়েছে, ওঁরা সেগুলো স্পর্শ করেননি। উলটে বাড়িটাকে আরও একটু পরিচ্ছন্ন করে গেছেন।

অথচ টিঙ্কু যখন পাশে ছিল তখন এরকম জীবনের কথা ভাবতেই পারতাম না। সকালে ঘুম ভাঙার পর যে হইচই শুরু হত তার শেষ মাঝরাতে ঘুম এল। অবশ্য সন্ধেটা ছিল ওর, আমার নয়।

ওসব কথা আজকাল মনে করতে চাই না। কিন্তু এই না চাওয়ার সঙ্গে মনের কিছুতেই বনিবনা হয় না। যেমন এখন চারপাশে কুয়াশার দেওয়াল আর হাতে শূন্য চায়ের মগ নিয়ে টিঙ্কুর মুখ। ভেসে উঠল। টিঙ্কু গাইত প্রচুর হিন্দি আর কিছু হিট বাংলা গান। শুধু একটা রবীন্দ্রনাথের গান ওর মুখে শুনতে পেতাম। তাও যখন অন্ধকার করে মেঘ ঘনিয়ে বিকেল হওয়ার আগেই সন্ধে নামত। তখনই। টিঙ্কু গাইত, মেঘের পরে মেঘ জমেছে–। কুয়াশারা মেঘ নয়, তবুও এখন ওদের মেঘ। বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে।

ঘরে ফিরে গিয়ে বেসিনে মগ রাখলাম। এখন কল খুলে ওটাকে ধোওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। দুপুরে নিশ্চয়ই ঠান্ডাটা কমবে।

গত সপ্তাহে বাজারে মাছ আসেনি। এখানে খাসির মাংস পাওয়া যায় মাঝে-মাঝে, চিকেন প্রচুর আর বিফ বেশ সস্তা।

চিকেন বা বিফের থেকে পাঁঠা বা খাসির মাংসের ওপর আমার একটু টান আছে। সেদিন শুনেছিলাম আজ খাবার দোকানে খাসি কাটা হবে। একবার ঘুরে আসা যাক। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে অন্যরকমের আরাম হয়।

জিনস, জ্যাকেট, মাফলার, জর্থাস্টার আর মাথায় পাগড়ি টুপি, কাঁধে লম্বা স্ট্রাইপের ব্যাগ, হাঁটতে-হাঁটতে হেসে ফেললাম। এখন তাকে মাছ বা খাসির মাংস নিয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে। টিঙ্কু শুনলে হেসে গড়িয়ে পড়ত। যে লোকটাকে কাজে লাগাতে তাবড়-বড় রুই কাতলারা দিনরাত পেছনে লেগে থাকত, মৃত্যুকে উপেক্ষা করে বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে যে প্রবলভাবে বেঁচে থাকত, সেই মানুষ কী করে কষা মাংস রাঁধবে তা নিয়ে ভেবে কূল পায় না, তখন তো হাসি পাবেই। কিন্তু সত্যি বলতে কি এসব নিয়ে থাকতে আবার মন্দ লাগছে না। এর ভেতরেও একটা অন্যরকমের আনন্দ আছে যা আমি আগে জানতাম না।

মোড় ঘুরতেই বাড়িটার দিকে তাকাতে প্রাক্তন নাবিককে দেখতে পেলাম। এই ঠান্ডায় একটা লম্বা ঝাঁটা দিয়ে বারান্দা পরিষ্কার করছে। দেখাদেখি হতেই বলল, হা-ই।

আমি দাঁড়ালাম, আপনার কী হয়েছে?

নাবিক বলল, কেন? আই অ্যাম ফাইন।

তাহলে অনেকদিন আপনার দেখা পাইনি কেন? চিৎকার করে বলতে হল।

আমার স্ত্রী এসেছেন, বুঝতেই পারছেন, সময় দিতে হচ্ছে। এসব বুঝবেন না।

এই সময় একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন, কেন?বুঝবেন না কেন? নির্বোধ নাকি?

মহিলার শরীরে ওভার কোট। মুখচোখ ভালোই ফরসা।

নাবিক নিচু গলায় কিছু বললেন। সম্ভবত আবার একা থাকার কথাই জানালেন। ভদ্রমহিলা কাঁধ নাচালেন এবং আমাকে শুনিয়ে বললেন, এরকম ভুল রসিকতা আমি একদম পছন্দ করি না।

ঠিক আছে। ঠিক আছে, আর বলব না। চটপট মেনে নিলেন নাবিক। আমার বেশ মজা লাগছিল। আচ্ছা, একেই কি স্ত্রৈণ বলে? ওঁকে আর বিরক্ত না করার জন্যে বললাম, আচ্ছা, চলি। পরে দেখা হবে।

হ্যাঁ। কিন্তু কবে দেখা হবে তা আপনাকে বলতে পারছি না।

কেন? অবাক হলাম।

অসুবিধে আছে।

মনে হচ্ছে আপনার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। ঠিক আগের মতো কথা বলতে পারছেন না। আমি হাত নাড়লাম।

হঠাৎ ভদ্রমহিলা গলা তুললেন, এক্সকিউজ মি, দয়া করে একটু কাছাকাছি আসবেন? বেশ মজা লাগছিল। বাড়ির সামনে পৌঁছলে মহিলা বললেন, আপনি যখন আমাদের প্রতিবেশী তখন নিশ্চয়ই আমার পরিচয় জানেন! যদি না জানেন তাহলে জানিয়ে দিচ্ছি, এই ভদ্রলোক আমার স্বামী।

আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম।

ধন্যবাদ। আপনি বললেন এই ভদ্রলোক ঠিক আগের মতো কথা বলছেন না। তার মানে হল, আমি এখানে আসার পর ওঁর কথা বলার ধরন বদলে গেছে। রাইট?

হ্যাঁ, আপনি এখানে আসার আগে উনি দু-বেলা আমার ওখানে যেতেন–গল্প…।

বাধা দিলেন মহিলা, বিশ্বাস করছিনা। উনি গল্প করতে জানেন না। তার থেকে বলুন, উনি একাই কথা বলে যেতেন, আপনার কথা শুনতে চাইতেন না। কারেক্ট? আমি এসে কিছু ডিসিপ্লিন এনেছি। উনি দিনের মধ্যে এক ঘণ্টা যা ইচ্ছে বলে যেতে পারেন কিন্তু বাকি তেইশ ঘণ্টা মুখ বন্ধ রাখতে হবে। আজ যে কথাগুলো বলেছেন তা ওই সময়ের মধ্যে। অর্থাৎ আর পঞ্চাশ মিনিট পরে উনি মুখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য।

মাথা নাড়লাম। অভিনব ব্যাপার। এবার আমি চলি। দেরি হয়ে গেলে বাজারে কিছুই পাব না।

আই সি। আপনি বাজারে যাচ্ছেন! আমাকে দু-মিনিট সময় দেবেন?

বুঝতে পারলাম না।

আপনাকে তো গবেট বলে মনে হয় না। শরীর বেঁকিয়ে মহিলা ভেতরে চলে গেলেন। প্রাক্তন নাবিক খুকখুক করে হাসল। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, উনি আমার সঙ্গে যাবেন? কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে জানালো কিস্যু জানে না।

বললাম, আপনার তো এখন কথা বলার সময়, বলছেন না কেন?

মহিলা বেরিয়ে এলেন, অত্যন্ত হিসেবি। দশ মিনিট বলেছে, বাকি পঞ্চাশ মিনিট হাতে রেখে দিচ্ছে। চলুন।

পরনে জিনস, পুলওভার, মাথায় রুমাল বাঁধা, হাতে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন, যেখানে যা-যা করতে বলেছি করে রাখবে। কোনও অজুহাত শুনতে চাই না।

প্রাক্তন নাবিক ঘাড় নাড়লেন।

মিনিট দুয়েক চুপচাপ হাঁটলাম আমরা। চারপাশে কুয়াশা পাক খাচ্ছে। কিছু বলতে হয় তাই জিজ্ঞাসা করলাম, কুয়াশা আপনার কেমন লাগে?

ননা, নট অ্যাট অল। আপনার?

আমার বেশরহস্যময় মনে হয়।

থ্রিলার-ট্রিলার পড়ার অভ্যেস আছে?

না। ওটা এমনি-এমনি মনে আসে।

ব্যক্তিগত কথা বলা আমি পছন্দ করি না। এখন যেহেতু একসঙ্গে হাঁটছি তখন আপনার শখ আমার জানা দরকার। আমি জুলি।

নাম বললাম, শান্ত।

ওয়েল শান্ত, আমি শুনেছিলাম আপনি এখানে একা থাকেন।

ঠিকই শুনেছেন।

স্ত্রী কোথায়?

আসেননি। আমার জীবনে কেউ স্ত্রী হয়ে আসেননি।

কেন? আপনার কি কোনও গোলমাল আছে?

যাচাই করার সুযোগ হয়নি ম্যাডাম।

ও, ম্যাডাম বলার কী দরকার? জুলি বলবেন, বুঝলেন?

ঠিক আছে, মনে থাকবে।

তাহলে আপনি একা থাকেন। নিজেই নিজের সংসার চালান। কিন্তু আপনার বয়স তো চল্লিশের নিচে। এই বয়সেই কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে একলা থাকছেন, এর মধ্যেই প্রচুর টাকা রোজগার করেছেন, তাই না? জুলি জিজ্ঞাসা করলেন।

তেমন কিছু নয়। তবে যা পেয়েছি তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়েছে। বললাম। সেই টাকা যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন আবার পরিশ্রম করতে বেরুব।

হুম। খানিকটা হাঁটার পর জুলি জিজ্ঞাসা করলেন, একা থাকতে আপনার ভালো লাগে?

মন্দ লাগে না, শুধু এটুকু বলতে পারি।

আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন আমি নিশ্চয় তার থার্ড ওয়াইফ?

মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

এ ব্যাপারে উনি আপনার থেকে তিনগুণ সক্রিয় পুরুষ। আপনি নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবেন আমার থেকে এত বেশি বড় একটা লোককে কেন বিয়ে করলাম। জুলি তাকাল।

কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে একথা বলা আমি পছন্দ করি না।

রাইট! মাথা দোলালেন জুলি।

এখন এই রাস্তার দু-ধারে যেসব বাড়ি তার সবগুলো কাঠের। রাস্তার ওপর এখনও ফিনফিনে কুয়াশা। সামনেই বনবিভাগের দপ্তর, পূর্তদপ্তরের কার্যালয়। এর পরেই ডানদিকে ঘুরলেই। বাজার। বললাম, আমরা বাজারে পৌঁছে গিয়েছি।

আপনি কী কিনবেন? খুব দেরি হবে? জুলি দাঁড়ালেন।

মাংস। খুব নির্লিপ্ত গলায় বললাম।

অ। আমি ভেজিটেরিয়ান। এতটা পথ একা ফিরে যাওয়া বিরক্তিকর। আমরা কি ফেরার সময়টা ঠিক করে নিতে পারি? ঘড়ি দেখে বললাম, ঠিক আধঘণ্টা বাদে এখানে দেখা হতে পারে?

ওটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট করুন।

ঠিক আছে।

ভদ্রমহিলাকে সবজির বাজারের মুখে ছেড়ে দিয়ে মাংসের দোকানের সামনে পৌঁছে দেখলাম ওটা বন্ধ। ওপাশে কয়েকজন দিশি মুরগি নিয়ে বসে আছে কিন্তু তাদের চেহারা দেখে ইচ্ছে হল

নেওয়ার। ভিড় হয়েছে যে মাছওয়ালার সামনে সে একটা বিশাল বোয়াল কেটেছে। দেখলেই বোঝা যায় মাছটা তাজা। মাছওয়ালা অন্যদিনের থেকে বেশি দাম চাইছে বলে খদ্দেরদের সাথে ঝগড়া হচ্ছে।

ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে বললাম, দু-কিলো।

মাছওয়ালা বলল, দাম কম হবে না কিন্তু।

হাসলাম, ভালো জিনিসের দাম সবসময় বেশি হয়।

বলুন বলুন। আপনি যে হক কথাটা বললেন তা কেন এরা বুঝতে পারে না? চটপট দু-কেজি মাছ কেটে টুকরো করে পলিথিনের প্যাকেটে ভরে দিল মাছওয়ালা। দাম মিটিয়ে মশলার দোকান। থেকে কিছু মশলা কিনে নিলাম। দু-কেজি সলিড বোয়াল মাছ মাংসের চেয়ে কোনও অংশে খারাপ নয়। ছেলেবেলায় বাড়িতে বোয়াল মাছ ঢুকত না। কেউ খেত না। এখন ব্যাপারটাকে নেহাতই বোকামি বলে মনে হয়। এই শহরের একমাত্র বিলিতি মদের দোকানের সামনে চলে এসেছি। একটা বড় বোতল রাম কিনলাম। এখানে আসার পরে হুইস্কি থেকে রামে এসে। দেখলাম বেশ ভালো লাগছে। নিচে নেমে চায়ের দোকানে ঢুকে ডিমের পোচ আর টোস্টের অর্ডার দিয়ে বেঞ্চিতে বসলাম। দোকানে ভিড় নেই। নিচের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কুয়াশারা এখন পাহাড়ের মাথায় চলে গেছে। হালকা রোদ উঠেছে।

মহিলার নাম জুলি। প্রথম দর্শনে বুঝতে পারিনি কিন্তু রাস্তায় নামার পর বোঝা যাচ্ছিল ওর ফিগার অসম্ভব রকমের ভালো। কোনও-কোনও মহিলাকে ঈশ্বর তেমন মুখ-চোখ না দিয়ে শরীরটাকে নিখুঁত করে দেন। ইনি তাদের একজন। ডাবল বয়সের প্রাক্তন নাবিককে মহিলা বোকার মতো করে রেখেছেন। আচ্ছা এই নাবিক ভদ্রলোকের প্রথম স্ত্রী-র গল্প যা শুনেছি তাতে বোঝা যায় ওর মেজাজ খুব শান্ত ছিল। সমুদ্র থেকে ছুটি পেয়ে যখন বাড়ি ফিরত তখন খুব সেবাযত্ন করত। দ্বিতীয় পক্ষের বউটা নাকি একটু বোকাসোকা ছিল। অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব ছিল না। ভাবতেই হাসি পেল আমার। অজান্তেই শব্দ করে হাসলাম।

আপনাকে এই প্রথম হাসতে দেখলাম।

অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে ওপাশের টেবিলের দিকে তাকাতেই ভুলটা বুঝতে পারলাম। কথাটা তার উদ্দেশে নয়, ওখানে যারা বসে আছে তাদের একজন আর একজনকে বলছে। সঙ্গে-সঙ্গে টিঙ্কুর মুখ মনে এল, সারাক্ষণ এত গম্ভীর থাকা কেন? হাসতে পারো না?

কী করব বলো? আমার মুখটাই এইরকম। বলেছিলাম। তোমার সঙ্গে কথা বলে পারি না। টিঙ্কু সরে গিয়েছিল।

ওটা ওর স্বভাব ছিল। তোমার সঙ্গে হেঁটে তাল রাখতে পারি না, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে পারি না। অথচ অত না পেরেও এখন কেমন করে আমাকে অধিকার করে রয়ে গেছে।

খাবার এল। মন দিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম। এই সময় রেস্টুরেন্টের মালিক এসে সামনে বসল, গুড মর্নিং স্যার।

গুড মর্নিং।

আপনাকে অনেকদিন ধরে দেখছি, মাঝে-মাঝেই দোকানে আসেন কিন্তু গম্ভীর হয়ে থাকেন বলে বিরক্ত করিনি। আপনার নাম জানতে পারি?

শান্ত।

তাহলে ভুল হয়েছে।

মানে?

কাল বিকেলে দুজন লোক একজনের খোঁজ করছিল। তার চেহারার বর্ণনা আপনার সঙ্গে মেলে।

আচ্ছা!

ওরা কারা?

কখনও দেখিনি। মনে হয় এখানে প্রথম এসেছে। একটা নাম আর চেহারার বর্ণনা দিন। বলল লোকটা এখানেই থাকে। আমি আন্দাজের ওপর কথা বলি না। তা ছাড়া। দোকানদার কথা শেষ করবে কি না ভাবল।

একটু অপেক্ষা করে বললাম, বলুন।

মানে, লোকদুটোর চেহারা, কথা বলার ধরন ভালো নয়।

তাই? পার্স খুলে বেয়ারাকে ইশারায় ডাকলাম।

আমি বাজি রেখে বলতে পারি ওদের একজনের কোমরে রিভলভার গোঁজা ছিল।

কত হয়েছে জেনে নিয়ে দাম মিটিয়ে দোকানদারকে বললাম, খবরটা দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

এখানে আপনি কোথায় বাড়ি নিয়েছেন স্যার?

মাইল খানেক দূরে। চলি। দেখা হবে। মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

জুলির জন্য অপেক্ষা করছিলাম নির্দিষ্ট জায়গায়। কিন্তু দুশ্চিন্তাকে এড়াতে পারলাম না। এখানে কারা আবার আমার খোঁজে এসেছে যাদের কোমরে রিভলভার গোঁজা আছে? লোকগুলোর। চেহারা, কথা বলার ধরন দোকানদারের ভালো লাগেনি। কোনও ডিটেকটিভ এজেন্সির লোকজন। সাধারণত এরকম ধারণা মানুষের মনে তৈরি করবে না। তাহলে কি এরা স্রেফ ভাড়াটে গুন্ডা? কে পাঠাল ওদের আমায় খুঁজে বের করতে?

বেশ ছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কেউ যেন ঘরের পেছনে নিশ্বাস ফেলছে। তাহলে কি আমাকে গোপনে এখান থেকে চলে যেতে হবে? আচ্ছা লোকদুটো নিশ্চিত হয়ে কী করে বলল, আমি এখানেই থাকি? কে খবর দিল ওদের? আবার এমনও হতে পারে ওরা অন্য কারো খোঁজ নিতে এসেছে। চেহারায় মিলে যাওয়ায় দোকানদার ভুল করেছে। ওরা তোশান্ত নামটা ব্যবহার করেনি। যারা আমাকে খুঁজতে আসবে তারা নাম জিজ্ঞাসা করবে না? অবশ্য আসল নামটাকে আমি একটু ছোট করে নিয়েছি এখানে। তবে প্রশান্ত আর শান্তের মধ্যে তেমন কি ফারাক।

একটা গাড়ির আওয়াজ। কারা এল এবং সেইসঙ্গে মহিলা কণ্ঠে, উঠে পড়ুন চিৎকার। তাকিয়ে দেখলাম এখানকার বাজারে, যে গুটিকয়েক ট্যাক্সি রয়েছে তার একটাকে নিয়ে এসেছেন জুলি। আমাকে অবাক হতে দেখে পাশে পৌঁছে বললেন, আর হাঁটতে পারছি না। ওপর-নিচ করতে করতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। চলে আসুন।

দরজা খুলে মালপত্র নিয়ে মহিলার পাশে বসতেই ট্যাক্সি ছাড়ল। এত আওয়াজ হয় যে হর্ন বাজানোর দরকার পড়ে না।

কী-কী কিনলেন?

ওই যে বলেছিলাম। মাংস পেলাম না, মাংসের চেয়ে ভালো জিনিস পেয়ে গেলাম। বোয়াল মাছ। সেই সঙ্গে মশলা আর মদ। বললাম আমি।

আপনি রোজ মদ খান?

হ্যাঁ।

ভালো লাগে?

খারাপ লাগলে খেতাম না।

হুম। আমি এখানে আসার আগে এই নাবিক ভদ্রলোক আপনার বাড়িতে যেতেন?

হ্যাঁ। তাঁর মনের সব কথা উগরে দিতে আমাকে প্রয়োজন হত।

মদ খেত না?

না। কোন দ্বীপে কার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে মদ ছোঁবেন না।

সাত বছর সময়টা এখনও শেষ হয়নি।

কার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জানেন। আমার বাবার কাছে। আমার দিকে ছোঁকছোঁক করেছিল বলে বাবা শর্তটা দিয়েছিল। এমনিতেই এত বড়, তার ওপর মাতাল। কোনও বাবা রাজি হয়? বাবা আমাকে বলেছিল সারাজীবন মদ খাওয়ার পর সাত বছর না খেলে শরীর ভেঙে পড়তে বাধ্য। বার্ধক্য এসে যাবে চটপট। তখন আর আমাকে বিয়ের কথা ওর মাথায় থাকবে না। বলুন। তা বাবা মারা গেল দু-বছরের মধ্যে। ওর প্রতিজ্ঞা কিন্তু ভাঙল না। এই আত্মত্যাগ দেখে আমি মরলাম, বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম।

তারও পরে সাত বছরের প্রতিজ্ঞা কী দরকার?

বলেছিলাম। কিন্তু লোকটা এমন গোঁয়ার যে বলল প্রতিজ্ঞা ভাঙলে নাকি বাবার আত্মাকে। অসম্মান করা হবে। মর তুই। জুলি জানালার বাইরে তাকালেন। ওদের বাড়ি এসে গেল। জুলি বললেন, আলাপ হল। এভাবেই যাতায়াতের পথে দেখা হলে কথা হবে। ঠিক আছে?

মালপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম। ড্রাইভারকে যে ভাড়া দেওয়া হবে তাতে সে আমাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে পারত। কিন্তু জুলি কিছু না বলায় আমি অপেক্ষা করলাম না। ততক্ষণে দরজা খুলে প্রাক্তন নাবিক বেরিয়ে এসেছেন তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীকে সাহায্য করতে।

এই সময়ে ঠান্ডাটা সামান্য কম বলে চটপট কয়েক পিস মাছ রান্না করে ফেললাম। একা থাকার আগে আমি কখনও কিচেনে ঢুকিনি। ঢুকতে হবে যখন, তখন রান্না করার নিজস্ব পদ্ধতি নিজেই আবিষ্কার করে নিলাম। ভাত এখন করলে খাওয়ার সময় সেটা এমন ঠান্ডা হয়ে যাবে যে, গেলা। যাবে না। কাজকর্ম শেষ করে রামের বোতল এবং গ্লাস নিয়ে জানালার পাশের টেবিলে গিয়ে বসলাম। এখান থেকে রাস্তার অনেকটাই দেখা যায়। কেউ এলে আমার চোখ এড়াতে পারবে না। একটা বাদামের সঙ্গে এক চুমুক রাম অতি উপাদেয়। গলা দিয়ে চালান করে আমি চোখ বন্ধ করলাম। কে হতে পারে? ভাড়াটে গুন্ডা নিশ্চয়ই নিজেরাই আসবে না, কেউ ওদের পাঠিয়েছে টাকা খরচ করে। এই কেউটা কে? আট বছর আগে আমি স্পেশাল ট্রেনিং নিয়ে একটা বড় ডিটেকটিভ এজেন্সিতে চাকরি পেয়েছিলাম। প্রথমদিকে ওরা আমাকে সেইসব নারী-পুরুষের পেছনে খবর জোগাড় করতে পাঠাত, যাদের একজন আমাদের কাছে এসে ডিভোর্সের জন্য। পর্যাপ্ত তথ্য চাইত। খুব বিশ্রী কাজ। নারী যদি ক্লায়েন্ট হত তাহলে সারাদিন পুরুষটি কোথায় কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে তা জানতে হত। আর পুরুষ হলে নারীটি কারও সঙ্গে প্রেম। করছে কিনা সেটা জেনে প্রমাণ জোগাড় করতে হত। কোনও খ্রিল নেই এই কাজে। বছরখানেক বাদে আমার প্রমোশন হল। দুই বড় শিল্পপতি, যাদের সামনাসামনি সদ্ভাব থাকলেও অন্যের ছিদ্র অন্বেষণে তৎপর, তাদের কেউ ক্লায়েন্ট হয়ে আসায় আমার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করলেন মালিক। সেই কাজে চমকার সাফল্য পাওয়ার পরই কাল হল। কলকাতায় একজন বড়। ব্যাবসায়ী আমাদের কোম্পানিকে প্রস্তাব দিলেন আমি যেন তার দেহরক্ষী হিসেবে সিমলায় যাই। সেখানে তিনি একটা ব্যাবসায়িক মিটিং করতে যাচ্ছেন। টাকার অঙ্ক ভালো বলে মালিক রাজি হয়ে গেলেন। সেই প্রথম প্লেনে উঠলাম আমি। দিল্লি হয়ে চণ্ডীগড়। সেখান থেকে গাড়িতে কালকা হয়ে সিমলার পথে। সিমলায় বড় হোটেলে ওঠা হল। কোনও কাজকর্ম নেই, বেশ আরামে দিন কাটছিল। ভদ্রলোকের কাছে মাঝে-মাঝে দু-একজন লোক আসে। তখন আমাকে বাইরে থাকতে হয়। যেন একটা ছোট ব্যাগ তাঁর কলকাতার অফিসে পৌঁছে দিই। ব্যাগটিতে জরুরি কাগজপত্র আছে, হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন আমাকে আর তাঁর দরকার নেই। তিনি ওখান থেকে বোম্বে চলে যাচ্ছেন। তবে আমি ওটা যেন কখনই কাছছাড়া না করি। উনি একদিন পরে আসবেন বলে আমি সিমলা থেকে রওনা হলাম।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমার ড্রাইভার জানাল, একটা গাড়ি নাকি আমাদের অনুসরণ করছে। তবে সে কিছুতেই ওদের কাছে আসতে দেবে না। চণ্ডীগড় পর্যন্ত যে গতিতে গাড়ি ছুটল তাতে আমার দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এয়ারপোর্টে পৌঁছে শুনলাম রানওয়েতে কী গোলমাল হওয়ায় সেদিনের সব ফ্লাইট ক্যানসেল করা হয়েছে। অতএব হোটেলে উঠতে হল এবং সেই রাতে আমার ঘরে হামলা হয়েছিল। দুজন বন্দুক দেখিয়ে ঢুকে ব্যাগটা চেয়েছিল। আমি অস্বীকার করি। বলি, নিজের ব্যাগ ছাড়া অন্য কোনও ব্যাগ আমার কাছেমাথায় আসেনি। না পেয়ে ওরা তখনকার মতো চলে যায়। এবার সন্দেহ হওয়ায় আমি ব্যাগ খুলি। ব্রা নেই। ওদের একজন তল্লাশি চালায়। ব্যাগটাকে আমি রেখেছিলাম বাথরুমের গিজারের ওপর। সেটা ওদের উন সুগারের প্যাকেটগুলো নজরে পড়ায় পাথর হয়ে যাই। ওইরকম একজন মানী ধনী ব্যাবসায়ী আমাকে মিথ্যে কথা বলে কলকাতায় ব্রাউন সুগার পাঠাচ্ছেন কেন তা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।

আমি আর দেরি না করে হোটেল ছেড়ে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সিমলায় ফিরে গেলাম। হোটেলে রিসেপশনে বলল, ভদ্রলোক ঘরে আছে। ওপরে উঠে বেল বাজালাম। কেউ খুলল না। শেষপর্যন্ত দরজায় চাপ দিতে সেটা খুলে গেল। ঘরে ঢুকে আমি হতভম্ব। ভদ্রলোক পড়ে আছেন মেঝের ওপর উপুড় হয়ে। শরীরে প্রাণ নেই তা বুঝতে পারা যাচ্ছিল। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম হোটেল থেকে। ট্যাক্সি নিয়ে যেতে-যেতে একটা বিশাল ঝোরা যা আগেই চোখে পড়েছিল। তার পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছিলাম ব্যাগ নিয়ে। ব্রাউন। সুগারের প্যাকেটগুলো খুলে সমস্ত বিষ ঝোরার জলে ফেলে দিয়েছিলাম। প্রায় কোটি টাকার সম্পত্তি জলের সঙ্গে মিশে তীব্র বেগে নিচে চলে গিয়েছিল। তারপর শূন্য ব্যাগটাকে নিচের খাদে ছুঁড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম।

চণ্ডীগড়ের হোটেলে পৌঁছতে রাত দশটা বেজে গিয়েছিল। স্নান সেরে বিছানায় শুয়ে সমস্ত ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম একটা বড় ভুল করেছি। ব্যাগের মধ্যে ব্রাউন সুগার রয়েছে জানামাত্র আমার উচিত ছিল অফিসে ফোন করে কী করণীয় তা জানতে চাওয়া।

মালিকের নির্দেশমতো কাজ করা। বেটার লেট দ্যান নেভার। আমি উঠলাম। হোটেল থেকে ফোন না করে কোনও এস.টি.ডি বুথে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দরজায় শব্দ হল। খুলতেই দেখলাম চারজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আমাকে অ্যারেস্ট করল। সিমলার হোটেলে। কলকাতার বিখ্যাত ব্যাবসায়ীকে খুনের অপরাধে আমাকে থানায় নিয়ে গেল ওরা। তার আগে হোটেলের ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওরা আপত্তি করার মতো কিছু পেল না।

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ওই ব্যাবসায়ীর সঙ্গে আমি দেহরক্ষী হিসেবে সিমলায় গিয়েছি। সম্ভবত তার কোনও গোপন ব্যাপার জানতে পেরে আমি ব্ল্যাকমেল করি।

উনি টাকা দিতে রাজি হননি। উলটে হোটেলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যেহেতু ওর আর প্রয়োজন হচ্ছেনা, তাই আমাকে উনি কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অতএব, হোটেল যেন আমার বিলটা ওঁর কাছে পৌঁছে দেয়। আমি হোটেল ছেড়ে চলে গেলেও আবার ফিরে আসি। রিসেপশনে। জানতে চাই উনি ঘরে আছেন কিনা। ওঁর ঘরে গিয়েই আবার নিচে নেমে আসি এবং কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে বেরিয়ে যাই। পুলিশের ধারণা, ওই সময়েই আমি ভদ্রলোককে খুন করেছি। পরদিন কোর্টে তোলা হলে বিচারক আমাকে জামিন দিলেন না, আরও তদন্তের জন্যে পুলিশ। হেফাজতে পাঠিয়ে দিলেন।

আমার কোম্পানির লোক খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছিল। পুলিশের সঙ্গে কথা বলার পর আমাকে লোকটি জানিয়ে গেল ফিরে গিয়ে মালিকের সঙ্গে কথা বলবে। লোকটি যখন আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল তখন একজন পুলিশ অফিসার পাশে থাকায় আমি ব্রাউন সুগারের ব্যাপারটার কথা না বলে যা ঘটেছিল সব বলেছিলাম। ততক্ষণে আমার মনে আত্মরক্ষার জন্য নানান যুক্তি তৈরি হয়ে ওঠায় আবার সিমলায় ফিরে গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে হোটেলে দেখা। করতে যাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম এক্ষেত্রে একমাত্র সাক্ষী রিসেপশনের সেই প্রৌঢ় লোকটি যাকে দেখলেই মনে হয় নেশা করে আছে। আমি বেশ জোরের সঙ্গে বললাম ওর দেখায় ভুল হয়েছে।

দিল্লির ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় আমি এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনায় এই হোটেলে উঠেছি এবং চণ্ডীগরের বাইরে যাইনি।

প্রায় তিনমাস পরে আমি জামিন পেলাম। আমার জামিনের ব্যবস্থা করেছিল টিঙ্কু। ওর বাবা চণ্ডীগড়ের নামকরা উকিল। ওকালতি পাস করে ও বাবার জুনিয়ার। আমার কথা কাগজে পড়ার পর ও একদিন জেলে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করেছিল উকিলের প্রয়োজন আছে। কি না? ততদিনে আমার মন এমন বিষিয়ে গিয়েছিল যে বলেছিলাম আর আমার কাউকে দরকার নেই, সুযোগ পেলে আমি নিজেই বিচারককে সব বলব।

টিঙ্কু হেসে বলেছিল, ঠিক কথা, কিন্তু আপনি যা বলতে পারবেন না তা আমি বিচারককে বলব। জানেন তো উকিলরা সত্যের সঙ্গে মিথ্যা বললে কোনও দোষ হয় না। শেষপর্যন্ত আমি রাজি হলাম। আমার জামিন পাওয়া গেল। গ্রেফতার হওয়ার সময় অল্প কিছু টাকা পকেটে ছিল। সেগুলো ফেরত পাওয়া গেল। আমার ওপর আদালতের আদেশ ছিল যেন চণ্ডীগড়ের বাইরে না যাই। কলকাতার ব্যাঙ্কে কয়েক হাজার টাকা আছে। ওদের চণ্ডীগড়ের ব্রাঞ্চে সেটা ট্রান্সফার করিয়ে নিলাম। টিঙ্কু আমার জন্য সস্তায় একটা ভালো গেস্টহাউসের ব্যবস্থা করে দিল।

জানালার পাশ থেকে উঠে এলাম। ইতিমধ্যে ছ-পেগ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন দুপুর দেড়টা। অথচ বাইরের আলো ভোরের মতো। টিঙ্কু বলেছিল মদ খেতে দেখলে আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু মাতাল দেখলে গা ঘিনঘিন করে। এক সিটিং-এ ছপেগের বেশি এখন খাইনা।

ভাতটা গ্যাসে চাপিয়ে দিলাম। গত রাত্রের কিছু কাজ বাকি ছিল, সেগুলো শেষ করলাম চটপট। তারপর লাঞ্চ করলাম। একবার পেটে ভাত পড়লে অদ্ভুত, ঘণ্টা চারেকের মধ্যে আর মদ খেতে ইচ্ছে করে না। উলটো এখন শরীর আরাম চাইছে। হঠাৎই জায়গাটির কথা মনে পড়ল। আজ। দুপুরে প্রতিদিনের মতো বিছানায় শুতে ঠিক স্বস্তি হচ্ছিল না। দোকানদারের কথা মনে আসতেই ঠিক করলাম ঝুঁকি নেওয়া অন্যায় হবে। দরজায় তালা লাগিয়ে রাস্তায় নামলাম। বাজারের রাস্তার উলটোদিক ধরে একটু হাঁটলেই পথ শেষ। কিন্তু ওপরে ওঠা যায়। পাথরে পা ফেলে অনেকটা ওপরে ওঠার পর একটা আড়াল পার হতেই পাথরের চাতাল। বেশ বড়। ব্যাডমিন্টন কোর্টের মতো। তখন এখানে কুয়াশা নেই, আধমরা রোদ নেতিয়ে রয়েছে। নিচের দিকে তাকালেই। আমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। একদম ছবির মতো। চাতালে শুয়ে পড়লাম। পেটে মদ ছিল, তার। ওপর ভাত পড়ায় ঘুম আসতে দেরি হল না। কিন্তু আমি জেগে থাকতে চাইলাম। মনে হচ্ছিল, দোকানদারের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে যারা খোঁজ করছে তারা আজ সন্ধের আগেই পৌঁছে যাবে। পাহাড়ের অচেনা জায়গায় কেউ রাত্রে যাওয়ার ঝুঁকি নেয় না। আমি উপুড় হয়ে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

টিঙ্কুকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন সে আমার কেসটায় আগ্রহী হল। টিঙ্কু হেসে বলেছিল, খবরের কাগজে তোমার ছবি দেখে। মনে হয়েছিল এই লোকটা খুন করতে পারে না তারপর সিরিয়াস হয়ে বলেছিল, কোনও খুনি চাইবে না প্রমাণ রেখে খুন করতে। তুমি রিসেপশনে। জিজ্ঞাসাবাদ করে ভদ্রলোকের ঘরে গিয়ে খুন করে আবার ওর সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাবে, এটা হতেই পারে না।

টিঙ্কু আদালতে প্রমাণ করেছিল যে আমি সিমলা থেকে চণ্ডীগর যখন যাই তখন একটা গাড়ি। আমাদের ফলো করেছিল। সম্ভবত আততায়ী জানতে চাইছিল আমি সত্যি রিপোর্ট করেছিলাম কি না। এবং ওরা আমাকে এক রাত্রের জন্য হোটেল দিয়েছিল। হোটেল বলেছে আমি চেক ইন। করেছিলাম। তবে দুপুরের পর আমি কখন বেরিয়েছিলাম তা ওরা লক্ষ করেনি, তবে ফিরেছিলাম রাত দশটার সময়। ফ্লাইট চালু থাকলে যার দিল্লি হয়ে কলকাতায় পৌঁছে যাওয়ার কথা তার নিশ্চয়ই সিমলার কাউকে খুন করার পরিকল্পনা থাকতে পারে না। দুটো সিনেমা হলের ম্যাটিনি এবং ইভিনিং শো-এর টিকিট কোর্টে দাখিল করে টিঙ্কু বলেছিল আমি সেদিন ওই চণ্ডীগড়ে সিনেমা হলে বসেছিলাম। পুলিশের উকিল রিসেপশনিস্টকে হাজির করেছিল আদালতে সাক্ষী হিসেবে। প্রৌঢ় ভদ্রলোক কথা বলছিলেন মাটির দিকে তাকিয়ে। তার মনে হচ্ছে তিনি আমার স্বার্থে কথা বলেছেন। টিঙ্কু কিছুক্ষণ কথা বলার পর বিচারককে অনুরোধ করল সাক্ষীকে প্রশ্ন। করতে এই বলে যে, টিঙ্কুর চেহারা কীরকম। টিঙ্কু সাক্ষীর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াল। প্রৌঢ় ভদ্রলোক থতমত হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, অল্প বয়স। বিচারক আদেশ দিলেন, চেহারা বর্ণনা করুন। ভদ্রলোক সংকোচে বললেন, মহিলার মুখ বলে তিনি ভালো করে লক্ষ করেননি। দর্শকরা হেসে উঠলে টিঙ্কু বলল, আর আমার কিছু বলার নেই। যে সাক্ষীর সঙ্গে এ মুহূর্তে কথা বলছি, তিনি যখন আমার মুখের দিকে তাকাননি তাঁর পক্ষে কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতি মনে রেখে সাক্ষ্য দেওয়া সম্ভব কি না আদালত বিচার করবেন। সরকারের উকিল তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। নারীর মুখের দিকে তাকান না যিনি, তিনি পুরুষের মুখ দেখবেন না–এমন ভাবা ঠিক নয়। কিন্তু সেটা বিচারকের মনে রেখাপাত করল না। প্রায় এক বছর পরে আমাকে মুক্তি দেওয়া হল।

ততদিনে আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি। টিঙ্কুর বাবার তীব্র আপত্তি সত্বেও সে আমাকে বিয়ে করতে চাইল। কিন্তু আমার তখন রোজগার নেই। টিঙ্কুর উদ্যোগে আমরা একটা ফার্ম খুললাম। আইন সংক্রান্ত যাবতীয় সাহায্য দেওয়া হবে। টিঙ্কু আইনের দিকটা দেখবে আর আমি। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। আমার কেসটা জেতায় টিঙ্কুর খুব নাম হয়েছিল। ফলে প্রচুর ক্লায়েন্ট আসতে লাগল। সবাই যে কোর্টে যেতে চায়, তা নয়। ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি কোর্টের বাইরে সমস্যার সমাধান করতে লাগলাম। দু-বছরের মধ্যেই ভালো রোজগার হল।

এই সময়ে আমরা রেজিস্ট্রি করলাম। যেদিন ছুটি থাকত, সেদিন মনে হত পৃথিবীটা আমাদের। সন্ধ্যা হলেও আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। গাড়ি নিয়ে অন্ধকারে লং ড্রাইভে যাওয়া ছিল ওর নেশা।

মাস ছয়েক পরে টিঙ্কুকে সিমলায় যেতে হয়েছিল কাজে। বলেছিলাম, গাড়ি না নিয়ে ট্যাক্সিতে যেতে। গাড়ি চালাতে যে ভালোবাসে তাকে এই প্রস্তাব দিলে কাজ হয় না। ভোরবেলায় বেরিয়ে গেল। বলল, সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসবে। সেই শেষ দেখা। পুলিশ খবর দিল, ওর গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। সম্ভবত ব্রেক ফেল করায় রাস্তা ছেড়ে খাদের গভীরে আছড়ে পড়েছে। অন্ধকারের জন্য আজ উদ্ধারের কাজ করা সম্ভব হয়নি। আগামীকাল সকালে সেটা হবে। পাগল। হয়ে গেলাম যেন। তখনই দুর্ঘটনাস্থলে যেতে চাইলাম। মনে হচ্ছিল, খাদে পড়া সত্বেও টিঙ্কু তো বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ আমাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলল। ভোরবেলায় রওনা হলাম। স্থানীয় পুলিশ তখন উদ্ধার কাজ শুরু করেছে। ওপর থেকে দেখেই বুঝলাম, কোনও আশা নেই। টিঙ্কুর গাড়িটা টুকরো-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে। সারাদিন পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়েছিল। রক্তমাখা জামাকাপড় ছাড়া টিঙ্কুর আর কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। জলজ্যান্ত। মেয়েটার শরীর উধাও হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের ধারণা শরীর টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়েছিল এবং সারারাত ধরে বন্যজন্তুরা সেগুলো ভোজন করেছে।

এই মৃত্যুর নিষ্ঠুরতা আমি সহ্য করতে পারিনি। চণ্ডীগড়ে থাকতে পারিনি আর। সবকিছু বন্ধ করে এলোমেলো ঘুরেছিলাম নানান শহরে। শেষপর্যন্ত এখানে এসে মনে হয়েছিল নিজের মতো থাকতে পারব। না। আমি টিঙ্কুকে এখন স্বপ্নেও দেখি না। তবে ওর কথা, ওর হাসি, ওর তাকানোর ভঙ্গি মাঝে-মাঝেই জেগে থাকা অবস্থায় মনে পড়ে যায়। তবে এই মাঝে-মাঝের মধ্যে সময়ের ফারাক বাড়ছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই বাজপাখিটাকে দেখতে পেলাম। খানিকটা ওপরে পাথরের ওপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দূরদৃষ্টি নিয়ে। ঝটপট উঠে বসতেই পাখিটা উড়ে গেল।

চারপাশে তাকালাম। আলো যেটুকু ছিল এখন তার অল্পই অবশিষ্ট আছে। বোধহয় সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। নিচের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। কেউ একজন আমার বন্ধ দরজার সামনে। দাঁড়িয়ে আছে। দুজন নয়, একজন। তারপরেই চিনতে পারলাম। জুলি। জুলি আমার কাছে। এসেছে কোনও প্রয়োজনে? প্রয়োজন থাকলে তো প্রাক্তন নাবিককেই পাঠানো উচিত। আমি জানান দিলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জুলি ফিরে গেল।

আমি উঠলাম। এখনও অন্ধকার নামেনি। কিন্তু তার আগে আমার উচিত কিছুটা নিচে চলে যাওয়া, অন্ধকারে এত উঁচু করে নামা সহজ কাজ নয়।

সন্ধ্যা নামলে নেমে এলাম বাকিটা। এদিকে রাস্তায় আলো নেই। আকাশে মেঘ থাকায় রাতের আগেই অন্ধকার ঘন হয়ে যায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ওটাকে ভালো করে বন্ধ করে চা বানালাম। তারপর মগটা নিয়ে ওপাশের জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। জানালার নিচে অনেকটা খাদ। খাদের ওপাশে রাস্তা। সেখান দিয়ে ছাড়া আমার এখানে পৌঁছনোর কোনও উপায় নেই। যেই আসুক, আমার চোখ এই অন্ধকারেও তাকে বুঝতে পারবে। যে ভদ্রলোক সিমলার হোটেলে খুন হয়েছিলেন তার হত্যাকারী আমি চণ্ডীগড়ে থাকাকালীন সময়েও ধরা পড়েনি। আমি জামিন পাওয়া শেষে মুক্ত হওয়ার পর দু-বছরের ওপর টিঙ্কর সঙ্গে ছিলাম কিন্তু কেউ আমায় বিরক্ত করেনি। কোনও দাবি নিয়ে কেউ সামনে দাঁড়ায়নি। চণ্ডীগড় থেকে বেরিয়ে আমি যেখানে গিয়েছি কখনও বুঝতে পারিনি কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কিনা। না সম্ভব নয়, অনেক জায়গায় আমি হঠাৎই মাঝরাতে হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরেছি। যত ধুরন্ধর অনুসরণকারী হোক, আমি হোটেলের ঘরে শুয়ে আছি জানার পর মাঝরাতে হোটেলের বাইরে জেগে থাকবে না। তা হলে আমার খোঁজে এই পাহাড়ি শহরে কেউ আসবে কী করে?কীভাবে বলবে আমি এখানে থাকি! হ্যাঁ, যারা আমার কাছে ব্রাউন সুগারের ব্যাগ খুঁজতে এসেছিল তারা এতদিন চুপচাপ থেকে হঠাৎ জেগে উঠবে এটা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এত বছর ব্যাগটাকে নিশ্চয়ই আমি সঙ্গে রাখব না।

হঠাৎ দূরে আলো দেখতে পেলাম। জ্বলছে নিভছে এবং জ্বলছে। আলোটা এদিকে এগিয়ে আসছে। আমি সতর্ক হলাম। পরিচয় পেয়ে সন্তুষ্ট না হলে দরজা খুলব না। যদি দরজা ভাঙার। চেষ্টা করে তাহলে বাড়ির পেছনের দরজা যার সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে, ব্যবহার করব। ক্রমশ আলোটা আমার বাড়ির সামনে এল। টর্চের আলো এসে পড়ল বাড়ির ওপরে। তারপরেই আমি জুলির গলা শুনতে পেলাম, মিস্টার শান্ত, মিস্টার শান্ত।

সবিস্ময়ে দরজা খুললাম। আলোটা জ্বালার কথাও মনে পড়ল না। টর্চের আলো এসে পড়ল মুখে, ওছইউ আর হিয়ার! কোথায় গিয়েছিলেন? আমি কয়েকবার আপনাকে খুঁজে গিয়েছি। ভেতরে আসতে পারি?

নিশ্চয়ই। আমি, আলো জ্বালালাম।

জুলি ভেতরে এলেন, আমি খুব সমস্যায় পড়েছি। ওর হাতে একটা ব্যাগ।

বসুন। আমি দরজা বন্ধ করলাম।

জুলি চেয়ারে বসলেন, ও নেই।

মানে?

আজ বিকেলে দুজন লোক আমাদের বাড়িতে এসেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে। লোক দুটোর চেহারা দেখে আমার মোটেই ভালো লাগেনি। আমি যাতে শুনতে না পাই, তাই বাড়ির বাইরে গিয়ে কথা বলল। অনেকক্ষণ ধরে ওদের সঙ্গে তর্ক করে আপনার বন্ধু বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়ে ভেতরে ফিরে এসে বলল, একটা জরুরি কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে। কাল বিকালের আগে ফিরতে পারবে না। কী জরুরি কাজ জানতে চাইলে বলল, ফিরে এসে বলব। একটা ব্যাগেপ্রয়োজনীয় জিনিস আর শার্ট নিয়ে ও চলে গেল স্কুটারে।

এমন অপমানিত আমি জীবনে হইনি। আমাকে কোনও কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করল না? শুনতে-শুনতে মনে হচ্ছিল, আবার মাথার ওপর থেকে বিশাল ওজন নেমে গেল। প্রশান্ত মুখে। জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?

তবে হ্যাঁ, ও যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেল সেটা বোঝা যাচ্ছিল। এ ব্যাপারে কিছু জানেন?

না। আমি কিছুই জানি না।

আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনার প্রতিবেশী কোনও ক্রিমিনালদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

আমার তো মনে হয় না।

তাহলে ও যাবে কেন? আর আমাকে ও বলতে পারল না কেন?

হ্যাঁ, এইটা অস্বাভাবিক। চা খাবেন?

না, আমার ইচ্ছে হচ্ছিল তক্ষুনি মায়ের কাছে চলে যেতে।

আহা, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। উনি ফিরে এলে।

কোথায় অপেক্ষা করব? এই বাড়িতে? একা? মাথা নাড়লেন জুলি।

ভয়ে আমি মরে যাব। আর কে বলতে পারে আমি একা আছি জেনে লোকদুটো আবার ফিরে আসবে কিনা। উঃ। কি সাংঘাতিক পরিস্থিতি।

হ্যাঁ একা থাকা, বিশেষ করে আপনার মতো মহিলার পক্ষে খুব মুশকিল।

আমি যদি বুড়ি হতাম, অথর্ব হতাম, তাহলে নিশ্চয়ই পারতাম। জুলি মাথা নাড়ল, এখানে তো ভালো হোটেলও নেই।

হোটেলে থাকার চেয়ে আমি এখানে থাকলে ভালো থাকব। জুলি বললেন।

এখানে? আমি হতভম্ব।

কেন, আপনার আপত্তি আছে?

জুলি উঠে দাঁড়ালেন, বেডরুম তো দুটো দেখছি।

না-না, আপত্তি কীসের আপনি স্বচ্ছন্দে থাকুন। তবে…।

তবে?

আমি মদ্যপান করি, গন্ধটা সহ্য করতে হবে।

অপমানের জ্বালার থেকে মদের গন্ধ কি বেশি তীব্র? কোন ঘরে যাব?

যে-কোনও ঘর।

ব্যাগ নিয়ে জুলি আমার শোওয়ার ঘুরে ঢুকে আলো জ্বালাল, দরজা ভেজিয়ে দিলেন না। আমি মদের বোতল আর গ্লাস নিয়ে বসলাম। তাহলে প্রাক্তন নাবিকের সন্ধানে এসেছিল লোকদুটো। কী জন্য এসেছিল তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আমার কোনও সমস্যা নেই জানার পর বেশ হালকা লাগছে। কিন্তু জুলিকে রাতে কী খাওয়ানো যায়? মাছ ভাত কি খাবে? মিনিট দশেক পরে জুলি বেরিয়ে এলেন। এখন তাঁর পরনে ম্যাক্সি আর শাল। সামনের চেয়ারে বসে বললেন, দিন। আমাকে, মদ খেলেই ভীষণ ঘুম পায়। ঘুমালে মাথায় চিন্তা থাকবে না। রাতটা দিব্যি কেটে যাবে।

গ্লাসে বরফ ঢেলে জিজ্ঞাসা করলাম, বলবেন, কতটা জল দেব।

অল্প।

সেইমতো গ্লাস এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, রাতে কী খাবেন?

কিছু না।

এলোমেলো কথা, বেশিরভাগই প্রাক্তন নাবিককে গালাগালি, শেষ করে, তিন গ্লাস পেটে চালান করে উঠে পড়লেন, ঘুম পাচ্ছে। শুতে যাচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই রাতে আমার ঘরে ঢুকবেন না। না, বলবেন না। আপনি যদি পুরুষ হন, তাহলে আপনার ইচ্ছে করবে। কিন্তু অতিথির ইচ্ছের। বিরুদ্ধে কিছু করা অভদ্রতা, তাই না? জুলি চলে গেলেন।

কথাটা আমার মাথায় ঢুকিয়ে গেলেন জুলি। আমি আর মদ খেতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কোনও অবস্থায় মাতাল হব না। হঠাৎ আমার মনে হল, জুলি আমার ঘরে আসতে পারেন। আমি তো ওঁর অতিথি নই। তাই অভদ্রতা হবে না। দিনেরবেলায় পাহাড়ের ওপরে পালিয়েছিলাম। রাতে কোথায় যাব? তা ছাড়া আমার মনে অন্য ভাবনা যদি আসে? আলো নিভিয়ে দ্বিতীয় ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। নিজেকে চোর বলে মনে হচ্ছিল, আর পুলিশ যেন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

কাল রাতে বেশি মদ্যপান করে ফেলেছিলাম। বেশি মদ খেলে আমার শরীর অচল হয়ে যায়। তখন সবকিছুতেই আলস্য লাগে। এমনকী খাবার খেতেও ইচ্ছে হয় না। আমি সেটাই চেয়েছিলাম। দরজা বন্ধ করে কোনওমতেই শরীরটাকে বিছানায় নিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

যখন ঘুম ভাঙল তখন মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। অর্থাৎ খালি পেটে অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য আমার হ্যাঙওভার হয়েছে। চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছিল। বাইরে রোদ নেই কিন্তু ঘড়ি বলছে নটা বেজে গেছে। জুলির কথা মনে পড়ল। পাশের ঘরে সে আছে। হাজার হোক এই বাড়িতে ও এখন

অতিথি। ভোরবেলায় ওকে চা দেওয়া আমার কর্তব্য। অবশ্য এখন ভোর চলে গিয়ে ভরা সকাল। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠতেই দরজায় শব্দ হল।

আমি জানান দিতেই জুলি বলল, ব্রেকফাস্ট রেডি।

আমি বন্ধ দরজার দিকে তাকালাম। মেয়েরা কি যেখানেই যায় সেখানেই নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নেয়? এমনভাবে ব্রেকফাস্ট রেডি বলল যে, শুনলে যে কেউ ভাববে ও এই বাড়িরই কেউ। পরিষ্কার হয়ে এক গ্লাস জলে দুটো ডিসপিরিন ফেলে দিয়ে খেয়ে নিয়ে বাইরে বের হলাম। জুলি চলছিল স্কার্ট আর হাতকাটা শার্ট পরে। মেয়েদের এমনিতেই ঠান্ডা কম লাগে। এর বোধহয় আরও কম। বললাম, গুড মর্নিং!

আমার দিকে তাকিয়ে জুলি খিলখিল করে হেসে উঠলেন।

কী ব্যাপার? বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম।

আপনার মুখটা আয়নায় দেখুন, চিনতে পারবেন না। জুলি আবার হাসছেন–কী বিশাল হয়ে গিয়েছে ফুলে। দরজা বন্ধ করে প্রচুর ড্রিংক করেছেন, না?

ওই আর কী! দরজা বন্ধ করে শব্দতিনটে কানে ঢুকল। তার মানে জুলি রাতে আমার ঘরের দরজা পরখ করে গেছে।

চায়ের কাপ নিয়ে বসলাম। সামনের রাস্তা নিঝুম। ছায়া জড়ানো। চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, এবার আপনার থানায় যাওয়া উচিত।

থানায়?

হ্যাঁ। আপনার স্বামীকে দুজন লোক কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছে তা থানাকে জানানো দরকার। ওঁকে উদ্ধার করতে তো হবে। আমি বললাম।

আমিও মনে করেছি। কিন্তু ভয় হচ্ছে কেঁচো খুঁড়তে সাপ না বেরিয়ে আসে।

তার মানে?

আপনার প্রতিবেশীর যদি কোনও গলতি থাকে?

থাকতে পারে, কিন্তু আমরা সেটা জানি না। যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে পুলিশ আপনার বিরুদ্ধেই অভিযোগ করবে, কেন কিডন্যাপ হওয়ার পরও আপনি জানাননি।

জুলির মুখে চিন্তার ছাপ পড়ল, কিন্তু থানা কোথায় আমি জানি না। তা ছাড়া শুনেছি, পুলিশ নাকি খুব খারাপ ব্যবহার করে! আপনি সঙ্গে যাবেন?

যেতে পারি। কিছু না ভেবেই বললাম।

সঙ্গে-সঙ্গে দুশ্চিন্তা চলে গেল জুলির মুখ থেকে। উৎসাহিত হয়ে বললেন, আসুন, ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিই।

এত অল্প সময়ের মধ্যে তিন-তিনটি আইটেম করে ফেলেছেন উনি। খেতে বেশ ভালো লাগছে। বললাম, আপনার রান্নার হাত বেশ ভালো।

তাই।

নিজে হাত পুড়িয়ে রাঁধতাম, এখন মনে হচ্ছে আমার কপাল বেশ ভালো।

দুপুরে কী খাবেন বলুন? আপনার ফ্রিজে দেখলাম বোয়াল মাছ আছে।

আমার এখানে এসে আপনি রাঁধবেন কেন?

কারণ আমার রাঁধতে ভালো লাগে। জুলি হাসলেন।

প্রশ্নটা না করে পারলাম না, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে গতকাল যেরকম দেখেছি আজ তার ঠিক উলটোটা, কী করে হল?

বুঝতে পারলাম না।

আপনাকে গতকাল সকালে বেশ বয়সি, গম্ভীর প্রকৃতির বলে মনে হয়েছিল। আজ আপনি খুব সহজ, ঘরোয়া। বললাম।

তাহলে সঙ্গগুণে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। জুলি খাওয়া শেষ করল।

কেন?নাবিক কি অন্যরকম মানুষ?

আমি জানি না। তবে ওই বাড়িতে ঢুকলেই মনে হয় পৃথিবীতে আমার কোনও বন্ধু নেই।

আপনাদের তো প্রেম করেই বিয়ে হয়েছিল?

আর প্রেম। তিরিশ বছরের গ্যাপটা এখন সব প্রেম উড়িয়ে দিয়েছে। আমার কথা থাক। আমরা কি এখন থানায় যাব, না লাঞ্চের পরে? জুলি উঠে দাঁড়ালেন।

এখনই যাওয়া ভালো।

বেরুবার আগে পাশের ঘরে গিয়ে খুশি হলাম। এর মধ্যেই চমৎকার গুছিয়ে ফেলেছেন জুলি ঘরটাকে। বেশ দেখাচ্ছে।

জিনস আর জ্যাকেট, হাতে ছাতি নিয়ে জুলি আমার সঙ্গে রওনা হলেন। নিজের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, একটা লোক রেখে গেলে হত। যদি ও এর মধ্যে ফিরে আসে। যাক, আসবে বলে মনে হয় না।

একটা ব্যাপার আমাকে হঠাৎ ভাবাল। কাল থেকে স্বামী নেই, ওঁকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। কিন্তু জুলিকে তো তেমন চিন্তিত দেখাচ্ছেনা। অন্য বউ হলে কান্নাকাটি করত। তৃতীয় পক্ষ বলেই বোধহয় এতটা আবেগ আসে না।

গল্প করতে-করতে আমরা থানায় পৌঁছে গেলাম। থানার অফিসার জুলির মুখে ঘটনাটা শুনলেন। তারপর আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি আপনার কে হন?

জুলি বললেন, প্রতিবেশী।

অফিসার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, একেবারে পাশেই থাকেন?

একটু দূরে, তবে মাঝখানে কোনও বাড়ি নেই।

ওহো, বুঝতে পেরেছি।

আপনি তো একাই থাকেন?

হ্যাঁ।

এর সঙ্গে কতদিনের আলাপ?

গতকালই পরিচয় হয়েছে।

সে কী? ম্যাডাম কতদিন আপনি স্বামীর সঙ্গে ওই বাড়িতে বাস করেছেন?

দু-মাস।

এই দু-মাসে আপনার প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ হয়নি?

আমি আগ্রহী ছিলাম না তাই। আমার স্বামী যেতেন ওর কাছে।

আপনার স্বামীকে কে কিডন্যাপ করতে পারে?

আমার কোনও ধারণা নেই।

আপনার কি ধারণা আছে মিস্টার…?

না। মাথা নাড়লাম আমি।

কাল থেকে আপনি ওই বাড়িতে একাই আছেন?

হ্যাঁ।

আপনার স্বামীর একটা ছবি চাই।

জুলি ব্যাগ খুলে একটা ছবি বের করে দিলেন, আমরা দুজন এতে আছি।

অফিসার দেখলেন ছবিটাকে, আপনার স্বামী? আশ্চর্য তো! দেখে মনে হচ্ছে আপনি ওঁর মেয়ে। ঠিক আছে, এই ছবি আমি রেখে দিচ্ছি। কেউ যদি আপনার কাছে টাকাপয়সা চায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবেন।

অফিসার এমন ভাব করলেন যে মনে হল কথা শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমি বললাম, কিছু মনে করবে না, ফর দ্য রেকর্ড, ডায়েরি নাম্বার দেবেন?

ডায়েরি? কী দরকার?

উনি যে আপনার কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন তার প্রমাণ।

কী দরকার সেটার?

এমনি তো কোনও দরকার নেই। কিন্তু যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়।

খারাপ কিছু বলতে?

ধরুন, তিনি খুন হলেন। তখন ওঁর স্বামীর সম্পত্তি পেতে এই ডায়েরি ওঁকে সাহায্য করবে। তাই না? বললাম আমি।

আই সি। বৃদ্ধ স্বামী খুন হয়ে গেলে যুবতী স্ত্রী-র উপকারই হয়। এই পরামর্শ আপনি ওকে দিয়েছেন নিশ্চয়ই। অফিসার বেঁকিয়ে-বেঁকিয়ে বলল। আপনি কী বলতে চাইছেন? আমি রেগে গেলাম।

কিছু না, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

ঘণ্টাখানেক বাদে ডায়েরি নাম্বার নিয়ে আমরা বাইরে বের হলাম।

জুলি খুব বিমর্ষ গলায় বললেন, আমার সঙ্গে থানায় আপনাকে কথা শুনতে হল।

দূর। আমার গায়ে লাগেনি।

লোকটা আপনার আর আমার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ করছিল।

পুলিশের যা স্বভাব। বললাম। যদি শুনত কাল রাতে আমি আপনার বাড়িতে ছিলাম তাহলে…। হাসলেন জুলি, লোকটা তো জানে না আপনি কী ভীতু। সারারাত দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলেন।

ঠিক। আমি নিজেকে ভয় করেছিলাম। যদি আপনার অসম্মান করে ফেলি।

তাই? জুলি চোখ ঘুরিয়ে আমায় দেখে হাসলেন।

আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। জুলি প্রায়ই এত কাছে চলে আসছিলেন যে আমার কাঁধে তাঁর কাঁধ ঘষে যাচ্ছিল। হাঁটতে-হাঁটতে বললেন, আজ বোয়াল মাছের এমন একটা প্রিপারেশন আপনাকে খাওয়াব যা বাজি রেখে বলতে পারি কখনও খাননি।

অপেক্ষায় থাকছি। আমি বললাম।

ওঁদের বাড়ির সামনে আসতেই দেখতে পেলাম নাবিককে। বারান্দায় বসে আছে। বিধ্বস্ত চেহারায়। আমরা দৌড়ে কাছে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছিল?

ওরা ছেড়ে দিয়েছে। আমি আর পারছি না। তোমরা কোথায় গিয়েছিলে?

থানায়। জুলি বললেন।

আঃ। থানায় কেন গেলে? ওরা বলেছে পুলিশ যেন কিছু না জানে।

ওরা কারা? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

জানি না। নাবিক চোখ তুললেন, ওরা বোধহয় তোমার বদলে ভুল করে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। সাবধানে থেকো।

চলে আসতে-আসতে পেছন ফিরে তাকালাম। জুলি একা দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খোলা। জুলি হাসলেন। হঠাৎ আমার মনে হল, কথাটা নাবিক বানিয়ে বলেনি তো? আমাকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য। বার্ধক্য তো চিরকাল যৌবনকে ভয় করে। জুলির হাসি তো সে কথাই বলছে। বাড়ি ফিরেও আমি আশা করছি, জুলি আসবেন এবং ফ্রিজে ঠান্ডা হয়ে পড়ে থাকা মাছটাকে দারুণভাবে রাঁধবেন। আশা করতে আমার ভালো লাগছে। কী করব!

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *