কারাে এই ক্ষমতা, কারাে সেই ক্ষমতা। সব বােগাস । আর মানুষের স্বভাব এরকম যে সে আসল জিনিস বিশ্বাস করে না । বােগাস জিনিস বিশ্বাস করে।‘
‘চাচা ঐ মহিলার কাছে কি আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন ? ‘কেন ?
‘গ্রামের অল্পবয়েসী একটা মেয়ে কোন কৌশলে মানুষকে ধােকা দেয় এটা আমার দেখার শখ ?’
সােহরাব চাচা বালতি হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন— তুমি তাে ভাল পাগলী আছ। বারান্দায় মশার মধ্যে দাড়িয়ে থেকো না। জংলি মশা। কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া ফ্যালেরিয়া বাঁধাবে। ঘরে চলে যাও। ঘরে ঘরে মসকুইটো কয়েল জ্বালিয়ে দিয়েছি।
আমি লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘরে চলে এলাম।
এমন কোন রাত হয় নি কিন্তু চারদিক কেমন নিঝুম হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের লােকরা মনে হয় সন্ধ্যা সাতটা বাজতেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেমন অস্বস্থি লাগছে । গাড়ির হর্ণের শব্দ নেই, রিকশার শব্দ নেই। আমি বিছানায় উপুর হয়ে পড়লাম । ডাইরি লেখা যাক । পাপিয়া ম্যাডামের মত সবুজ কালির একটা বল পয়েন্ট আমার জন্যে আনতে বললে হত। ডাইরিতে ইন্টারেস্টিং কিছু কথা সবুজ কালিতে লিখতাম।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমাদের আজ রান্না হতে দেরি হবে। রান্না কিছুক্ষণ আগে চড়ানাে হয়েছে। পাপিয়া ম্যাডাম সন্ধ্যাবেলায় বলেছেন তার খাসির মাংসের রেজালা খেতে ইচ্ছে করছে। বিরিসিরি থেকে খাসি কিনে আনা হয়েছে। এই মাত্র রান্না বসানাে হল । আমাদের বাবুর্চির নাম কেয়ামত মিয়া ! কেয়ামত কারাে নাম হতে পারে ?
শুরুতেই আমার সন্দেহ হয়েছিল নামটার কোন সমস্যা আছে। একদিন জিজ্ঞেস করে দেখি আসলেই তাই। তার নাম আসলে নেয়ামত । সবাই ঠাট্টা করে কেয়ামত ডাকতে ডাকতে এখন নাম হয়ে গেছে কেয়ামত । এখন কেউ যদি . জিজ্ঞেস করে আপনার নাম কী, তিনি স্বাভাবিক গলায় বলেন– তামার নাম কেয়ামত, কেয়ামত মিয়া।
কেয়ামত মিয়া রান্না খুব ভাল করেন। অতি সামান্য জিনিস এত যত্ন করে বাঁধেন যে শুধু খেতেই ইচ্ছে করে। প্রতিদিনই একটা না একটা অদ্ভুত আইটেম থাকবে । আজ দুপুরে ছিল সজনে পাতা ভাজি। সজনে গাছের কচি পাতা প্রচুর পেয়াজ দিয়ে সামান্য টক দিয়ে এমন একটা বস্তু বানালেন যে সবাই একবার করে বলল— কেয়ামত মিয়া এই ভাজিটা রােজ করবে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমি নিজে ডাইরিতে লিখলাম, আজ আমরা নতুন একটা খাবার খেলাম সজনে পাতা ভাজি। খাবারটা এত ভাল হয়েছে যে আমার ধারণা এখন থেকে আমরা রােজই এই খাবার খাব। এবং যখন আমাদের শুটিং শেষ হবে তখন দেখা যাবে দুর্গাপুরের সব সজনে গাছ আমরা খেয়ে ফেলেছি। সজনে পাতা ভাজি রান্নার রেসিপি আমরা পেয়ে গেছি। পাপিয়া মাডাম রেসিপি চেয়েছিলেন তাঁকে দেয়া হয়েছে, এবং ছােট ম্যাডাম হিসেবে আমাকেও দেয়া হয়েছে।
সজনে পাতা ভাজি পেয়াজ দুই কাপ রসুন আধা কাপ তেতুলের রস আধা কাপ কাচা মরিচ আধা কাপ শুকনাে মরিচ দশটা
সজনে পাতা এক গামলা বসন্তের নতুন সজনে পাতা কুচি কুচি করে কেটে তেতুল পানিতে সারাদিন ডুবিয়ে রাখতে হবে। ভাজার আগমুহূর্তে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। লবণ পানিতে ধুয়ে কষ ফেলে দিতে হবে। এক কাপ পেয়াজ তেলে ভাজবে। পেয়াজ বাদামী বর্ণ হয়ে যাবার পর সজনে পাতা, এককাপ পেয়াজ কুচি এবং আধ কাপ রসুন কুচির তেলে ফেলে দিয়ে অল্প আঁচে ভাজতে হবে । সজনে পাতা তেল টেনে নেবার পর আরাে আধ কাপ পানি দিয়ে দমে বসিয়ে দিতে হবে। পরিবেশনের আগে মুচমুচে করে ভাজা শুকনাে মরিচ খাবারের উপর দিয়ে দিতে হবে। গরম ভাতের সঙ্গে সজনে পাতা ভাজি
অতি উপাদেয় ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই রেসিপিটা মিথ্যা রেসিপি। সােহরাব চাচা বিকেলে আমাকে এসে বললেন – মিস রুমাল আমাকে একটু সাহায্য করতাে একটা কাগজে সজনে পাতা ভাজির রেসিপি লিখে দাও। পাপিয়া ম্যাডাম বড় যন্ত্রণায় ফেললেন— কিছু একটা রান্না হলেই রেসিপি ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমি বললাম, কীভাবে রান্না হয় আপনি বলুন, আমি লিখে দিচ্ছি ।
‘বানিয়ে বানিয়ে একটা কিছু লিখে দাওতো। তােমার কি ধারণা রেসিপি দেখে উনি জীবনে কখনাে রান্না করবেন ?
‘রান্না না করলে চাচ্ছেন কেন?
‘কেন চাচ্ছেন তা একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন। মা লক্ষী তুমি সুন্দর করে একটা রেসিপি লিখে দাও।’
‘যা ইচ্ছা লিখে ফেলব ? | ‘লিখে ফেল।’
আমি রান্নার বইয়ের মত করে রেসিপি লিখে ফেললাম। যখন লিখছি তখন ঘাড়ের উপর মা ঝুঁকে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন— বকু কী লিখছিস। ডাইরি ? আমাকে কোন কিছু লিখতে দেখলেই মা উদ্বিগ্নবােধ করেন। ভাবেন নিষিদ্ধ কিছু বােধ হয় লিখছি।
আমি দু’হাতে লেখাটা ঢেকে বললাম, আমার যা মনে আসছে লিখছি তুমি পড়বে না ।
‘উপুর হয়ে লেখালেখি করবি নাতাে ফিগার খারাপ হয়ে যায়।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
প্লীজ তুমি যাওতাে মা।’ মা মুখ কালাে করে চলে গেলেন। তবে তার মন পড়ে রইল ডাইরিতে। না জানি তার কন্যা কী গােপন কথা লিখে ফেলেছে। এই গােপন কথা জানার জন্যে মা কোন না কোন সময়ে তাঁর কন্যার ডাইরি পড়বেন। আমার ধারণা আজ রাতেই এই কাজটা করবেন। আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর চাবি দিয়ে আমার স্যুটকেস খুলে অতি দ্রুত পড়ে ফেলবেন। উত্তেজনায় এই সময় তাঁর নাক ঘামতে থাকবে। কান্ডটা করে তিনি যেন একটা শক পান সেই ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। দলকলস গাছ প্রসঙ্গে লিখতে লিখতে এক ফাকে কিছু নিষিদ্ধ গােপন কথা জুড়ে দিয়েছি।