হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-১১)

তার একটা লাইন খুব ভাল করে কাটা যাতে মা কিছুতেই  সেই লাইনের পাঠোদ্ধার করতে না পারেন। মা জানবেন না কী লেখা হয়েছিল, ছটফট করতে থাকবেন।

হুমায়ুন আহমেদ রুমালী

আমি লিখেছি— দলকলস মধু আজ ভােমরার যত ফুল থেকে মধু খেয়েছি। দুপুরের দিকে একা একা হাঁটছিলাম তখন সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। খুব চমৎকার একজন মানুষ । হ্যান্ডসাম, বুদ্ধিমান। আমরা দু’জন অনেক গল্প করলাম। উনিই গল্প করলেন, আমি শুধু শুনে গেলাম। উনি আবার গাছপালা খুব ভাল চেনেন। আমাকে স্বর্ণলতা চিনিয়ে দিলেন— তারপর চিনিয়ে দিলেন দলকলস গাছ। এই গাছ থেকে কীভাবে মধু পান করতে হয় তাও শেখালেন। তারপর নিজেই একগাদা ফুল এনে দিলেন। আমি ফুল থেকে মধু খাচ্ছি উনি হঠাৎ বললেন— এই রুমালী তােমাকে ঠিক ভােমরার মত লাগছে। ভােমরা যেমন ফুলের মধু খায় তুমিও খাচ্ছ—তাই। উনি আমাকে রুমালী ডাকেন। তবে সবার সামনে না, আড়ালে । সবার সামনে আমাকে বকুল বলেন এবং আপনি করে ডাকেন। আমি তাকে বলেছি– সবার সামনে আমাকে আপনি বলার দরকার কী ? আমিতাে সিনিয়ার কোন ম্যাডাম না, আমার বয়স মাত্র সতেরাে। উনি বললেন, আঠারাে হােক তখন সবার সামনে তুমি বলব। কে জানে এই কথাটার মানে কী ? আমি বড়দের সব কথা বুঝতে পারি না। দেখি একবার কায়দা করে মাকে জিজ্ঞেস করব। মাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। তিনি অনেক কিছু সন্দেহ করবেন। 

এইটুক লিখে আরাে দুটা লাইন লিখে খুব ভালমত কালি দিয়ে কেটে দিয়েছি । পরিষ্কার বুঝতে পারছি পড়ার পর মার ঘাম দিয়ে জ্বর এসে যাবে। বুক ধড়ফড় করতে থাকবে। এমনও হতে পারে তার জিবের নীচে এনজিস্টও দিতে হতে পারে। আমি চাচ্ছি আজ রাতেই মা ডাইরিটা পড়ুক। কাজেই আমি আজ যা করব তা হচ্ছে ডাইরিটা সুটকেসে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রাখতে ভুলে যাব। 

মা এখন কফি খাচ্ছেন এবং আড়ে আড়ে আমাকে দেখছেন। কফি নিশ্চয়ই পাপিয়া ম্যাডামের জন্যে বানানাে হয়েছিল। রাতের খাবারের দেরি হবে সে জন্যেই কফি। খবর পেয়ে মা নিজের কন্যার জন্যে নিয়ে এসেছেন। আমি যেহেতু কফি খাই না –তিনি নিজেই চুকচুক করে খাচ্ছেন। ইউনিটে কোন একটা খাবার রান্না হলে– মা তা খাবেন না— তা কখনাে হবে না। মা কফি খেতে খেতে 

জালালের মা’র সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন। 

জালালের মা একজন এক্সট্রাতিনি আমাদের ছবিতে কাজের বুয়ার চরিত্রে অভিনয় করবেন । রিটায়ার্ড পুলিশের বড় কর্তার বাসায় এই বুয়া ছােটবেলা থেকে আছে। ছুটি কাটাতে সবাই যখন এসেছে বুয়াকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছে । 

জালালের মা রাতে আমাদের ঘরে থাকেন । আমরা সবাই থাকি দুর্গাপুর পি, ডাবলিউ, ডি, রেস্ট হাউসে। আমাদের ঘরে দুটা খাট। একটা খাটে আমি আর মা—আরেকটা খাটে জালালের মা। রাত্রে আমি ঘুমিয়ে পড়ি, মা এবং জালালের মা সহজে ঘুমান না, তাদের গল্প চলতেই থাকেফিসফিস গুজগুজ ! জালালের মা ছবির জগতের সব স্ক্যান্ডালের গল্প জানেন। বলার সময় এমন ভাবে বলেন যেন ঘটনাটা তার নিজের চোখের সামনে ঘটেছে। মা প্রতিটি গল্প খুব আগ্রহের সঙ্গে শােনেন এবং প্রতিটি গল্পই বিশ্বাস করেন। অবিশ্বাস্য গল্পগুলিই বেশি বিশ্বাস করেন । 

এখন যে গল্প হচ্ছে আমি তা শুনতে পাচ্ছিযদিও গল্প ফিসফিস করে বলা হচ্ছেআমার কান খুব পরিষ্কার। মশারা যদি কথা বলতে পারত তাহলে মশাদের গুনগুন কথাও শুনতে পেতাম। 

বুঝছেন আপা – টেকনাফে আউটডাের পড়ছে । চিত্রা প্রডাকশানের ছবি ডাকু সর্দারনায়িকা হলেন মহুয়া ম্যাডামম্যাডামের প্রথম ছবিপ্রথম ছবিযখন করে তখন ম্যাডামদের মাথার ঠিক থাকে নাকী করে না করে নিজেও বুঝে নামাথার মধ্যে থাকে ছবির জগতে যখন আছি তখন উল্টা পাল্টা কাজ করাই লাগবেবুঝছেন আপা মনে হলে এখনাে গায়ের লােম খাড়া হয়ে যায়ছিঃ ছিঃ ছিঃ।‘ 

জালালের মা গলা আরাে নিচু করে ফেলল । আমি দেখি মায়ের মুখ হা হয়ে গেছে চোখ বড় বড় যেন এমন আনন্দময় গল্প তিনি কখনাে শােনেন নিতার কর্ণ আজ স্বার্থক | সন্ধ্যাবেলা ম্যাডাম চা খেতে গিয়েছেন, ব্লাউজের দুটা হুক খােলা, ইচ্ছা করে খােলা। ব্লাউজের নীচে ইয়েও নেই। গরম বেশি বলে পরেন নিকারণ ছাড়াই ম্যাডামের হাহা হিহি হাসিএকেকবার হাসেন আর কাঁধ থেকে শাড়ির 

আঁচল পড়ে যায় । 

গল্পে বাধা পড়ল। সােহরাব চাচা এসে বললেন, মিস রুমাল— যাও স্যার ডাকছেন। 

আমি উঠে দাঁড়াবার আগেই মা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। 

সােহরাব চাচা বললেন, ভাবী আপনার যাবার দরকার নেই স্যার কালকের শুটিং কী হবে বুঝিয়ে দেবেন। 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *