হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-১২)

মা বললেন, সর্বনাশ, আমাকে থাকতেই হবে। বকু কিছু মনে রাখতে পারে । আমাকেই সব মনে রাখতে হবে।হুমায়ুন আহমেদ রুমালী 

আসুন তা হলে। দেরি করবেন না।’ মা বললেন, দেরি হবে না। এখনই আসছি। 

সােহরাব চাচা ঘর থেকে বের হতেই মা বললেন, বকু চুল আচড়ে চট করে কপালে একটা টিপ দিয়ে নে ।। 

আমি বললাম, আমিতাে শুটিং এ যাচ্ছি না মা। স্ক্রীপ্ট বুঝতে যাচ্ছি । ‘ফকিরনীর মত যাবি ? উনি কী ভাববেন ? ‘সেজেগুজে গেলেই তাে অনেক কিছু ভাবার কথা । 

তার মানে? 

উনি ভাবতে পারেন আমি তার সঙ্গে প্রেম করতে চাচ্ছি। তাকে ভলাতে চাচ্ছি।’ 

মা হতভম্ব হয়ে গেলেন। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল । জালালের মা যেখানে বসেছিলেন সেদিকে তাকালেন। কিছুটা স্বস্তি পেলেন। জালালের মা নেই। সােহরাব চাচাকে ঢুকতে দেখেই তিনি চলে গেছেন। এই মহিলা সােহরাব চাচাকে যমের মত ভয় করেন। মা বললেন, এ রকম কথা তুই কীভাবে বললি? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

আমি বললাম, ভুলতাে মা বলি নি। মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করার দিকে তােমার মঈন ভাইয়ের ঝোঁক আছে। দেখ না এখন পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে প্রেম করছেন। 

‘তুই এমন কুৎসিত কথা বলছিস কীভাবে! ‘প্রেম কুৎসিত হবে কেন মা? 

* আর একটা কথা বলবি তাে টেনে জিভ ছিড়ে ফেলব। বাদরামী যথেষ্ট করেছিস।। 

আমি কথা বাড়ালাম না। চুল আঁচড়ালাম, কপালে টিপ দিলাম। মা অতি দ্রুত তার শাড়ি পাল্টালেন । মুখে পাউডার দিলেন। ঠোটে লিপস্টিক দিলেন। 

‘এই বকু আমাকে কেমন দেখাচ্ছে ? 

আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, খুব ভাল দেখাচ্ছে । উনি যদি তােমার প্রেমে পড়ে যান আমি মােটেও অবাক হব না। তােমাকে রাণীর প্রিয় সখীর মত দেখাচ্ছে। | মা আচমকা আমার গালে চড় বসালেন। তারপর বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমাকে নিয়ে রওনা হলেন যেন কিছুই হয় নি। 

ডিরেক্টর সাহেব তার ঘরে একা বসে আছেনপায়জামা পাঞ্জাবি পরেছেন বলে তাকে প্রফেসর প্রফেসর লাগছে। তার চুল সুন্দর করে আঁচড়ানাে মনে হয় কিছুক্ষণ আগে গােসল করে চুল টুল আঁচড়ে ভুদ্র হয়েছেন। গা থেকে হালকা মিষ্টি গন্ধও আসছে আফটার শেভ এর গন্ধ হতে পারে। মুখে মাখা ক্রীমের গন্ধ হতে পারেআবার সাবান দিয়ে গােসল করা হলে সাবানের গন্ধও হতে পারে।

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

আমার নাক কুকুরের নাকের মতখুব তীক্ষ্ণ| আজ তাঁকে অল্প বয়স্ক মনে হচ্ছে কারণ চুলে কলপও দিয়েছেনচুলে কলপ দেয়া স্টেজে যারা চলে যান তাদের দেখতে খুব মজা লাগেবুড়ােটে ধরনের মানুষ হঠাৎ একদিন দেখা যায় কুচকুচে কালাে চুলের একজন মানুষ। হাব ভাব যুবকের মতএরা আবার রঙ চঙে সার্ট পরতেও ভালবাসে চুলে যেমন কলপ লাগায়— মনেও খানিকটা লাগায় । 

বকুল এবং বকুল মাতা গেট সীটেড বসে পড়ুন। 

আমরা সামনের খাটে বসলামমা বললেন, ভাই সাহেব কেমন আছেন? ইস্ আপনার উপর খুব কাজের চাপ যাচ্ছে। আপনাকে দেখি আর অবাক হইএকটা মানুষ এত কাজ কীভাবে করেআমি বকুলকে বলছিলাম তাের চাচাকে দেখে শেখ, কর্মযােগী কাকে বলেসকাল বিকাল দু’বেলা উনার পায়ের ধুলা নিয়ে কপালে ঘষবি এতে যদি কপালের উনিশ বিশ হয়। যে কপাল নিয়ে জনেছিস সে কপালে কিছু হবে নাতাের বাবা থেকেও নেইএখন ওর মুরুব্বী বলতেও আপনি, বাবা বলতেও আপনি। 

 ডিরেক্টর সাহেব শান্ত ভঙ্গিতে শুনে যাচ্ছেন উনি রাগ করছেন কিনা বুঝতে পারছি নামনে হয় রাগ করছেন নামা’স্বভাব তিনি জেনে গেছেনএই স্বভাবের মানুষের উপর রাগ করা যায় নাআমি ডিরেক্টর সাহেব হলে রাগ করতাম না। বরং মনে মনে হাসতাম । 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

মা কথা বলেই যাচ্ছেন! থামছেন নামা চুপ করতাে”- বলে মাকে আমি থামাতে পারিইচ্ছে করছে না। যার থামাবার সে থামাবে আমার কী

মঈন ভাই আমার মেয়ের গলায় একটা গান কিন্তু আপনার ছবিতে রাখতে হবে। আপনার কাছে আমার রিকোয়েস্টদুই লাইনের একটা গান হলেও তার গলায় রাখবেনসবচে ভাল হয় নিজের গান সে যদি নিজে গায়আপনি ওর গান শুনে দেখুন । যদি পছন্দ না হয় তখন প্লে ব্যাক সিঙ্গার নেবেন ভাই আমার মেয়ের একটা গান আপনি শুনে দেখুন পথহারা পাখি গানটা সে কী সুন্দর যে গায়বকু, চাচাকে গানটা গেয়ে শােনা। 

ডিরেক্টর সাহেব হাসলেন। আমি ভদ্রলােকের ধৈর্য দেখে অবাক হলাম । ভদ্রলােকের হাসি দেখে মনে হতে পারে উনি এখনই বলবেন— বকুল শােনাও তােমার পথ হারা পাখি গান। আমি জানি তিনি তা করবেন না । আমার গানের প্রতি তার আগ্রহ নেই। আমার গান এই ছবির জন্যে প্রয়ােজন নেই। চিত্রনাট্যে কোথাও নেই দিলু গান করছে। 

 ‘মঈন ভাই– পান খাবেন? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

‘জি না, পান খাব না। আপনার কন্যার গানও আজ শুনব না। অন্য একসময় শুনব।’ 

‘কতক্ষণ আর লাগবে। ছােট গান, একটা মাত্র অন্তরা।’ | ‘গান হচ্ছে মুডের ব্যাপার। আজ মুড নেই। কাল সকাল থেকে শুটিং হবে—- আমি আপনার মেয়ের সঙ্গে সেই বিষয়ে কিছু কথা বলি। | মা হতাশ গলায় বললেন, জ্বি আচ্ছা বলুন । কিন্তু মঈন ভাই ওর গান কিন্তু আপনাকে শুনতে হবে। মশলা খাবেন ? পানের মশলা ? 

না মশলাও খাব না। আপনি এক কাজ করুন– নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন, কিংবা রান্না বান্না কেমন এগুচ্ছে একটু দেখুন। আমি একা আপনার কন্যার সঙ্গে কথা বলব।’ 

মা’র মুখ শুকিয়ে গেল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি অতি দ্রুত কিছু যুক্তি দাড়া করাবার চেষ্টা করছেন যে যুক্তিতে মেয়ের সঙ্গে থাকতে পারেন। কোন যুক্তি তার মাথায় আসছে না। মা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, আচ্ছা। মা বের হয়ে যাচ্ছেন তার হতাশ ভঙ্গিতে চলে যেতে দেখে আমার খারাপ লাগছে। ডিরেক্টর সাহেব নিশ্চয়ই এমন কোন কথা বলবেন না যা আমার মায়ের সামনে বলা যায়। না। তিনি থাকলে কোন ক্ষতি ছিল না। মা বেশি কথা বলেন তা ঠিক— মা’কে চুপ করে থাকতে বললেই তিনি চুপ করে যেতেন। 

বকুল।’ 

‘কেমন আছ তুমি বল। ‘ভাল আছি। ‘গ্রাম কেমন লাগছে ? 

ভাল লাগছে।* চিত্রনাট্যটা কি মন দিয়ে পড়েছ?’ 

চিত্রনাট্য তােমার কাছে কেমন লেগেছে ? ‘ভাল।’ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *