এই ছবি কি বাংলাদেশের মানুষ দেখবে ?
না।’ না কেন? ছবিতে নাচ-গান নেই এই জন্যে ? ছবির গল্পটা খুব জটিল। ছবির গল্প তােমার কাছে জটিল মনে হয়েছে ? ‘জি। ‘তােমার নিজের চরিত্রটা কি তােমার পছন্দ হয়েছে ?
দিলুকে তােমার পছন্দ হয়েছে ? * জ্বি হয়েছে।’ ‘তুমি কি দিলুর মত ? “না আমি দির মত না। ‘এখন তুমি বল– দিলু কেমন ? ‘দিলু খুব নিঃসঙ্গ একটা মেয়ে। একা একা থাকে। তার কিছুই ভাল লাগে — খুব দুঃখী মেয়ে।
না ঠিক হল না। আর দশটা পনেরাে-ষােল বছরের মেয়ে যেমন দিলুও তেমন। দিলু আলাদা কেউ না। দিলুর শেষ পরিণতিটা খুব দুঃখময় বলে তুমি তাকে দুঃখী মেয়ে ভাবছ । সে সবার সঙ্গে হাসছে, খেলছে, গল্প করছে– ছুটি কাটাতে এসে মজা করছে। তারপর এক সময় তার জীবনে ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল । এমন একজনের প্রেমে পড়ে গেল যে বয়সে তারচে অনেক অনেক বড়। যাকে তার প্রেমের কথাটা সে বলতেও পারছে না। এইটাই তার সমস্যা। এর বাইরে তার কোন সমস্যা নেই। ঠিক বলছি ?
‘জি।
‘দিলু মেয়েটার যে সহজ স্বাভাবিক জগৎ ছিল, প্রেমে পড়ার পর তার সেই জগৎ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল । সে পুরােপুরি হকচকিয়ে গেল। তাই না ?
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
‘জ্বি। ‘বকুল তুমি কি কখনাে প্রেমে পড়েছ ? ‘জ্বি না।’
‘প্রেমে পড়লে আমাদের জন্যে সুবিধা হত। তােমার জন্যেও অভিনয় করতে সুবিধা হত।’
ডিরেক্টর সাহেব মিটিমিটি হাসছেন। কেন হাসছেন আমি বুঝতে পারছি না। তিনি সিগারেট ধরালেন। কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট ছুঁড়ে ফেলবেন, আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি। তিনি সিগারেট ফেললেন না। সহজ ভঙ্গিতে টেনে যেতে লাগলেন। সম্ভবত আজ তিনি আর সিগারেট ফেলবেন না। মনে হচ্ছে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর তার কর্মকান্ড নির্ভর করে।
তাকে এখন কেউ দেখছে না— তাকে ঘিরে ভিড় জমে নেই কাজেই তিনি সিগারেট ফেলছেন না। বকুল। ‘জ্বি স্যার। ‘মেয়েটা এমন বয়স্ক একজন মানুষের প্রেমে কেন পড়ল ? জানি না। চিত্রনাট্যে সেটা উল্লেখ করা হয় নি। ‘তােমার কী ধারণা সেটা বল ? ‘আমার কোন ধারণা নেই।‘ ‘বয়ােসন্ধির পর মেয়েরা হঠাৎ খানিকটা অসহায় বােধ করতে থাকে। তাদের মধ্যে লতা ধর্ম প্রবল হয়ে ওঠে ….
লতা ধর্মটা কী ? | ‘লতা ধর্ম হচ্ছে– লতানাে গাছের ধর্ম। লতানাে গাছ কী করে? আশে পাশে শক্ত কোন গাছের খোজ করে । পনেরাে-ষােল বছরের মেয়েদের মধ্যে লতা ধর্ম যখন প্রবল হয়ে দেখা দেয়, প্রেমটা তখনি আসে। কার প্রেমে পড়ল, তখন সে আর ভেবে দেখে না।‘
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমি হেসে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে গেলাম । প্রেম সম্পর্কে এমন সহজ ব্যাখ্যা এর আগে কেউ বােধ হয় দেয় নি।
‘হাসছ কেন ? ‘এম্নি হাসছি।
‘আমার ব্যাখ্যা খুব বেশি সরল বলে হাসছ ? যে ব্যাপারটা বাইরে থেকে যত জটিল মনে হয় তার ব্যাখ্যা কিন্তু তত সহজ। পনেরাে ষােল বছরের মেয়েরা কাদের প্রেমে পড়ছে সেই স্ট্যাটিসটিকস যদি নাও তাহলে অনেক মজার ব্যাপার দেখবে। এই সময়ে তারা যাদের সংস্পর্শে আসছে তাদেরই প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। প্রাইভেট মাস্টারের সঙ্গে প্রেম হচ্ছে কারণ সে তাকে পড়াতে আসছে। গানের মাস্টারের সঙ্গে প্রেম হচ্ছে, তার সঙ্গে তার যােগাযােগ হচ্ছে। বড় ভাইয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম হচ্ছে। এমন কি বাবার বন্ধুর সঙ্গেও প্রেম হচ্ছে। কারণ বাবার বন্ধু মাঝে মাঝে বাসায় আসেন। তার সঙ্গে কথা হয়। সেই সময়কার প্রেমটা অন্য রকম । হিসাব নিকাশের বাইরের প্রেম।
আমি কিছু বলব না, বলব না করেও বলে ফেললাম— হিসাব নিকাশের বাইরের প্রেম মানে কী?
প্রেমের পরিণতি কী হবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা মানেই হিসাব নিকাশ। পরিণতি নিয়ে চিন্তা ভাবনা ছাড়া প্রেম মানে হিসাব নিকাশহীন প্রেম । বুঝতে পারছ ? ‘না।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
না বােঝার মত কিছু না। আমাদের ছবির মেয়ে দিলুর প্রেম হিসাব নিকাশ হীন প্রেম। প্রেমের পরিণতি নিয়ে সে কখনাে ভাবে নি । সে অন্ধের মত প্রেমে পড়েছে।
পরিণতি নিয়ে না ভাবলে সে আত্মহত্যা করে কেন ?’
আত্মহত্যাটাও তার প্রেমেরই একটা অংশ। সে তার আবেগের তীব্রতাটা সবাইকে দেখাতে গিয়ে এই কান্ডটা করেছে। এই বয়সের প্রেমে একটা দেখানাের ব্যাপারও থাকে। দেখ আমি কী করে ফেললাম এই ভাব।
আমি বললাম, স্যার আমার সে রকম মনে হচ্ছে না। | তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, তােমার কী মনে হচ্ছে ?
আমার মনে হয় মেয়েটা হঠাৎ তার নিজের ভেতরের প্রেম ভাল মত লক্ষ্য করে। তার তীব্রতা দেখে সে হকচকিয়ে যায়। সে সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
তিনি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হাসলেন । প্রশ্রয়ের হাসি । ছােট বাচ্চারা হঠাৎ জ্ঞানীর মত কথা বলে উঠলে বড়রা যেমন হাসে তেমন হাসি। তবে আমার কথার তেমন গুরুত্ব দিলেন না।
বকুল !’ ‘জ্বি স্যার।
চিত্রনাট্যর কোন অংশটা তােমার কাছে খুব সুন্দর মনে হয়েছে ? ‘দিলু যে মাঝে মাঝে খুব সুন্দর করে সাজে তারপর পুকুরের কাছে যায়। পুকুরের জলে নিজেকে দেখে এবং নিজের সঙ্গে কথা বলে এই দৃশ্যটা।
‘সেই দৃশ্যটা আমরা কাল করব । এই দৃশ্য দিয়ে শুরু । তুমি দৃশ্যগুলি আজ রাতে খুব ভাল মত পড়বে । শােবার আগে ভাববে। আমি দৃশ্যগুলি কী ভাবে নেব ভেবে রেখেছি— তােমার মাথায় যদি কিছু থাকে তাও আমাকে বলবে।
‘জ্বি আচ্ছা। | ‘এই ছবির আসল নায়িকা কে তুমি কি জান ?‘
‘জানি, দিলু।‘