‘হ্যা এই কিশােরী মেয়েটিই ছবির নায়িকা । পাপিয়া ব্যাপারটা জানে না। তার ধারণা সেই ছবির নায়িকা। তাকে সে রকম বলাও হয়েছে। চিত্রনাট্য সে পড়ে নি। তাকে চিত্রনাট্য পড়তেও দেই নি। চিত্রনাট্য পড়লে সে খুব হৈ চৈ করত। আচ্ছা তুমি যাও –
তিনি যা বললেন কিন্তু আমি আগের জায়গাতেই বসে রইলাম । আমার কেন জানি উঠতে ইচ্ছা করছে না। তিনি বললেন— কিছু বলবে ?
জ্বি না।‘ তিনি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। তাঁকে হঠাৎ খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি অন্য কিছু ভাবছেন। আমি যে তাঁর সামনে বসে আছি তা আর তার মনে নেই । ঘরে মসকুইটো কয়েল জ্বলছে। ধোয়ায় নাক জ্বালা করছে।
বকুল! আচ্ছা দেখি তােমার বুদ্ধি।‘
তিনি নড়েচড়ে বসলেন এবং হাসি মুখে তাকালেন। তার চোখে চাপা আনন্দ ম্যাজিশিয়ান মজাদার কিছু করার আগে মনে হয় এই ভাবেই দর্শকদের দিকে তাকায়।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
‘গল্পটা মন দিয়ে শােন—একটা হাতি এবং একটা পিঁপড়ার গল্প। একটা পিপড়া মােটর সাইকেলে করে যাচ্ছিল। একটা হাতি আসছিল উল্টা দিক থেকে। পিপড়া ব্যালেন্স হারিয়ে মােটর সাইকেল নিয়ে হাতির গায়ে পড়ল। বিরাট এ্যাকসিডেন্ট। মজার ব্যাপার হচ্ছে এ্যাকসিডেন্টে পিপড়ার কিছু হল না—শুধু হাতিটা আহত হল। এখন বল কেন এ্যাকসিডেন্টে পিপড়ার কিছু হল না?‘
আমি বললাম, জানি না। | ‘খুব সহজ উত্তর। পিপড়াটার মাথায় হেলমেট পরা ছিল। পিপড়া ছােট প্রাণী হলেও, ট্রাফিক রুল মেনে চলে। হেলমেট ছাড়া মােটর সাইকেল নিয়ে বের হয় না।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমি ভেবেছিলাম জবাবটা দিয়ে তিনি তার স্বভাব মত হাে হাে করে হাসবেন। তিনি হাসলেন না বরং খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলেন । সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন—
আহত হাতিকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। সেখানে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। দেখা গেল আহত হাতি এবং পিপড়া পাশাপাশি বেড়ে শুয়ে আছে।
এখন তুমি বল– পিঁপড়াটারতাে কিছু হয় নি । সে কেন হাতির বেডের পাশে শুয়ে আছে ? জানি না।‘ ‘পিঁপড়া শুয়ে আছে কারণ পিপাড়াটা হাতিকে রক্ত দিচ্ছিল। তাদের দুজনের একই গ্রুপের রক্ত ও পজিটিভ তিনি এবারে গলা খুলে হাসছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে তার ছেলেমানুষি হাসি দেখছি । আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার হাসি আমার শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে । আমার শরীর ঝমঝম করছে ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
শরীরের ভেতরটা কাপছে । আমার ইচ্ছা করছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু উঠতে পারছি না। এমন সময় সােহরাব চাচা ঢুকলেন । ডিরেক্টর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন-~~ আমি নেত্রকোনা যাচ্ছি। আপনার কিছু লাগবে ?
ডিরেক্টর সাহেব বললেন, নেত্রকোনায় এক ধরনের মিষ্টি পাওয়া যায় নাম হচ্ছে বালিস। মিষ্টিটার শুধু নাম শুনেছি কখনাে খেয়ে দেখি নি। যদি পাও নিয়ে এসাে। ‘রান্নাও হয়েছে, খাবার দিতে বলি?
ডিরেক্টর সাহেব বললেন—— দিতে বল। পাপিয়াকে জিজ্ঞেস কর—– সে কি সবার সঙ্গে খাবে, না তার খাবার আলাদা দেয়া হবে ?
‘ম্যাডাম বলেছেন উনি রাতে কিছু খাবেন না। ‘সেকী ?
‘ম্যাডাম খেতে চেয়েছেন বলেই খাসি কিনে এনে রেজালা করা হয়েছে । পােলাও এর চালের ভাত করা হয়েছে। স্যার আপনি একটু বলে দেখবেন ?
‘খাবে না কেন কিছু বলেছে ?‘
উনার নাকি শরীর ভাল না। উনি দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছেন। ‘ভাল যন্ত্রণা হল দেখি।’
ফরহাদ সাহেবও এখনাে এসে পৌছালেন না। উনাকে ছাড়া শুটিং শুরু হবে কীভাবে ? কাউকে কি পাঠিয়ে দেব ? রাতে খেয়ে গাড়ি নিয়ে ঢাকা চলে যাবে উনাকে নিয়ে চলে আসবে।’
ডিরেক্টর সাহেব চিন্তিত মুখে বের হয়ে গেলেন। কিছু না বললেও বােঝা যাচ্ছে তিনি পাপিয়া ম্যাডামের ঘরের দিকে যাচ্ছেন। আমার কেন জানি খুব ইচ্ছা করছে পাপিয়া ম্যাডামের রাগ কীভাবে ভাঙ্গানাে হয় সেই দৃশ্য দেখি । ডিরেক্টর সাহেবের পেছনে পেছনে যাই । সােহরাব চাচা বললেন, মিস রুমাল চল খেতে চল । আমি বললাম, চলুন।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
মা নিশ্চয়ই মুখ গম্ভীর করে তার ঘরে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি যাওয়া মাত্র ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে আমার কী কী কথা হল সব শুনবেন। কোন | কিছুই বাদ দেয়া যাবে না। কোন কোন জায়গা দু’বার তিনবার করে ও শুনাতে হবে । মা‘র সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি সােহরাব চাচার সঙ্গে সরাসরি ডাইনিং রুমে চলে গেলাম।
খাওয়া শুরু হয়ে গেছে। গণ খাবারের কায়দা কানুন অন্য রকম— প্লেট হাতে যেতে হয় বাবুর্চির কাছে। বাবুর্চি তার লােকজন নিয়ে বসে থাকেন । তাঁর সামনে বিরাট বিরাট ডেকচিতে ভাত, তরকারি, ভাজি, সালাদ। বড় বড় চামুচে প্লেটের উপর খাবার তুলে দেয়া হয়। থালা উপচে আগুন গরম খাবার পড়ে যেতে থাকে। সেই খাবার গবাগব করে খাওয়া হয়। পুরাে ব্যাপারটায় পিকনিক পিকনিক ভাব থাকে। আমার খুব ভাল লাগে। |
ডাইনিং রুমে সবাই আছেন। শুধু মা আর জালালের মা নেই। মা নিশ্চয়ই আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আর জালালের মা, মা’কে এই ফাকে কয়েকটা ভয়ংকর টাইপ গল্প শুনিয়ে ফেলছে। আমাদের এই ডিরেক্টর সাহেবকে নিয়েও অনেক গল্প নিশ্চয়ই জালালের মা জানেন। তার কাছ থেকে কিছু গল্প শুনতে হবে। মা’কে না জানিয়ে শুনতে হবে ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
তরকারির রঙ খুব সুন্দর হয়েছে। আমি প্লেট হাতে খাবার নিয়ে নিলাম । ধোয়া ওঠা পােলাওয়ের চালের ভাত— সুন্দর গন্ধ আসছে ভাত থেকে । খাসির গােসতের রেজালা। রেজালা দেখেই বােঝা যাচ্ছে— খেতে খুব ভাল হবে । পাপিয়া ম্যাডাম যদি খেতেন, রেজালার রেসিপি চাইতেন ।
কেয়ামত ভাই হাসি মুখে বললেন— আপা, মা কই ? আমি বললাম, মা আসবে । আমার খুব ক্ষিধে লেগেছে আমি আগে খেয়ে
নেব!
আজ এক তরকারির খানা! সালাদ নেন।
না সালাদ নেব না।‘ ডাইনিং রুমে চেয়ার টেবিল আছে। চেয়ার টেবিলে সবার জায়গা হয় না । অলিখিত নিয়ম হচ্ছে শিল্পীরা চেয়ার টেবিলে বসবেন— বাকিরা প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে খাবেন— বুফে সিস্টেম । তবে আমাদের ডিরেক্টর সাহেবের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এই দেখা যায় তিনি চেয়ার টেবিলে বসেছেন— আবার দেখা যায়। দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন।