একবার দেখি ফকিরদের মত মাটিতে ল্যাপচা মেরে বসে খাচ্ছেন | সােহরাব চাচা কোত্থেকে পুরানাে খবরের কাগজ এনে বললেন— স্যার এর উপর বসুন। তিনি বললেন—— লাগবে না। লাগবে না। সােনার বাংলার স্বর্ণ ধুলি গায়ে মেখে নিচ্ছি । তার এই কথায় আসে পাশের সবাই হাসল। ডিরেক্টর সাহেব যাই বলেন তাতেই মজা পেয়ে সবাই হাসে। তিনি রসিক মানুষ হিসেবে পরিচিত । আমার নিজের ধারণা তিনি পদাধিকার বলে রসিক । ডিরেক্টর না হয়ে তিনি যদি ক্যামেরা ম্যানের এসিসটেন্ট হতেন তাহলে তাঁর রসিকতায় কেউ হাসত না। বরং তার কাজ কর্মে সবাই বিরক্ত হত।
আমি প্লেট নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে যাচ্ছি হঠাৎ দেখি ঘরের এক কোণায় সেলিম ভাই দাঁড়িয়ে। তাঁর হাতে খাবারের প্লেট । তিনি মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। আজ তার গায়ে পাঞ্জাবি। তিনি একটামাত্র সার্ট প্যান্ট নিয়ে এসেছিলেন আজ পাঞ্জাবি পেলেন কোথায় ? আমি হাসিমুখে ডাকলাম— সেলিম ভাই ।
তিনি এমন ভাবে চমকে উঠলেন যে আরেকটু হলে হাত থেকে প্লেট পড়ে গিয়ে বিশ্রী কান্ড হত । নায়িকার হাত থেকে প্লেট পড়ে ভেঙ্গে যাওয়া মজার ব্যাপার। সবাই তাতে মজা পায়। প্রােডাকশন ম্যানেজার আনন্দে হেসে ফেলেন। এক্সট্রা মেয়ের হাত থেকে প্লেট পড়ে গেলে সবাই কটমট করে তাকায় ।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
প্রােডাকশন ম্যানেজার চাপা গলায় ধমক দেন। ধমক চাপা গলায় হলেও সবার কানে যায় । আমি হাসি মুখে ডাকলাম, সেলিম ভাই এদিকে আসুন। প্লেট হাতে সেলিম ভাই বিব্রত ভঙ্গিতে আসছেন। তার অস্বস্তি দেখে মনে হচ্ছে– বেচারাকে ডাকলেই হত। নিজের মনে আরাম করে খেতে পারতেন। বসুন। আসুন আমরা গল্প করতে করতে খাই।
সেলিম ভাই অসহায় ভাবে চারদিকে একবার দেখলেন। আমার পাশে বসে খাওয়াটা ঠিক হবে কি-না বুঝতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে বসলেন আমার পাশে। সব দ্বিধা অবশ্যি ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। তার চোখে খানিকটা মুখে লেগে রইল ।
‘সেলিম ভাই কেমন আছেন ?’ ‘ভাল।
কী রকম ভাল ? অল্প ভাল না অনেক খানি ভাল ? ‘অল্প ভাল।’ ‘এক বস্ত্রে এসেছিলেন— আজ দেখি গায়ে পাঞ্জাবি। ‘সার্ট প্যান্ট ধুয়ে দিয়েছি।’
‘ভাল করেছেন। ডিরেক্টর সাহেব কী জানেন যে আপনি তার কথামত তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছেন?’ জ্বি। আগে মনে করেছিলাম কিছু জানেন না। এখন বুঝেছি জানেন। ‘কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে? ‘জ্বি। ‘কখন কথা হল ? ‘আজ সন্ধ্যায়।‘ ‘কী কথা হল ?
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সেলিম ভাই বিব্রত স্বরে বললেন, আমি একটা বিরাট ঝামেলায় পড়েছি। কী ঝামেলা ?‘ ‘আপনাকে আমি বলব।‘ ‘বলুন শুনি। ‘এখন বলব না। এখানে অনেক লােকজন। ‘কখন বলবেন? ‘আজই বলব । আমি মস্তবড় একটা ঝামেলায় পড়েছি। জীবনে এতবড় ঝামেলায় পড়ি নি।’ ‘খুব চিন্তিত ? ‘জ্বি।
‘আচ্ছা ঠিক আছে–— আপনার ঝামেলার কথা শুনব— এখন চুপচাপ খেয়ে যান। খাবারটা ভাল হয়েছে না! ‘জ্বি হয়েছে।‘ ‘রেসিপি লাগবে ? লাগলে বলুন। ‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না।‘
আমি হেসে ফেললাম— আর তখনি মা ঢুকলেন । তিনি আমাকে খেতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। আমার পাশে সেলিম ভাইকে দেখে তাঁর মাথায় প্রায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হল । তিনি নিশ্চয়ই এর মধ্যেই আমার ডাইরি পড়ে ফেলেছেন। দুইয়ে দুইয়ে চার বানিয়ে বসে আছেন। মা খাবার নিয়ে আমার দিকে আসছেন। আমার কাছে তিনি বসতে পারবেন না, কোন চেয়ার খালি নেই। তাকে অনেকটা দূরে বসতে হবে।
তবে তিনি অন্য একটা কাজও করতে পারেন— হয়ত সেলিম ভাই এর কাছে এসে বলবেন, এই শােন তােমার নাম যেন কী ? তুমি ঐ চেয়ারটায় গিয়ে বােস। মা সামাজিক অবস্থান মাথায় রেখে তুমি আপনি বলেন । তিনি তাঁর রাডারের মত চোখ দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে ফেলেন মানুষটার সামাজিক অবস্থান কী। তখন তুমি আপনি নির্ধারিত হয়ে যায়। সেলিম ভাইকে তিনি শুরু থেকেই তুমি বলছেন।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
শুধু যে তুমি বলছেন তাই না— ছােট খাট কাজকর্মও তাকে দিয়ে করাচ্ছেন। গতকাল সকালেই তিনি সেলিম ভাইকে ডেকে বললেন— এই যে ছেলে শােন, আমার জন্যে একটা হাত পাখা নিয়ে এসাে। প্রােডাকশনের কাউকে বললেই হাত পাখা দিয়ে দেবে । মা আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই সেলিম ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি বসুন । মা বিনাবাক্যব্যয়ে বসে পড়লেন। সেলিম ভাই প্লেট হাতে আগের জায়গায় চলে গেলেন । মনে হল তিনি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন।
মা রাগে কাঁপছেন। আমি তার রাগ টের পাচ্ছি। রাগের প্রকাশ কীভাবে হবে বুঝতে পারছি না। ঘটনাটা বাসায় ঘটলে প্লেট ছুঁড়ে মারতেন আমার দিকে । আমার শরীর রেজালার ঝােলে মাখামাখি হয়ে যেত। প্লেটের কোণা লেগে কপাল কেটে রক্ত পড়ত। এখানে এ জাতীয় কিছু করা সম্ভব না। মা কাঁপা গলায় প্রায় ফিস ফিস করে বললেন—মঈন ভাইয়ের সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে ?
কী বললেন ?‘ ‘প্রেম কত প্রকার ও কী কী উদাহারণ সহ ব্যাখ্যা করলেন । মা কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি সহজ ভঙ্গিতে ভাত মাখতে মাখতে বললাম–– উনিতাে প্রেম বিশারদ। প্রেমের সব কিছু তিনি জানেন। ‘ফাজলামি করছিস কেন?‘ ‘ফাজলামি করছি না, যা সত্যি তাই বললাম। ‘আমি তাের জন্যে বসে আছি– তুই আমাকে না নিয়ে একা একা খেতে চলে এলি কী মনে করে?’ ক্ষিধে লেগেছিল চলে এসেছি।‘ | ‘তাের হয়েছে কী ? ‘কিছু হয় নি।
এই গাধাটা তাের সঙ্গে খাচ্ছে কেন ?
‘আমি ডেকে এনেছি বলে আমার সঙ্গে বসে খাচ্ছিলেন। কারাে সঙ্গে গল্প না করে আমি খেতে পারি না।‘