হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-১৬)

“গাধাটার সঙ্গে কী গল্প করছিলি

বার বার উনাকে গাধা বলছ কেন ? ‘যে গাধা আমি তাকে কী বলব ? হাতি বলব ?’ 

 ‘মা তুমি খাচ্ছ নাখাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে তুমি খেয়ে মজা পাবে না। খাসির রেজালাটা খুব ভাল হয়েছে । খাঁটি সরিষার তেলে রান্না হয়েছেতাে এই জন্যেখেয়ে তোমার যদি ভাল লাগে আমাকে বলবে আমি রেসিপি দিয়ে দেব | মা অাগুন চোখে তাকাচ্ছেনআমি তাকিয়ে আছি হাসি মুখে আমার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছেমা কিছুক্ষণ থাকুক একা একারেগে অস্থির হােকরেগে অস্থির হয়ে এক সময় মা ড্রাগনের মত হয়ে যাবে— তার নাক মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বের হতে থাকবেসেই পর্যায়ে আসুক তখন ঠান্ডা পানি ঢেলে মার রাগ কমানাের ব্যবস্থা করা যাবে

হুমায়ুন আহমেদ রুমালী

বকুল! 

‘মঈন ভাইয়ের সঙ্গে তাের কী কী কথা হয়েছে বল কোন কিছু বাদ দিবি । হাতি এবং পিপড়া সম্পর্কে অনেক কথা বললেন।’ হাতি এবং পিঁপড়া মানে?’ 

একটা হাতি এবং পিপড়া ছিল— তাদের হচ্ছে একই ব্লাড গ্রুপ, পজিটিভ‘তােকে এখন আমি সবার সামনে চড় মারব।’ ‘হাত ধুয়ে তারপর চড় মার মা। নয়ত গালে ঝােল লেগে যাবে।‘ 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

মা তাকিয়ে আছেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এবং মার চোখের সামনেই সেলিম ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালামমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবমাকে আমি আজ ড্রাগন বানিয়ে ফেলব । 

সেলিম ভাই আমাকে দেখে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালেনমা যেমন আমার কান্ডকারখানা বুঝতে পারছেন না, মনে হয় তিনিও পারছেন না। 

সেলিম ভাই!জ্বি‘ 

আপনি বলেছেন—-আপনি ভয়ংকর বিপদে পড়েছেনআমার ধারণা আমি বুঝতে পারছি আপনার বিপদটা কী?‘ 

বুঝতে পারছেন

‘া আমার ধারণা ডিরেক্টর সাহেব আপনাকে ডেকে বলেছেন-~~ সেলিম তুমি মন দিয়ে আমার কথা শােন, ফরহাদ সাহেবের যে চরিত্রটি করার কথা। | ছিল— সেই চরিত্রটা তুমি করবে। কাল তােমার শুটিং। 

সেলিম ভাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ বড় করা দেখেই বুঝতে পারছি আমার অনুমান সত্যি। তবে এই অনুমান করার জন্যে শার্লক হােমস বা মিসির আলি হবার দরকার নেই। সাধারণ বুদ্ধি যার আছে সেই এই অনুমান করবে। আগামীকাল শুটিং শুরু হচ্ছে অথচ ফরহাদ সাহেব আসেন নি। সেলিম নামের এই মানুষটিকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে ।

ডিরেক্টর সাহেবের মাথায় কোন একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই ছিল । উদ্দেশ্য ছাড়া তিনি কিছু করেন না । সাব্বিরের চরিত্রে সেলিম ভাইকে খুব মানাবে। ডিরেক্টর সাহেব স্ট্যান্ডবাই হিসেবেই সেলিম ভাইকে নিয়ে এসেছেন। আমি বললাম, আমার কথা কি ঠিক হয়েছে সেলিম ভাই ? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

‘খুব ভয় লাগছে? 

‘ভয় লাগছে কেন ?’ ‘আমি আমার জীবনে কখনাে অভিনয় করি নি। স্কুলে কলেজে কোথাও না। ‘আপনি কখনাে অভিনয় করেন নি? * জ্বি না।’ 

‘কথাটাতাে সেলিম ভাই ঠিক বলেন নি । মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই অভিনয় করতে হয়। সংসারে অভিনয় । কখনাে খুশি হবার অভিনয় করতে হয়, কখনাে দুঃখিত হবার অভিনয় করতে হয়। প্রেমে না পড়েও প্রেমে পড়ার অভিনয় করতে হয়। আবার প্রেম লুকিয়ে রাখার অভিনয় করতে হয়। আসলে প্রতিটি মানুষই জন্মসূত্রে পাকা অভিনেতা। 

‘আপনি খুব গুছিয়ে কথা বলেন। 

শুনুন সেলিম ভাই আপনার মুখ থেকে আপনি আপনি শুনতে আমার ভাল লাগছে না। আপনি দয়া করে আমাকে তুমি তুমি করে বলবেন। পারবেন না ? 

সেলিম ভাই চুপ করে আছেন। আমি মাথা ঘুরিয়ে মার দিকে তাকালাম । মা কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছু খাচ্ছেন না। আমার মনে হয় তিনি পুরােপুরি ড্রাগন হয়ে গেছেন । মা’র জন্যে আমার এখন মায়া লাগছে। আমি তাঁর রাতের খাবার নষ্ট করলাম। ইউনিটের খাওয়া মার খুব পছন্দের জিনিস। ইউনিটের ফ্রি খাওয়া যত তুচ্ছই হােক মা সােনামুখ করে খান। 

রাত কত হয়েছে কে জানে ? 

শােবার সময় হাতে ঘড়ি পরে শুই নি বলে বলতে পারছি না অবশ্যি ঘড়ি থাকলেও ঘড়ি দেখা যেত নাআমি ঘুমের ভান করে পড়ে আছিঘুমের ভান যে করছে সে নিশ্চয়ই চট করে এক ফাকে ঘড়ি দেখবে না । 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

মা আমার গা ঘেষে শুয়েছেনজালালের মাখাটটা ফাঁকা তাকে আলাদা ঘর দেয়া হয়েছেব্যবস্থাটা সােহরাব চাচার করা । তিনি সম্ভবত বুঝতে পেরেছেন জালালের মাকে এই ঘরে রাখা ঠিক হচ্ছে না আমি মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিয়েছি। এই ঘরের দু’টা খট এখন আমার জন্যে আর মাজন্যেমা কখনাে আমাকে একা রেখে শােবেন নাদু’জন চাপাচাপি করে শুয়ে আছিতার ঘুম আসছে না। ঘুম আসছে না বলেই ঘরে বাতি জ্বলছেমা’র অভ্যাস হচ্ছে ঘুমে যখন তঁার চোখ বন্ধ হয়ে আসবে তখন তিনি বাতি নিভিয়ে এলােমেলাে করে পা ফেলে বিছানায় আসবেনতিনি খুব নড়াচড়া করছেন

এরমধ্যে দু’বার পানি খেলেন। একবার গেলেন বাথরুমেডাকবাংলােয় আমাদের ঘরের বাথরুমটার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয় না যে ভেতরে যায় সে খুব অস্বস্তি বােধ করেসারাক্ষণই খুট খাট শব্দ করে তার উপস্থিতি জানান দেয় । সােহরাব চাচাকে বললেই তিনি ঠিক করে দেবেনতাকে বলা হচ্ছে নাবাথরুম থেকে একবার বের হলে দরজা বন্ধের সমস্যা কারাের মনে থাকছে না। আমরা বােধ হয়। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের চেয়ে সাময়িক সমাধানকেই বেশি গুরুত্ব দি; একটা সমস্যা হয়েছে সমস্যাকে পাশ কাটাতে পারলেই হল । আর কিছু লাগবে না। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *