শুয়ে শুয়ে শিয়ালের ডাক শুনছি। শিয়ালের ডাকে ভয় ধরানাে ভাব থাকে-~ মনে হয় এই শিয়ালের পালে একবার পড়লে এরা ছিড়ে খুঁড়ে খেয়ে নেবে। আমরা যখন আজিমপুরের নয়া পল্টনে থাকতাম তখনাে গভীর রাতে শিয়ালের ডাক শুনতাম। আজিমপুর কবরস্থানে শিয়াল থাকতাে। শিয়াল প্রহর গুনে ডাকে—আজিমপুর কবরস্থানের শিয়াল যখন তখন ডেকে উঠত।
শহরে থেকে থেকে এরা বােধ হয় শহুরে হয়ে গেছে। পুরানাে নিয়ম কানুন ভুলে গেছে। | আমি কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে আছি। আমার গায়ে ভারী কম্বল । তারপরেও শীত মানছে না। দিনে এমন গরম পড়েছিল, রাতে ঝপ করে শীত নেমে গেল। পাহাড়ী অঞ্চলের এই নাকি নিয়ম । রােদ উঠলে প্রচন্ড গরম। রােদ নিভে গেলেই হাড় কাঁপুনি শীত। মােটা কম্বলটাতেও শীত মানছে না। এই কম্বলটা মার খুব প্রিয়। তিনি যেখানে যাবেন কম্বলটা সঙ্গে থাকবে। চৈত্র মাসের প্রচন্ড গরমের সময়ও দেখা যাবে তিনি কোথাও যাবার আগে কম্বল প্যাক করছেন। সেই প্যাকিংএরও অনেক কায়দা। প্রথমে কম্বলটা ভরা হবে পলিথিনের একটা ব্যাগে। তারপর সেই পলিথিনের ব্যাগ ঢুকানাে হবে মা’র নিজের বানানাে মার্কিন কাপড়ের হলিতে। কম্বলের মাপে মাপে এই থলি বানানাে। সেই থলি ঢুকানাে হবে স্যুটকেসে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
মার এই প্রিয় কম্বলের একটা ছােট্ট ইতিহাস আছে । তিনি একবার বাবার সঙ্গে নিউমার্কেটে গিয়েছিলেন বিছানার চাদর কিনতে । চাদর কিনতে গিয়ে কোন চাদরই তার পছন্দ হল না, এই কম্বলটা তার খুব পছন্দ হল । দাম চার হাজার টাকা । দাম শুনে বাবা–মা দু’জনেরই আক্কেল গুড়ুম। মা চাদর না কিনে ফিরে এলেন। তার মন পরে রইল কম্বলে। কথায় কথায় বলেন-কী মােলায়েম কম্বল। কী সুন্দর ডিজাইন— হালকা সবুজ রঙ। দেখেই মনে হয় ওম ওম গরম। তার মাস চারেক পরের কথা। মা’র বিবাহ বার্ষিকীতে বাবা বিরাট একটা প্যাকেট এনে মার হাতে দিলেন। প্যাকেটের গায়ে লেখা খুকুকে শুভ বিবাহ বার্ষিকী মা প্যাকেট দেখে খুব বিরক্ত হলেন। আঁঝাল গলায় বললেন, কী এনেছ তুমি বলতাে ? উপহার তােমাকে কে আনতে বলেছে ? আমাদের বিয়েটা এমন কিছু
যে উৎসব করে পােলাও-কোরমা খেতে হবে, উপহার টুপহার দিতে হবে, আমি খুবই রাগ করছি। কী আছে এর মধ্যে ?
বাবা হাসিমুখে বললেন, খুলে দেখ। মা বললেন, আমি খুলতে পারব না। বকু, খুলে দেখতে। আমি বললাম, মা তুমিই খােল। তােমার জিনিস। মা বললেন, হ্যা আমার জিনিস। আমার জিনিস নিয়ে আমি স্বর্গে যাব।
বলতে বলতে উপহারের প্যাকেট খােলা হল এবং মা যে কী খুশি হলেন ! দেখতে দেখতে মা’র চোখে পানি এস গেল। তিনি এই হাসেন, এই কাঁদেন। সামান্য একটা কম্বলে মানুষ এত খুশি হয় । মে মাসের তীব্র গরমে মা সেই কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমুলেন।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
মা‘র সঙ্গে এইখানেই আমার তফাৎ । আমি হলে বাবা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন সেদিনই কম্বল ছিড়ে কুটি কুটি করে – আগুন জ্বালিয়ে ছাই করে দিতাম। সিন্দাবাদের ভূতের মত ঘাড়ে চাপিয়ে রাখতাম না। মাকে সেই কথা বলেছিলাম— মা অবাক হয়ে বললেন, তাের বাবার সঙ্গে এই কম্বলের সম্পর্ক কী ? সে যেখানে গেছে যাক । ধুমসীকে নিয়ে নাচাকুদা যা ইচ্ছা করুক আমার তাতে কী ? যখন সে কম্বলটা দিয়েছিল ভালবেসে দিয়েছিল । মানুষটা নষ্ট হয়ে গেছে, তার ভালবাসা নষ্ট হবে কেন ?
আমি রাগি গলায় বললাম, মা তোমার ধারণা ভালবাসা নষ্ট হয় না ? ‘ভালবাসা কি কোন খাবার যে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে ? ‘ভালবাসাটা তাহলে কী মা ?‘
‘এক সময় নিজেই জানতে পারবি—আমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে না। সময় হােক, সময় হলে জানবি।‘
ভালবাসা কি চার হাজার টাকা দামের কম্বল ? ‘ফাজলামি করবি না । চুপ কর।’
আমি চুপ করে গেলাম । তবে চুপ করে গেলেও আমি এইসব নিয়ে ভাবি। খুব ভাবি । অন্য মেয়েরা এত ভাবে কি-না জানি না। হয়ত ভাবে না। তাদের এত সময় কোথায় ? তাদের খেলাধুলা আছে, বন্ধু বান্ধব আছে । পিকনিক আছে, জন্মদিন আছে। আমার কী আছে ? কিছুই নেই। শুধু মা আছেন। বাসায় আমরা দুজন যতক্ষণ থাকি——মা অনবরত কথা বলেন। আমি বেশির ভাগ সময়ই কিছু শুনি না। মা’র দিকে তাকিয়ে থাকি তবে মা কী বলছেন তা আমার কানে ঢােকে
। মা মাঝে মাঝে বলেন— কী-রে তুই এমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছিস কেন ? আমি বলি— মা আমার চোখ দু‘টাতাে অদ্ভুত কাজেই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছি।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
‘আমার সঙ্গে ফাজিলের মত কথা বলবি না বকু।‘ ‘ফাজিলের কী হল— আমার চোখ অদ্ভুত না?‘ ‘বকু তুই দিন দিন অসহ্য হচ্ছিস।‘ “মা তুমিও দিন দিন অসহ্য হচ্ছ।’ ‘আমি অসহ্য হচ্ছি ?
এবং যতই দিন যাচ্ছে ততই আমার বাবার জন্যে সহানুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবা তােমাকে ছেড়ে গিয়ে খুব ভুল করে নি । আমি বাবা হলে অনেক আগেই তােমাকে ছেড়ে চলে যেতাম। | কথাবার্তা এই পর্যায়ে চলে এলে যা করেন তাকে পুরােপুরি কিশােরী সুলভ আচরণ বলা যেতে পারে। তিনি শােবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন । খাওয়া বন্ধ! ভাত-রাগ । ভাত খাবেন না। মাঝে মাঝে শােনা যায় বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে তিনি কঁদছেন—– “ও বাবু। বাবু। তুমি কই বাবু। বাবু তুমি আমাকে একটু আদর করে দিয়ে যাও।”
বাবু হলেন আমাদের নানাজানমার বয়স যখন সাত তখন তিনি মারা যান । মা তার বাবাকে বাবা বা আল্লু ডাকতেন না। ডাকতেন— বাবু।
আমার পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি খাবার জন্যে উঠে বসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, মা আমাকে ধরে বসবেন। বাকি রাত মা’র বক্তৃতা শুনে কাটাতে হবে । সকালে আমার শুটিং। রাত জাগলে তার ছাপ পড়বে চেহারায়। সিনেমার শক্তিশালী ক্যামেরাকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। ক্যামেরা সব ধরে ফেলবে।
কাল সকালের সিকোয়েন্সটা খুব সুন্দর। আমি পানির তৃষ্ণা ভুলে থাকার জন্যে আমার সিকোয়েন্স নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলাম। দৃশ্যটা এ রকম— | দিলু শখ করে শাড়ি পরেছে। কপালে টিপ দিয়ে নিজের মত করে সেজেছে । দিলুর বাবা ডাকবাংলাের বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ছিলেন । দিলু তাকে বলল, বাবা আমাকে কেমন দেখাচ্ছে ? তিনি বই থেকে চোখ না তুলেই বললেন—খুব সুন্দর লাগছেরে মা। বিউটিফুল। তাের মাকে বলতাে চা দিতে। দিলুর মনটা খারাপ হল। বাবা একবার তাকিয়ে তার রূপবতী কন্যাকে দেখলেনও না ?
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
সে তার মা’কে চা দেবার কথা না বলে ডাকবাংলাে থেকে বের হল । তার দেখা হল জামিলের সঙ্গে। জামিল বলল, পরী সেজে কোথায় যাচ্ছিস ? দিলু লজ্জিত গলায় বলল জামিল ভাই আমাকে সত্যি সুন্দর লাগছে? | জামিল বললেন, সুন্দর লাগছে মানে- তােকেতাে কুইন অব শেবার মত লাগছে! কপালের টিপটা ঠিকমত দিতে পারিস নি । একপেশে হয়ে গেছে। যা কলম নিয়ে আয় আমি টিপ একে দিচ্ছি।
এই কথায় দিলু খুব লজ্জা পেয়ে গেল। সে চোখ মুখ লাল করে বলল—থাক আপনাকে টিপ আঁকতে হবে না। এই বলেই সে ছুটে বের হয়ে গেল। সে থামল পুকুরের কাছে গিয়ে । পুকুরের জলে নিজের ছায়া দেখল । সেই ছায়া দেখে তার লজ্জা আরাে যেন বেড়ে গেল। একটা ঢিল ছুঁড়ে পুকুরের ছায়াটা ভেঙ্গে দিল। তারপর লজ্জায় শাড়ির আঁচলে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল ।
য়েটি জামিল নামের মানুষটিকে পাগলের মত ভালবাসে।