আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। কী বিশ্রী ব্যাপার হল । ডিরেক্টর সাহেব যখন বিরক্ত গলায় বলবেন, কই আমিতাে আপনার কন্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলি নি
তখন কী হবে! তিনি হয়ত হাত উঁচিয়ে আমাকে ডাকবেন ।
এত দূর থেকেও হাসির শব্দ শােনা যাচ্ছে। আমার মা হেসে হেসে কী যেন বলছেন। মঈন সাহেব মায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তার মুখে হাসি নেই, তবে বিরক্তিও নেই। শুধু পাপিয়া ম্যাডাম বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন। বেশির ভাগ সময়ই তিনি বিরক্ত হয়ে থাকেন ।
পাপিয়া ম্যাডাম বসে আছেন মঈন সাহেবের পাশে । তাঁর হাতে বড় একটা গ্লাসে হলুদ রঙের কী একটা জিনিস । তিনি চুক চুক করে খাচ্ছেন। মা’র অকারণ হাসিতে সম্ভবত তাঁর মাথা ধরে যাচ্ছে। পাপিয়া ম্যাডামের সব সময় মাথা ধরে। থাকে।
পাপিয়া ম্যাডাম আমাদের এই ছবির নায়িকা। আমি এত সুন্দর মেয়ে আমার জীবনে দেখি নি। মােমের পুতুল বললেও কম বলা হবে। তার ঠোট সুন্দর, চোখ সুন্দর, নাক সুন্দর, দাঁত সুন্দর। লম্বা সিল্কি চুল যা দেখলেই হাত নিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে। এবং কেঁচি দিয়ে এক গােছা চুল কেটে বাড়ির দেয়ালে সাজিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। তাকে দেখলে প্রথম যে কথাটা মনে হয় তা হচ্ছে মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে? হেলেন অব ট্রয় কিংবা ক্লিওপেট্রা এরা তাঁর চেয়েও সুন্দর ছিল ? মনে হয় না । | মা তর তর করে ছুটে আসছেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। মনে হচ্ছে জটিল কোন মিশন সম্পন্ন করে ফিরছেন। মিশনের ফলাফল তার পক্ষে।
বকু, তােকে বেলের সরবত দিয়েছে ?‘ | আমি কিছু বললাম না। মা হড়বড় করে বললেন, ইউনিটের সবাইকে বেলের সরবত দিয়েছে তােকে দিচ্ছে না কেন ? তুইতাে ফেলনা না, তুই এই ছবির দুই নম্বর নায়িকা।
‘মা চুপ করতাে!‘
‘চুপ করব কেন ? মঈন ভাইয়ের কানে আমি এক সময় কথাটা তুলব । সবাইকে সব কিছু সেধে সেধে দেয়া হয়—– তাের বেলায় চেয়ে চেয়ে নিতে হয়। কেন তুই কি বন্যার জলে ভেসে এসেছিস ? নাকি বৃষ্টির ফোটার সঙ্গে আকাশ থেকে পড়েছিস ?
‘উফ মা– চুপ কর ।
‘সব সময় চুপ করে থাকলে হয় না। জায়গা মত কথা বলতে হয়। নিজের জিনিস আদায় করে নিতে হয়। বুদ্ধি খেলাতে হয়। তুই বুদ্ধি খেলাতে পারিস
সবার মেয়ে হয় বুদ্ধিমতী, আর তুই হয়েছিস বােকামতী।
মা চলে যাচ্ছেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, তবে নিশ্চিত হতে পারলাম । মা সহজে কিছু ছেড়ে দেন না। বেলের সরবত প্রসঙ্গ এই খানেই চাপা পড়বে বলে মনে হয় না। যথাসময়ে ডিরেক্টর সাহেবের কানে উঠবে।
মা’র কথাগুলি মনে পড়ে এখন একটু হাসি পাচ্ছে— কেমন চোখ মুখ শক্ত করে বলছিলাে –“সব সময় চুপ করে থাকলে হয় না। জায়গা মত কথা বলতে হয়। নিজের জিনিস আদায় করে নিতে হয়।” ভাবটা এ রকম যেন মা সব সময় নিজের জিনিস নিজে আদায় করে নিয়েছেন। আসলে তিনি কিছুই নিতে পারেন নি। বরং তার নিজের যা সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিতে হয়েছে। | আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন আমার বাবা আমাদেরকে ছেড়ে চলে যান। আমার বুদ্ধিমতী মা একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করেন নি এরকম একটা ব্যাপার ঘটতে পারে। তিনি নানান ধরনের পাগলামী করার চেষ্টা করেন । গােলাপ গাছে স্প্রে করে দেয়ার যে বিষ ঘরে ছিল সেটা খাওয়ার চেষ্টা করেন, খানিকটা মুখে নিয়ে ‘গু করে ফেলে দেন। এতেই তার মুখে ঘা-টা হয়ে একাকার।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
একবার পঞ্চাশটার মত ঘুমের অষুধ খান। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বমি হয়ে যাওয়ায় সেই অষুধে টানা আঠারাে ঘন্টা ঘুম ছাড়া তাঁর আর কিছুই হয় না। তারপর উঠে–পড়ে লাগেন, গুন্ডা লাগিয়ে বাবাকে মারার ব্যবস্থা করবেন। সেই নিয়ে দিনরাত আমার সঙ্গে পরামর্শ— বুঝলি বকু এমন মারের ব্যবস্থা করব যে প্রাণে মরবে না তবে হাত পা ভেঙ্গে লুলা হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবে। পিশাব পায়খানা বিছানায় করবে। আমাকে চিনে না ? আমি তার বাপদাদা চৌদ্দগুষ্ঠির নাম ভুলিয়ে দে । পাতলা পায়খানা করিয়ে ছাড়ব। কলসি
ভর্তি ওরস্যালাইন খেয়েও কূল কিনারা পাবে না। | ভাড়াটে গুল্ডার পরিকল্পনা এক সময় বাতিল হয়— মা বিপুল উৎসাহে উকিলের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। দিনে উকিলের সঙ্গে কথা রাতে আমার সঙ্গে পরামর্শ— বুঝলি বকু হুজুরকে আমি শ্রীঘরে নিয়ে ছাড়ব। আমার বিনা অনুমতিতে বিয়ে! সাত বৎসর শ্রীঘরে বসে ইট ভাঙ্গতে হবে। ইট ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে হাতে কড়া পড়ে যাবে। আমি সহজ জিনিস না। তুই শুধু দেখ— কী হয়। | শেষ পর্যন্ত কিছুই হয় না। মা কাঁদতে কাঁদতে আগামসি লেনে তার বাবা–মা’র সঙ্গে থাকতে আসেন। আর আমার বাবা তার অফিস সেক্রেটারীকে বিয়ে করে ফেলেন। আমার ধারণা তাদের এখন বেশ সুখের সংসার । দুটা ছেলেমেয়ে আছে। বাবা থাকেন এলিফেন্ট রােডে একটা কেনা ফ্ল্যাটে। তাদের একটা মেরুন কালারের গাড়িও আছে । একদিন দেখি নতুন মা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবা তার পাশে বসে হাসি হাসি মুখে কী যেন বলছেন। নতুন মা‘র মুখেও হাসি। বাবা বেশ সুখেই আছেন। তবে মা’র ধারণা বাবা আছেন হাবিয়া দোজখে। কারণ যে মহিলাকে বিয়ে করেছেন–তিনি পর্বতের মত। বসলে উঠে দাঁড়াতে পারেন না। টেনে তুলতে হয়।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-২)
‘বুঝলি বকু, সারা গায়ে শুধু থলথলা চর্বি। পুতুল পুতুল দেখে তাের বাবা মজে গিয়ে বিয়ে করেছিল সেই পুতুল এখন মৈনাক পর্বত। ট্রাকে তুললে ট্রাকের চাকার হাওয়া চলে যায় এই অবস্থা। আর মাগীর মেজাজ কী ? সারাক্ষণ
খ্যাক খ্যাক করে।‘
সবই মা‘র বানানাে কথা । মহিলা একটু মােটার দিকে কিন্তু খুবই মায়াকাড়া চেহারা! মৃদুভাষি। কথা বলার সময় ঠোট টিপে টিপে হাসেন— দেখতে ভাল লাগে। আমার সঙ্গে তাঁর এই পর্যন্ত তিনবার দেখা হয়েছে। তিনবারই তিনি খুব ভদ্র ব্যবহার করেছেন । আমাদের এই দেখা হবার খবর জানেন না। খবর জানলে আবারাে গােলাপ ফুলে দেয়ার কীটনাশক অষুধ খেয়ে ফেলতেন ।
তবে এখন আর আমাদের গােলাপ গাছ নেই। এবং গাছে দেয়ার অষুধও ই; নানাজানের দোতলা বাড়ির একটা অংশে আমরা থাকি। দোতলার
কটা এবং একতলার পুরােটা ভাড়া দেয়া হয়। এই ভাড়ার টাকায় আমাদের ; আমার মামার সংসার চলে। মামার বয়স পঞ্চাশ-— এখনো বিয়ে করেন
আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে শুনে আসছি তিনি বিয়ে করছেন। সব কক। সেই বিয়ে এখনাে হয় নি। এতে অবশ্যি আমার মা খুশি। কারণ বিয়ে এলেই দোতলার অর্ধেকটা আর ভাড়া দেয়া যাবে না। মামা সেখানে তার
নার পাতবেন। বাড়ি ভাড়া থেকে আয় অর্ধেক হয়ে যাবে। সংসারের খরচও ২ বেড়ে! মামাকে তখন আর সামান্য হাত খরচ দিয়ে মানানাে যাবে না ।
তেই মামা কিছুদিন পর পর গম্ভীর গলায় মাকে ডেকে বলেন— সাবিহা নে। তাের ভালর জন্যে বলছি । তাের মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে।