হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-২১)

মাঝে মাঝে খুব ভােরে আমার ঘুম ভাঙ্গে। কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ জেগে উঠে দেখি ঘরের ভেতরের অন্ধকারে নরম একটা ভাব ঘন অন্ধকারকে কেউ যেন তরল করে দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার ঘন করে ফেলবে । ধ্বক করে বুকে ধাক্কা লাগে— হচ্ছে কী ? ভয়ংকর কিছু কি হচ্ছে ? এটাই কি সেই ভয়ংকর মুহূর্ত ? 

হুমায়ুন আহমেদ রুমালীভয়ংকর মুহূর্তের একটা ইতিহাস আছে। আমি যখন খুব ছােট তখন দাদীজান আমাদের সঙ্গে থাকতেন । মাঝে মাঝে দাদীজানের সঙ্গে আমি রাতে ঘুমুতাম। তাঁর কাছে গল্প শুনতে চাইতে হত নাতিনি নিজের মনেই একের পর এক গল্প বলে যেতেন। তাঁর সব গল্পই ভয়ংকর টাইপের! আজরাইল শিঙ্গা কুঁকছে—পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছেসেই শিঙ্গার কী ভয়ানক আওয়াজসেই আওয়াজ কানে যাওয়া মাত্র সমস্ত গর্ভবতী মাদের পেটের সন্তান ‘খালাস’ হয়ে যাবে শিঙ্গাটা ফোকা হবে— আধাে আলাে আধাে অন্ধকার সময়। তখন দিনও 

, রাতও না । 

খুব ভােরে যতবার ঘুম ভাঙ্গতাে ততবারই মনে হত এই কি সেই শিঙ্গা ফোকার সময় ? নিজেকে সামলাতে সময় লাগতআমি এলােমেলাে পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতাম। বাড়ির সামনের রাস্তাটা ফাঁকা। একটা মানুষ নেইমানুষজন যেমন ঘুমুচ্ছে, রাস্তাটাও যেন ঘুমুচ্ছে। কোন একজন জীবন্ত মানুষ রাস্তায় এসে না দাঁড়ানাে পর্যন্ত রাস্তার ঘুম ভাঙ্গবে না। 

আমি ঠিক করে ফেলি রাস্তার ঘুম না ভাঙ্গা পর্যন্ত আমি বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকব । যে মানুষটা রাস্তার ঘুম ভাঙ্গাবে তাকে দেখে ঘরে ঢুকব তখন মনে এক ধরনের উত্তেজনা হতে থাকে। কাকে দেখব? কাকে দেখব ? কে সেই ঘুম ভাঙ্গানিয়া

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

বেশির ভাগ সময়ই নামাজী মানুষদের দেখি ফজরের নামাজ পড়তে মজিদের দিকে যাচ্ছেন একবার শুধু বাচ্চা একটা মেয়েকে দেখেছিলাম। তার পরনে লাল ফ্রক,খালি পা, হাতে একটা কঞ্চি। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে কঞ্চি দুলাতে দুলাতে যাচ্ছে। আমাটা খানিকক্ষণের জন্যে অন্যরকম হয়ে গেল মেয়েটা এত ভােরে কোথায় যাচ্ছে? তার মনে এত আনন্দইবা কিসের ? পৃথিবী কি সত্যই এত আনন্দময় ? আমি বারান্দা থেকে ডাকলাম, “এই মেয়ে, এই।” সে মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে ফিক করে হাসল তারপর আগের মতই কঞ্চি দুলাতে দুলাতে এগুতে লাগলএরপর থেকে ভােরে ঘুম ভাঙ্গলেই মেয়েটার মুখ। আমার মনে আসে। কী সুন্দর মায়া মায়া মুখ। কেমন টুক টুক করে হাঁটছিল।। 

দুর্গাপুর ডাকবাংলােয় আজ আবার আধাে অন্ধকার আধাে আলােয় ঘুম ভাঙ্গলআমি পুরানাে অভ্যাসমত বারান্দায় চলে এলাম। পাখিদের চিৎকারে কান পাতা যাচ্ছে না। গ্রামের মানুষরা যে খুব ভােরে জেগে ওঠে তার প্রধান কারণ বােধ হয়-—পাখিদের হৈ চৈপাখিরা বড় বিরক্ত করে। 

বারান্দা থেকে উঠোনের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম। পাপিয়া ম্যাডাম হাঁটছেন। তাঁর হাতে কফির মগ। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছেন ( কফি না হয়ে চা-হতে পারে আমি ধরে নিচ্ছি কফি। তিনি চা খান না)। তিনি নিজের মনে হটছেন। ছবির মত একটা দশ তার পরনে শাদা শাড়িলাল একটা চাদর মাথার উপর দিয়ে রেখেছেন। তাঁকে জীবন্ত একটা ফুলের মত লাগছেআমার কাছে মনে হল আমি অনেকদিন এমন সুন্দর দৃশ্য দেখি নি পাপিয়া ম্যাডাম কোনােদিকে তাকাচ্ছেন না। তিনি আছেন আপন মনেআমি যদি কখনাে ছবি বানাই এমন একটা দৃশ্য অবশ্যই রাখব

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

ছবির নায়িকা খুব ভােরে বাগানে একা একা হাঁটছে। তার হাতে কফির মগমাঝে মাঝে সে মাথা উঁচু করে আকাশ দেখার চেষ্টা করছেআকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে। আমার খুব ইচ্ছা করছে উঠোনে নেমে যাই। পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলিউনি হয়ত খুব রাগ করবেন কিছু সময় আছে যখন মানুষ একা থাকতে চায়, অতি প্রিয়জনের সঙ্গও তার অসহ্য বােধ হয়। উনার হয়ত এখন ঐরকম সময় যাচ্ছেআমি লােভ সামলাতে পারলাম না নীচে নামলামঠিক করে ফেললাম, উঠোনে এমন ভাবে যাব যাতে মনে হবে উনি যে উঠোনে আছেন আমি জানতাম 

আমি যে বারান্দায় দাড়িয়ে উনাকে দেখেছি উনি তা জানেন না আমি হঠাৎ উঠোনে উনাকে দেখে চমকে উঠেছি এমন একটা অভিনয়। আমার জন্যে সহজ অভিনয়। 

আমি আমার অভিনয়ের অংশটা সুন্দর ভাবে করলাম। উনাকে দেখে চমকে উঠে বললাম, ও আল্লা আপনি! কী আশ্চর্য! 

উনি হাসি মুখে বললেন, রুমালী তুমি কেমন আছ ? * জ্বি ভাল।’ 

‘আমাকে দেখে চমকে ওঠার ভান করলে কেন ? তুমিতাে দোতলার বারান্দা থেকেই আমাকে দেখেছ।’ 

চট করে কোন জবাব আমার মাথায় এল না। আমি অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছি। কাউকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারার মধ্যে তীব্র একটা আনন্দ আছে। বেশির ভাগ মানুষ এই আনন্দ অনেকক্ষণ ধরে পেতে চান। উনিও কি তা চাইবেন ? না-কি ব্ৰামার কাছ থেকে কোন জবাবের জন্যে অপেক্ষা করবেন না, অন্য প্রসঙ্গে চলে যাবেন? 

পাপিয়া মাডাম অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন–সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, তুমি কি রােজই এত ভােরে ওঠ ? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

জ্বি না। আজ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেছে।’ ‘আমি খুব আর্লি রাইজার । যত রাতেই আমি ঘুমুতে যাই না কেন—পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার দিকে আমার ঘুম ভাঙ্গবেই। তখন আমি নিজের জন্যে এক মগ কফি বানাই। কফি খেতে খেতে টুকটুক করে হাঁটি। 

কিছু বলতে হয় বলেই আমি বললাম, খুব ভাল অভ্যাস। 

তিনি বললেন, মােটেই ভাল অভ্যাস না। কারণ সূর্য ওঠার কিছুক্ষণ পরই আমি আবার ঘুমুতে চলে যাই। শুটিং না থাকলে— দশটা এগারােটা পর্যন্ত ঘুমুই । 

আজ ঘুমুতে পারবেন না। আজতাে শুটিং। ‘আজো পারব। আজ শুটিং হবে না।’ ‘শুটিং হবে না ? প্যাক আপ হয়ে গেছে ? 

‘না। তবে হবে । আমার সিক্সথ সেন্স বলহে হবে। আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। 

আপনি কি সব কিছু আগে ভাগে বলতে পারেন ?’ ‘আরে না। হঠাৎ কোন একদিন একটা কিছু মনে হয় তারপর দেখি তাই হয়েছে । আজ ঘুম থেকে উঠেই মনে হল শুটিং হবে না। এবং আমি জানি হবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *