আমি বললাম, এই গ্রামে একটা বে আছে। সেও না-কি ভবিষ্যৎ বলতে পারে।
তিনি হালকা গলায় বললেন, ও আচ্ছা জাহেদা। তার কথা শুনেছি। একদিন। যাব, দেখে আসব । অবশ্যি পীর-ফকির, ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার খুব আগ্রহ নেই। তুমি ঘুরে বেড়াও আমি যাচ্ছি।
‘এখন ঘুমুতে যাবেন ?
আপনার মেয়েকে সবুজ বলপয়েন্টে একটা চিঠি লিখবেন বলে ঠিক করেছিলেন, সেই চিঠি লেখা হয়েছে ?
পাপিয়া ম্যাডাম হেসে ফেলে বললেন, আমার সবুজ বল পয়েন্টের খবর মনে হয় দিকে দিকে ছড়িয়ে গেছে। হ্যা চিঠি লেখা হয়েছে। এখনাে পােস্ট করি নি। আচ্ছা ঠিক আছে চিঠি পােস্ট করার আগে তােমাকে পড়াব । পড়লে তােমার মজা লাগবে।
সকালের নাশতা খাবার সময় সােহরাব চাচা বললেন, মিস রুমাল তুমি মেকাপে বসে যাও। দেরি করবে না । আমি বললাম, চাচা, শুটিং কি হবে ? সােহরাব চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, শুটিং হবে না কেন?
‘এমি বললাম!’
‘শুটিং অবশ্যই হবে। স্যার বলে দিয়েছেন—– হেয়ার স্টাইল তোমাকে মনে রাখতে। যেদিন যেদিন শাড়ি পরবে, চুল খােলা থাকবে। শাড়ি ছাড়া আর যাই। পরবে—দু’বেণী করবে।’
‘জি আচ্ছা মনে রাখব। মেকাপ কোথায় দেয়া হবে ?
‘তাওতাে জানি না—আচ্ছা দাঁড়াও জেনে এসে বলছি। এই ফাঁকে দ্রুত চা শেষ করে ফেল। তুমি টুকটুক করে চা খাও কেন ? এক চুমুক পাঁচ মিনিট অপেক্ষা, আবার আরেক চুমুক।
চা শেষ করার আগেই সােহরাব চাচা ফিরে এসে বিরক্ত মুখে বললেন, আজ শুটিং প্যাক আপ হয়েছে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
ছবির জগতে ‘প্যাক আপ’ বাক্যটি আনন্দময় । স্কুলে উপস্থিত হবার পর হেড স্যার যদি এসেম্বলীতে বলেন, তােমাদের জন্যে দুঃখের খবর আছে ক্লাস এইটের একজন ছাত্রী মায়া হালদার যে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিল, আজ খবর এসেছে সে মারা গেছে। আজ তাঁর আত্মার মাগফেরাতের জন্যে দোয়া করা হবে । এবং আজ আর কোন ক্লাস হবে না । তখন ছাত্রীরা খুব চেষ্টা করে চোখে মুখে মনখারাপ ভাব ফুটিয়ে রাখতে। শেষ পর্যন্ত পারে না। মৃত্যুর শােকের চেয়ে ক্লাস হবে না এই আনন্দই বড় হয়ে ওঠে। প্যাক আপেও তাই হয়— সবাই ভাব করে– আহা একটা দিন মাটি হল, কিন্তু সবাই খুশি। সবচে খুশি আমার মা। তিনি আনন্দ ঝলমল গলায় বললেন, বকু! আমার সঙ্গে চুল এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, চল ।
‘কোথায় যাচ্ছি না জেনেই বললি-চল”
‘তুমি যেখানেই নিয়ে যাবে সেখানেই যাব। তুমি যদি লাযাতে নিয়ে যাও, সেখানেও যাব।’
‘লাযাটা কোথায় ? ‘লাযা হচ্ছে একটা দোজখের নাম। সাতটা দোজখের একটার নাম লাযা।
‘আমি তােকে যাতে নিয়ে যাব কেন ? এটা কি ধরনের কথা। পাগলামী ছাগলামী কথা আমার সাথে বলবি না। আমার কাছে জ্ঞান ফলাবি না। আমি তাের পেটে জন্মাইনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস।
মা রাগে গরগর করতে লাগলেন, আমি মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসছি। এই হাসিতে মা’র রাগ আরাে বাড়বে। তবে রাগটা কনট্রোলের ভেতর থাকবে। লাগামছাড়া হবে না। এই হাসি উনুনে অল্প অল্প তুষ ছড়িয়ে দেয়া হাসি। আমার আরেকটা হাসি আছে পেট্রল ঢেলে দেয়া টাইপ। ধুম করে আগুন।’
বকু! জ্বি মা।’ ‘কাপড় বদলা, ভাল কিছু পর।
‘তুমি যা বলবে তাই পরব। তুমি আগে সেজে গুজে আস। তারপর আমি ! আমার চেয়ে তােমার সাজটা বেশি দরকার।’
তার মানে ? ‘না সাজলেও আমাকে সুন্দর দেখাবে মা। বয়সের সৌন্দর্য । তােমার সেই সৌন্দর্যতাে নেই। সাজগােজ করে সেটা কাভার দিতে হবে। তবে ম শােন, আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি ঠোটে এত কড়া করে লিপস্টিক দিও না।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আমি আবারাে মিষ্টি মিষ্টি করে হাসলাম । মা রাগে কাঁপতে কাঁপতেই দোতলায় উঠে গেলেন। সেজে গুজে তার নীচে নামতে এক ঘন্টার মত সময় লাগবে। এই এক ঘন্টা আমি নিজের মনে ঘুরতে পারি। হাফিজ আলির বাড়ি যদি আশে পাশে হয় তাহলে চট করে তার বৌকেও দেখে আসা যায়। তার কাছ থেকে ভবিষ্যৎট্টা জেনে আসা যায় । যিনি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন তার অতীতও বলতে পারার কথা। আমি তাঁর কাছ থেকে ভবিষ্যৎ জানতে চাইব না। আমি জানতে চাইব অতীত। আমার প্রশ্নগুলি হবে এ রকম—
বলুনতাে ছােটবেলায় আমি কার সঙ্গে ঘুমুতাম ? মার সঙ্গে না বাবার সঙ্গে ? –কি দু‘জনের সঙ্গেই —মাঝখানে আমি, এক পাশে বাবা আর এক পাশে মা।।
উত্তরটা হল আমি দু‘জনের কারাের সঙ্গেই ঘুমুতাম না। আমি ঘুমুতাম আমার দাদীজানের সঙ্গে
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে বলুনতাে আমি এই পর্যন্ত ক’বার পানিতে ডুবেছি ?
উত্তর হচ্ছে তিনবার। প্রতিবারই মরতে মরতে বেঁচে উঠেছি। প্রথমবার পানিতে ডুবি আমাদের দেশের বাড়ি নেত্রকোনায়। পানি থেকে যখন আমাকে তােলা হয় তখন না–কি আমার সমস্ত শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল। চোখের মণি উলটে গিয়েছিল । চোখের মণি উলটে যাওয়ার মানে কী আমি জানি না। নিশ্চয়ই কোন ভয়াবহ ব্যাপার। মৃত্যুর আগে আগে কিংবা মৃত্যুর সময় চোখের এই ঘটনাটা হয়ত ঘটে। যাই হােক আমাকে উঠোনে শুইয়ে রেখে সবাই যখন মরাকান্না শুরু করে তখন হঠাৎ করে আমি সামান্য নড়ে উঠে, ছােট্ট করে শ্বাস ফেলি। আমাকে নিয়ে ছােটাছুটি পড়ে যায়। এবং গ্রামের এক কবিরাজ আমাকে বাঁচিয়ে তােলেন। এই ঘটনার পর আমার পানি-ভীতি হবার কথা। তা হয় নি উল্টোটা হয়েছে। পানি দেখলেই ছুটে কাছে যেতে ইচ্ছা করে। পানি হাত দিয়ে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।