এই কারণে আরাে দু’বার আমাকে পানিতে ডুবতে হল, প্রতিবারই জীবন সংশয়ের মত অবস্থা। আমাকে সাঁতার সেখানাের জন্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি সাঁতার শিখলাম না। কারণ আমার মনে হল–— সাঁতার শিখে ফেললেই আমার আর পানি ভাল লাগবে না। শান্ত সুন্দর কোন দিঘি দেখলে তার কাছে যেতে ইচ্ছা করবে না।
কেন এই আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব? আমার চারপাশে আনন্দময় ব্যাপারতাে খুব কম। আচ্ছা দিলু যেমন দিঘির নীল জলে ডুবে মারা গেছে আমার বেলাতেও কি তাই হবে ? শুটিং এর শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একদিন দেখা যাবে আমি সাঁতার না জেনেও দিঘিতে ভাসছি। দিঘির চারপাশের গাছের অসংখ্য পাখি অবাক হয়ে আমাকে দেখছে আর ভাবছে— ব্যাপারটা কী ? একটা হলুদ রঙের পাখি হয়ত আমার ভাসন্ত শরীরটার উপর দিয়ে কয়েকবার উড়ে উড়ে যাবে। তার চোখে থাকবে বিস্ময়।
কেমন আছেন?
আমি তাকালাম। সেলিম ভাই । উনিও কি আমার মায়ের মত নিঃশব্দে হাঁটা প্র্যাকটিস করছেন ? কখন এসে পাশে দাড়িয়েছেন বুঝতেই পারি নি। সেলিম ভাইকে দেখে চমকে ওঠার কোন মানে হয় না। কাজেই চমকালাম না। হাসি হাসি মুখে বললাম,
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
আপনার খবর কী সেলিম ভাই ? ‘জ্বি ভাল।’ ‘চোখ লাল হয়ে আছে কেন ? রাতে ঘুম হয় নি ?
‘জ্বি না। টেনশনে ঘুম হয় নি। আজ শুটিং, স্যার কী করতে বলবেন আর কী করব এই টেনশনে,,।।
‘শুটিং যে প্যাক আপ হয়েছে সেই খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন। | ‘জ্বি পেয়েছি।
‘তাহলেতাে টেনশন কমে যাবার কথা।
‘জ্বি না, টেনশন কমে নি আরাে বেড়েছে আজ সকালে নাশতা খেতে পারি নি । আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ঘুম থেকে উঠেই কাউকে কিছু না বলে ঢাকা চলে যাব।
‘সেটা করলেন না কেন ? যেটা ভাববেন সেটা করবেন। শেষ মুহুর্তে পিছিয়ে পড়বেন না। ঢাকায় পালিয়ে যাবার ব্যাপারটা কি এখনাে আপনার মাথায় আছে? | ‘জ্বি আছে!’
‘তাহলে এক কাজ করুন আগামীকাল ভােরে ঢাকায় চলে যান। আজ খোজ নিয়ে আসুন ঢাকার দিকের প্রথম বাস কখন ছাড়ে । বাস ভাড়া কত । আপনার
কাছে কি ঢাকায় ফিরে যাবার মত টাকা আছে ?
‘জ্বি না।’ ‘আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। ‘জ্বি আচ্ছা।’ ‘এখন আমার সঙ্গে একটু চলুন।’ ‘কোথায় ?’
তেমন কোথাও না, একটু হাঁটা হাঁটি করব। একটু পরেই মা দোতলা থেকে নামবেন । নেমে শুনবে আমি আপনার সঙ্গে কোথাও গেছি। মা’র ব্রেইন ডিফেক্টের মত হয়ে যাবে। তিনি ভাব দেখাবেন যে খুব নরম্যাল আছেন। আসলে থাকবেন খুব এবনরম্যাল অবস্থায় । খুব মজা হবে।’
‘মজা হবে কেন?’
‘আপনি বুঝবেন না। চলুনতাে যাই। কথা বলে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছি। মা যদি এখন হুট করে নেমে যায় তাহলে পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
‘পঁড়ান একটা ছাতা নিয়ে আসি–খুব রােদ। ‘আপনাকে ছাতা আনতে হবে না । চলুনতাে।‘
আমি গেটের দিকে এগুচ্ছি সেলিম ভাই আসছেন আমার পেছনে পেছনে। খুব যে উৎসাহের সঙ্গে আসছেন তা মনে হচ্ছে না। মানুষ অনুরােধে ঠেকি গেলে, উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি অনুরােধে রাইস–মিল গিলে ফেলেছেন । বেচারার মন থেকে অস্বস্তি ভাবটা কাটানাে দরকার । কী করে কাটাব বুঝতে পারছি না। হালকা ধরনের গল্প টল্প করা যেতে পারে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
সেলিম ভাই!‘ ‘জ্বি।‘
বলুনতো দেখি চন্ডিগড় গ্রামটার বিশেষত্ব কী ? ‘কোন বিশেষত্ব নেই। বাংলাদেশের সব গ্রাম একরকম।
হয় নি। এই গ্রামের একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। দেখবেন এই গ্রামে একটু পর পর শিমুল গাছ। গাছে ভর্তি কড়া লাল রঙের ফুল । মনে হয় যে পুরাে গ্রামটায় আগুন ধরে গেছে। ধিক ধিক করে আগুন জ্বলছে।
‘ চন্ডিগড় গ্রামটা দেখে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। আপনি শুনে দেখুনতাে আইডিয়াটা কেমন ? আইডিয়াটা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যদি একটা করে শিমুল গাছ লাগিয়ে দি তাহলে কেমন হয় ? যখন ফুল ফুটবে তখন মনে হবে পুরাে বাংলাদেশে আগুনের ফুল ফুটেছে। কোন বিদেশি বাংলাদেশে এলে হতভম্ব হয়ে বলবে —- একী ? কোন দেশে এলাম ? আমার আইডিয়া কেমন ?
‘অদ্ভুত আইডিয়া।‘ ‘খুব কি অদ্ভুত ?
‘না খুব অদ্ভুত না, তবে শিমুল গাছ না, লাগাতে হবে কৃষ্ণচুড়া গাছ আর রাধা চূড়া গাছ।
‘এমন কোন গাছ আছে যার ফুল নীল।‘
জারুল গাছ। থােকা থােকা নীল ফুল ফোটে।