লাগিয়ে দি। পাঁচ ছ‘ বছর পর গাছগুলি যখন বড় হবে তখন একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটে
যাবে ।
সেলিম ভাই কিছু বলছেন না। অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছেন। মনে মনে হয়ত ভাবছেন– আচ্ছা এক পাগলী মেয়ের হাতে পড়লাম।
বৈজ্ঞানিকরা কত অদ্ভুত অদ্ভুত আবিষ্কার করেন, এমন একটা আবিষ্কার করতে পারেন না যাতে অন্যের মনের কথা পরিষ্কার শােনা যাবে । ক্যালকুলেটারের মত ছােট্ট যন্ত্র । পকেটে লুকানাে থাকবে। যন্ত্রের বােতাম টিপে দিলেই পাশের মানুষটার মনের কথা শােনা যাবে।
‘সেলিম ভাই। ‘জ্বি।
কথা বলুন। এত চুপচাপ কেন ? না-কি আমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না।
সেলিম ভাই কিছু বললেন না। মাথা আরাে নীচু করে ফেললেন। মনে হচ্ছে লজ্জা পাচ্ছেন।
‘কাল ভােরে ঢাকা চলে যাবার প্রােগ্রামটা কি আপনার ঠিক আছে ? ‘জ্বি ঠিক আছে।’ ‘ঢাকা গিয়ে কী করবেন কিছু ঠিক করেছেন ? ‘জ্বি-না । প্রাইভেট টিউশনি করব।’
‘প্রাইভেট টিউশনিই ভাল। স্বাধীন ব্যবসা। চেষ্টা করবেন বড়লােক কোন। মেয়ের প্রাইভেট টিউটার হতে। মেয়েটার বয়স চৌদ্দ পনেরাে হলে ভাল হয়। এই বয়সের মেয়েরা দ্রুত প্রেমে পড়ে । কোন রকমে বরশি দিয়ে একটা প্রেম গেঁথে ফেলতে পারলে আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আপনি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন নাতাে ?
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
জ্বি-না।’ ‘আপনি কেমন কাজের মানুষ এইবার দেখি – হাফিজ আলির বাড়িটা খুঁজে বের করুন।’
‘কোন হাফিজ আলি ? যার স্ত্রী ভবিষ্যৎ বলতে পারে ? জাহেদা ?’ ‘আপনি তাহলে জানেন ? “জ্বি। ইউনিটের সবাই জানে!
আপনি কি তার কাছ থেকে আপনার ভবিষ্যৎ জেনে এসেছেন? উনি পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেন না। ‘তাহলে ভবিষ্যৎ জানতে পারেন নি ?’
জ্বি না।’ ‘এই সব কি বিশ্বাস করেন ?
জি করি। আমাদের গ্রামেও এ রকম একটা ছেলে আছে। যা বলে লেগে যায় । তার নাম মতিন। কানা মতিন। কঞ্চির খোচা লেগে তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।‘
এ রকম মানুষ সব গ্রামেই থাকে। বাংলাদেশের যে গ্রামেই যাবেন সে গ্রামেই একজন পাগল থাকবে, এ
রা মানুষ থাকবে, একজন নজর খারাপ মানুষ থাকবে, নজর খারাপ মানুষের শুধু নজর লাগবে। সবই ভুয়া। ভুয়া পাগল, ভুয়া জ্বীন, ভুয়া নজর। পৃথিবীটা চলছেই ভুয়ার উপরে। জাহেদা মেয়েটাও বিরাট ভুয়া । ভুয়া ভাব মেয়েদের মধ্যে কম থাকে। হাফিজ আলির স্ত্রীর মধ্যে কী ভাবে চলে এল সেটাই আমার দেখার ইচ্ছা। সেলিম ভাই আপনি কি জানেন | জাহেদা কী কী ভবিষ্যৎ বাণী করেছে ? আমি সব কটা লিখে রাখব। পরে
মিলিয়ে দেখব।‘
উনি বলেছেন–––চন্ডিগড়ে ছবির শুটিং কোনদিন হবে না। বিরাট গন্ডগােল। লাগবে। পানিতে ডুবে একটা মানুষ মারা যাবে।‘
এই কথা বলেছে ?’ জ্বি। খুব জোর দিয়ে বলছে।’ ‘আপনি কি এই ভয়েই পালিয়ে যাচ্ছেন? শুটিং করতে এসে পানিতে ডুবে মরার চেয়ে ঢাকায় প্রাইভেট টিউশনি করা ভাল । তাই না ? প্রাইভেট টিউশনি এম্নিতে খুব বােরিং ব্যাপার কিন্তু কোন মতে পড়া পড়া খেলার সঙ্গে যদি প্রেম ঢুকিয়ে দিতে পারেন তাহলে পুরো ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং হয়ে যাবে।‘
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
সেলিম ভাই মাথা নীচু করে হাঁটছেন, মাঝে মধ্যে চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন । পৃথিবীর সব মেয়েদের ভেতর অলৌকিক একটা ক্ষমতা থাকে। কোন পুরুষ তার প্রেমে পড়লে মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা বুঝতে পারে। এই ক্ষমতা পুরুষদের নেই। পুরুষদের কানের কাছে মুখ নিয়ে কোন মেয়ে যদি বলে– শােন আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি। তারপরেও পুরুষ মানুষ বােঝে না। সে ভাবে মেয়েটা বােধ হয় এ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথায় মরে যাচ্ছে। সেলিম ভাইকে দেখে এখন মনে হচ্ছে তার খবর হয়ে গেছে। কাল ভােরে তিনি কিছুতেই ঢাকা যেতে পারবেন না। তাকে থেকে যেতে হবে শুধু মাত্র আমার আশে পাশে থাকার আনন্দের জন্যে।
হাফিজ আলির বাড়ির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মাটির দু’টা ঘর । জরাজীর্ণ অবস্থা। বাইরের উঠোন খুবই নােংরা। ঝােপ ঝাড়ে একাকার। কেউ কোনদিন উঠোন ঝুঁট দেয় নি। একটা মুরগী মরে পড়ে আছে। তার উপর রাজ্যের মাছি। বাড়ির সামনে খুঁটিতে একটা ছাগল বাধা আছে। সেই ছাগলটাও
মনে হচ্ছে অসুস্থ। হাফিজ আলি উঠোনে বসে আছে। সে যে হাফিজ আলি তা বুঝলাম কারণ সেলিম ভাই বললেন, হাফিজ ভাল আছ ? হাফিজ আলি তার জবাব দিল না। ছাগলটার মত হাফিজ আলিও মনে হল অসুস্থ। চোখ টকটকে লাল । খুঁটিতে হেলান দিয়ে সে বসে আছে–পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে আছে। তার দৃষ্টি মরা মুরগীটার দিকে। এই মুরগীটা বােধ হয় তার প্রিয় ছিল। কিংবা পচাগলা মুরগীর উপর মাছি ওড়ার দৃশ্যে সে মুগ্ধ। বিকট গন্ধে আমার নাড়ি ভুড়ি উল্টে আসার মত হচ্ছে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
সেলিম ভাই বললেন, হাফিজ আলি তােমার কি শরীর খারাপ? ‘না।‘ ‘ইনি এসেছেন তােমার স্ত্রীর সঙ্গে দু’টা কথা বলার জন্যে।
‘যান কথা বলেন ! আপনে এইখানে থাকেন। পুরুষ মানুষের অন্দরে যাওয়া নিষেধ। পর্দা পুষিদার বিষয় আছে।‘
‘আমি যাব না। আমি এইখানেই থাকব। | সেলিম ভাই দাঁড়িয়ে রইলেন, আমি ভেতরে চলে গেলাম। বাড়ির ভেতরটা বাইরের মত নয়। ঝকঝক তকতক করছে। মনে হচ্ছে এই কিছুক্ষণ আগে ঝাট দেয়া হয়েছে । সবছে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে উঠোনে গম্ভীর মুখে একটা বক হাঁটাহাঁটি করছে। বক খালে বিলে ধানের ক্ষেতে থাকে। মানুষ দেখলে উড়ে যায়। এ দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে হাঁস চলে গেল। মুরগী তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে চলে গেল সে ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু দেখল। আমি মুগ্ধ হয়ে বকের কাণ্ডকারখানা দেখছি তখনই হাফিজ আলির স্ত্রী জাহেদার গলা শুনলাম–ভইনডি পালা বক পাখি।” | আর্মি পােষা বক পাখি দেখে যেমন বিস্মিত হলাম, জাহেদাকে দেখেও তেমনি বিস্মিত হলাম। নিতান্তই কিশােরী একটা মেয়ে। গায়ের রঙ কাল । কালাে রঙ যে কত মিষ্টি হতে পারে মেয়েটাকে না দেখলে আমার জানা হত না। কী মায়াকাড়া মুখ। মনে হচ্ছে শাড়ি পরাও ঠিকমত শেখে নি | শাড়ি গা থেকে নেমে নেমে যাচ্ছে। পান খেয়ে সে ঠোট লাল করেছে। পায়ে আলতা।
আমি বললাম, বক পােষ মানে ?