হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-২৫)

‘জ্বে ভইনডি মানে। খুব ছােটবেলায় বকের বাসা থাইক্যা ধইরা আনতে হয়চউখ ফুটনের আগেই ধইরা আনতে হয়চউখ ফুইট্যা হে দেখে মানুষ তহন হে মানুষরেই জানে তার বাপ-মা‘ 

এই বক কে ধরে এনেছে, আপনি ?‘ 

হুমায়ুন আহমেদ রুমালী

জুে না। মায়ের বুক খালি কইরা বকের বাচ্চা আনা মেয়েছেলের কাম না। ভইনড়ি। 

‘বক যে পােষ মানে মানুষের সঙ্গে থাকে এই প্রথম দেখলাম ‘ইনডি মানুষ পারে না এমন কাম নামানুষ সব পারে।এই বকটার কি কোন নাম আছে ? এর নাম ধলা মিয়াধলা মিয়া কইয়া ডাক দেন অফনের বগলে আসব। 

আমি ধলামিয়া বলে ডাক দিলামআশ্চর্য কান্ড–বকটা গম্ভীর মুখে হেঁটে হেঁটে আমার কাছে আসছে। আমি চমকে দুপা পেছনে গেলামজাহেদা কিশােরীর মতই খিলখিল করে হেসে উঠল । এই মেয়ে ভবিষ্যৎ বলবে কী নিতান্তই সহজ সরল গ্রাম্য বধু। 

ভইনডি পান খাইবেন ? ‘হ্যা খাব আর আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করব।‘আমি কোন গল্প জানি নাগাে ভইনডিআপনি না জানলেও আমি জানি। আমি গল্প বলব আপনি শুনবেন। 

মেয়েটা আমার এই কথাতেও খিল খিল করে হেসে উঠল তার হাসির মধ্যে সামান্য অস্বাভাবিকতা আছেগ্রামের মেয়ে এত শব্দ করে হাসে না আমি 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

তার হাসির মাঝখানেই বললাম, আপনি নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন? 

‘গেরামের মানুষ এইগুলােন বানাইছে আমি কিছু বলতে পারি না‘ 

আপনি নাকি বলেছেন। এখানে শুটিং হবে নাএকটা মানুষ মারা যাবে‘ 

‘জ্বে বলেছি।কেন বলেছেন ?’ 

জাহেদা আবারাে শব্দ করে হাসছেআমার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটা কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ অপ্রকৃতিস্থ একজন মানুষ বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলতে পারে । মেয়েটার হাসির শব্দে বক উড়ে গেল-দুটা চক্কর দিয়ে বসল জাহেদার মাথায় জাহেদা খুব স্বাভাবিক। এই ব্যাপারটায় সে যেন অভ্যস্তআমি অবাক হয়ে দেখছি, একটা মেয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে তার মাথায় গম্ভীর মুখে একটা বক বসে আছে। 

ঢাকায় ফিরে গিয়ে যদি এই গল্প বলি— কেউ বিশ্বাস করবে নাএটা কোন কথা হলএকটা তরুণী মেয়ে ঘরের কাজ কর্ম করছে তার মাথায় গম্ভীর মুখে একটা বক বসে আছে! বকটার নাম ধলা মিয়া। 

জাহেদা আমাকে পাটি এনে দিলপান সুপারি এনে দিলআমি পা ছড়িয়ে এমন ভাবে বসলাম যেন কত দিনের পরিচিত এই বাড়ি । জাহেদা আমার পাশে বসল সে ঘরের কাজ কর্ম করে যাচ্ছে এবং আমার কাছে তা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। অতিথি এসে অতিথির মত আরাম করে বসে থাকবেগৃহকত্রী তার কাজ করতে থাকবে ফাকে ফাকে দুএকটা কথা বলবে । 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

ভইনডি আমার পুরুষ মানুষটারে দেখছেন ? হাফিজ আলির কথা বলছেন ? যে বাইরে বসে আছে

গাঞ্জা খাইয়া শরীরটা কী বানাইছে। বেশি দিন বাঁচব না। তার মৃত্য ঘনাইছে।’ 

গাজা খায় ? 

নিশার জিনিস সব খায়চরস খায়, ভাঙ্গের সরবত খায়। যখন খাওনের কিছু পায় না তহন কেরােসিন খায়। তয় গাঞ্জাটা খায় বেশি। 

জাহেদা আবারাে হাসছে। আমি বললাম, স্বামী নেশা করে বেড়াচ্ছে এটাতাে কোন মজার কথা নাআপনি এ রকম করে হাসছেন কেন

ভইনড়ি আমার হাসি রােগ আছেআমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার পিতা মারা গেলসন্ন্যাস রােগে ধড়ফড় কইরা মৃত্যুহে উঠানে ধড়ফড় করে আর আমি হাসি। হাসি থামে না। কত মাইর যে হাসির কারণে খাইছি এখন আর কেউ মারে না, কিছু কয়ও না। স্বামী গাঞ্জাখাের— তার সামনে হাসলেও যা কানলেও তা। 

‘আপনার ধারণা এই গ্রামে শুটিং হবে না? 

এম্নে এম্নে বলছিএইটা নিয়া চিন্তা কইরেন নাআল্লাহপাক মানুষরে অধিক চিন্তা করতে নিষেধ করছেন। অবশ্য মানুষ অধিক চিন্তা করেও নাভাব দেখায় হে অধিক চিন্তা করে । হি হি হি‘ 

আমি মুগ্ধ হয়ে জাহেদার হাসি দেখছি। তার মাথার উপর বসে থাকা বকটা উড়ে গাছের দিকে চলে গেছেহাসতে হাসতে জাহেদার চোখে পানি এসে গেছে সে চোখের পানি শাড়ির আঁচলে মুছছেবকটা গাছে গিয়ে বসল না জাহেদার মাথার উপর চক্কর খেতে লাগল । আচ্ছা এরা এই বকটার নাম ধলা মিয়া রাখল কেন ? বকটা কি পুরুষ

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

আমাকে অনেকক্ষণ দেখতে না পেয়ে মায়ের কী অবস্থা হবে তা আন্দাজ করেছিলাম। আন্দাজের চেয়েও বেশি হয়ে গেল মাকে দেখলাম বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছেন। তার মুখ নীলবুকে নিশ্চয়ই ব্যথা হচ্ছে—বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছেন। হার্ট এটাকের প্রাথমিক লক্ষণ সবই দেখা যাচ্ছে । কপালে বিন্দু বিন্দু 

ঘামআমি সহজ ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলাম মার দিকে না তাকিয়ে বাথরুমে ঢুকে– চোখেমুখে পানি দিলাম। আমি জানি ব্যস্ত হবার কিছু নেই। মা আমাকে দেখতে পেয়েছেন এখন দুত তার শারীরিক সমস্যা কেটে যেতে শুরু করবেতিনি বিছানায় উঠে বসে রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করবেন। কঠিন কঠিন সব কথা হাউইয়ের মত মার মুখ থেকে বের হয়ে আমার দিকে ছুটে আসবে যুদ্ধ প্রস্তুতির 

অংশ হিসেবেই আমি চোখে মুখে পানি দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে রাখছি। 

কোথায় গিয়েছিলি?কাছেই একটা বাড়িতেআমিতাে পুরাে এলাকা চষে ফেলেছিতােকেতাে দেখি নিভাল মত চষ নি। চষলে পেতে।তাের সঙ্গে ঐ হারামজাদাটা ছিলসেলিম ? ‘হ্যা এই হারামজাদাটা অবশ্যি ছিল।তুই কি জানিস ইউনিটে তােকে নিয়ে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। 

ছিঃ ছিঃ পড়ার কী আছে ? আমি একজনকে নিয়ে বেড়াতে বের হতে পারব না?’ 

যার তার সঙ্গে বের হয়ে যাবি ? একটা জোয়ান ছেলের সঙ্গে তাের বয়সী একটা মেয়ে যদি বের হয় তাহলে সবাই কী ভেবে নেয় তুই জানিস

কী ভেবে নেয় ? ‘যা ভাবার তাই ভাবে?সেই তাইটা কী ? 

মা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললেন, সবাই ভাবে ছেলেটা তােকে নিয়ে গেছে পাট ক্ষেতে। 

পাট ক্ষেত দেখতে নিয়ে যাওয়াটা কি মা খুব দোষনীয় কিছু

ন্যাকা সাজবি নাআমার সঙ্গে ন্যাকা সেজে পার পাবি নাবদ মেয়ে কোথাকার

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *