হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-৩)

এখন দেখে 

নে একটা বিয়ে দিয়ে দেতারপর তুই মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে উঠে যা। কারণ এই বাড়ি আমার। বাড়ি ভেঙ্গে আমি ফ্লাট বানাবএক তলায় দোকান, করে ফ্লাটমুফতে অনেক দিন থেকে গেলি তাের কাছে থেকে এক পয়সা গত ভাড়া নেই নি আর কত? সারাজীবন তােদের পালব এমন কথাতাে না । মতাে আর হাজি মােহাম্মদ মােহসিন না আমি হলাম গিয়ে পাজি মােহাম্মদ মৃম।হুমায়ুন আহমেদ রুমালী

নানাজানের এই বাড়ি যে শুধু মামার একার তা না। মাঅবশ্যই তাতে =ংশ আছে। মা মামার সঙ্গে লাইনে কোন কথা বলেন নামা কাঁদো কাঁদো য় বলেন—ভাইজান এই বাড়ি অবশ্যই আপনার। আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই চলে যাব। আজ বললে আজ যাব বিপদের সময় আপনি যে আমাকে “কতে দিয়েছেন এই যথেষ্ট। আমার আর আমার মেয়ের চামড়া দিয়ে জুতা নালেও আপনার ঋণ শােধ হবে না ভাইজান…… 

বলতে বলতে মা’র গলা ধরে যেত, তিনি বাক্য শেষ করতে না পেরে কেঁদে অস্থির হতেন। এতেই আমার কাসেমামা বিচলিত হয়ে বলতেনআরে কী শুরু করলি ? তােদের আমি ফেলে দেব নাকি ? আমার একটা বিচার আছে না ? মিতাে নর-পিশাচ না। আমি নর-মানবআমি যতদিন থাকব তােরাও কবি চোখ মুছ। 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

চোখ মােছার বদলে মা আরাে ব্যাকুল হয়ে কেঁদে উঠতেনমামা হতেন চেলিত আমি আমার মায়ের অভিনয় প্রতিভায় হতাম মুগ্ধ। 

মা অবশ্যই বুদ্ধিমতী। বাবার চলে যাওয়াকে এক সময় তিনি সহজ ভাবে নিয়ে নিলেন এবং বাস্তব স্বীকার করে বাঁচার চেষ্টা চালালেন। বাবার কাছে কান্নাকাটি করে তিনি মাসিক একটা বরাদ্দের ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়াও প্রায়ই বকুলের শরীর খারাপ চিকিৎসা করাতে হবে, বকুলের কলেজে ভর্তি হবার খরচ, এইসব বলে বলে টাকা আদায় করতে লাগলেন সেই টাকার একটা পয়সাও খরচ করলেন নাব্যাংকে জমা করতে লাগলেন। বাড়ি ভাড়া বাবদ যে | টাকা পেতেন তার পুরােটাও মা খরচ করতেন নাএকটা অংশ ব্যাংকে জমা 

করতেনছােটাছুটি করার ব্যাপারে মা একজন এক্সপার্ট। নিজের জীবনের দুঃখের কাহিনী বলার ব্যাপারেও এক্সপার্ট স্কুলে আমাকে কখনাে বেতন দিতে হয় নি ফ্রী শিপের জন্যে মা দরখাস্ত করতেন। যেখানে লেখা থাকত– 

আমি স্বামী পরিত্যক্ত একজন মহিলা বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছিআমার বর্তমানে কোন সহায় সম্বল নাই, আশ্রয় নাই। দুইবেলা অন্ন সংস্থানের পথ নাই আমি তারপরও মানুষের মত বেঁচে থাকতে চাইতার পরেও আমি আমার কন্যা মালিহা রুমালীকে (বকুল) সুশিক্ষিত করতে চাই আমার এই কন্যা প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে তৃতীয় স্থান দখল করেছিলঅষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় সে মেধা তালিকায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে চতুর্থ হয়েছিল আপনার দয়ার উপর আমি নির্ভর করছিএই কঠিন জীবন সংগ্রামে আপনি আমাকে সাহায্য করুন। মালিহা রুমালীর বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের খবর পত্রিকায় ছাপা হয়আপনার অবগতির জন্যে পেপার কার্টিং এর ফটোকপি পাঠাইলাম

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

বিনীতা মালিহা রুমালীর দুর্ভাগা মাতা সাবিহা বেগম মুক্তামাএই জাতীয় দরখাস্তে কাজ হততিনি নানান ধরনের মহিলা সমিতিতেও ঘুরতেন। এক মহিলা সমিতি তাঁকে পায়ে চালানাে একটি সেলাই মেশিন দিয়েছিলতিনি মেশিন বিক্রি করে সেই টাকাও ব্যাংকে জমা করে রেখেছিলেনএক এনজিওর কাছ থেকে তিনি আমার জন্যে একটা বৃত্তিও জোগাড় করেনমাসে পাঁচশটাকাএই টাকা নেবার জন্যে প্রতি মাসের তিন তারিখে আমাকে মার সঙ্গে এনজিওঅফিসে যেতে হত এবং দীর্ঘ সময় করুণ মুখ করে একটা ঘরে বসে গরমে ঘামতে হত

সেই ঘরে ফ্যান ছিল, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বনবন করে ফ্যান ঘুরলেও সেই ফ্যানে কোন বাতাস হত না। 

মাভিক্ষাবৃত্তিমূলক কর্মকান্ড শুরুতে অসহ্য লাগলেও শেষে সয়ে গিয়েছিলমানুষের দয়া এবং করুণা পাবার নিত্য নতুন কলাকৌশল মা 

আবিষ্কার করতেন– আমি সে সব দেখতাম, এবং অবাক হতামমাকারণেই 

=মি প্রথম টিভি নাটকে সুযােগ পেলামনাটকের প্রযােজকের বাসার ঠিকানা বের করে তিনি একদিন আমাকে নিয়ে তার বাসায় উপস্থিত প্রযােজকের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলতে বলতে যে কান্না শুরু করলেন সেই কান্নায় পাথর গলে— প্রযােজকের স্ত্রীতাে গলবেনই। ভদ্রমহিলাও চোখ হতে লাগলেন সেই মহিলার কল্যাণে আমি জীবনে প্রথম ক্যামেরার সামনে নড়ালাম নাটকের নাম স্বপ্ন সায়র। স্বপ্ন সায়র নাটকে আমার অভিনয় নিশ্চয়ই খুব ভাল হয়েছিল- কারণ আমার মাকে তারপর আর কখনো কোন প্রযােজকের বাসায় গিয়ে তাদের স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হয় নিবছরের শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী হসেবে আমি দুবার রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেলামআমাদের বসার ঘরে দু’টা ছবি বড় করে বাঁধাই করা আছেএকটাতে আমি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের হাত থেকে পদক নিচ্ছি, অন্যটায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের হাত থেকে পদক নিচ্ছি। এরশাদ সাহেবের একটা হাত আমার মাথায় রাখা। মা আমাকে গান শেখার ব্যবস্থা করলেন, নাচ শেখার ব্যবস্থা করলেন, সবই বিনা পয়সায়। একজন স্বামী পরিত্যক্তা আশ্রয়হীনা মহিলার প্রতি দয়া বশতই গানের এবং নাচের টিচার রাজি হলেন।

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

সােহরাব চাচা আমার দিকে আসছেনতাঁর হাতে বড় একটা কাচের গ্লাসসােহরাব চাচা হচ্ছেন কথাকলি ফিল্মসের প্রডাকশন ম্যানেজার রােগা টিং টিং-এ একজন মানুষ । সব সময় হলুদ পাঞ্জাবি পরেন এবং ক্রমাগত পান খানভাত খাবার আগেও তাঁর মুখ ভর্তি পান থাকে। ভাতের নলা মাখার সময় থু করে পান ফেলে কুলি করে নেনঅসাধারণ একজন মানুষমাছির যেমন হাজার হাজার চোখ থাকে তারও তেমনি হাজার হাজার চোখ 1 চারপাশে কোথায় কী হচ্ছে তিনি সব জানেনসমস্যা, তা যত জটিলই হােক তার কাছে সমাধান আছে ! সমস্যার সমাধান তিনি এমন ভাবে করেন যে কেউ বুঝতেই পারে না– সমাধানটা তিনি করেছেন। রাগ বলে কোন বস্তু তার ভেতর নেই। চব্বিশ ঘন্টা কাজ করতে পারেন। তবে কাজের ফাঁকে গল্প করতেও খুব পছন্দ করেনবিশেষ বিশেষ মানুষের সঙ্গে যে গল্প করেন তা না— সবার সঙ্গে গল্প যার সঙ্গে গল্প করেন মনে হয় সেই তার প্রাণের বন্ধু, তিনি আমাকে ডাকেন রুমাল । 

‘রুমালের খবর কী?’ ‘খবর ভাল । আপনি কেমন আছেন চাচা ? ‘আমি খুবই ভাল আছি— এই নাও তােমার বেলের সরবত।’ 

বেলের সরবততে আমি খাব না।’ ‘সেকি তােমার মা যে বলল তুমি বেলের বত খেতে চাচ্ছ ?’ ‘চাচ্ছি না। 

‘আচ্ছা না চাইলেও খেয়ে ফেল। জিনিসটা ভাল । আরেকটা কথা শােন-~ যদি কিছু খেতে ইচ্ছে করে আমাকে বলবে ! পুরােদস্তুর নায়িকা যখন হবে তখন আর বলতে হবে না । আপনাতেই সব হয়ে যাবে। 

‘চাচা আমি কি নায়িকা হতে পারব ? 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *