‘সেটা আমি বলতে পারব না। অভিনয় প্রতিভা কার কেমন তা জানি না, বুঝিও না। আমি হলাম যােগানদার ! যার যা লাগবে আমাকে বলবে আমি উপস্থিত করব।’
আপনাকে যা আনতে বলা হবে নিয়ে আসবেন ?’ তুমি বললে আনব না।
তবে ডিরেক্টর সাহেব বললে জোগাড় করব।’ উনি যা বলবেন তাই এনে দেবেন?’ ‘এনে দেব। ফিল্ম লাইনের প্রডাকশন ম্যানেজার হতে হলে “চাহিবা মাত্র উপস্থিত বিদ্যায় পারদর্শী হতে হয়। তবে শােন মিস রুমাল উদ্ভট কিছু কোন ডিরেক্টর চায় না। ডিরেক্টরও জানে কী জোগাড় করা যাবে কী যাবে না।’
মঈন সাহেবকে আপনি খুব পছন্দ করেন তাই না চাচা ?
‘কেন করেন? ‘তুমি যে কারণে কর— আমিও সেই কারণে করি। ‘কই আমিতাে পছন্দ করি না।’ ‘পছন্দ না করাই ভাল। বেলের সরবতটা কেমন লাগলগাে মা ? ‘ভাল ।
‘রেসিপি লাগবে ? রেসিপি লাগলে বল – আমি রেসিপি দিয়ে দিচ্ছি । কাগজে লেখা আছে। এই নাও।
আমি অবাক হয়ে দেখি সত্যি একটা কাগজে-~-বেলের সরবতের রেসিপি। লেখা । সােহরাব চাচার হাত থেকে আমি কাগজটা নিলাম–
বেলের সরবত
১টি
পাকা বেল ঠাণ্ডা পানি।
দৈ
৩ কাপ ২ কাপ ১ কাপ ১ টেবিল চামচ
চিনি গােলাপজল
১. বেলের আঠা ও বীচি ফেলে ১ কাপ পানিতে ভেজাতে হবে মােটা
চালুনীতে হেঁকে নিতে হবে। চালবার পর ১ কাপ চিনি মেশাতে হবে । দৈ ফেটে মেশাতে হবে। গােলাপ জল এবং বরফের কুচি দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। চিনির বদলে ক্যারামেল সিরাপ দেয়া যেতে পারে।
আমি বললাম, চাচা আপনি রেসিপি নিয়ে ঘুরছেন কেন ?
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
সােহরাব চাচা গলার স্বর নিচু করে বললেন, পাপিয়া ম্যাডামের জন্যে। ম্যাডামের এই সরবত এত পছন্দ হয়েছে যে রেসিপি চেয়েছেন। রেসিপি যখন লিখতেই হচ্ছে কার্বন পেপার দিয়ে তিন কপি করে ফেললাম। ছােট নায়িকা হিসেবে তুমি এক কপি রেখে দাও।
‘থ্যাংক য়ু।
সােহরাব চাচা চলে গেলেন। এতক্ষণে শুটিং শুরু হল । তিনটা টেক নেয়া হল। টেক মনে হয় ভাল হয়েছে। ডিরেক্টর সাহেবকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে। তিনি সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিচ্ছেন। আনন্দের সময় তিনি ফস করে সিগারেট ধরান— লম্বা লম্বা কয়েকটা টান দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেন। সেই সিগারেট কুড়িয়ে তুলে নেবার ব্যাপারে সমবেত জনতার মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ দেখা যায়। এখানেও তাই হচ্ছে। | মুখভর্তি চাপদাড়ির মওলানা ধরনের একজন মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসছেন । আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। | ভদ্রলােকের কাঁধে চাদর। পাঞ্জাবি নেমে এসেছে পায়ের পাতা পর্যন্ত । পাঞ্জাবির উপর খােপখােপ প্রিন্টের চাদর গা থেকে আতরের গন্ধ ভেসে আসছে।
ভদ্রলােকের দিকে ভাল মত তাকালে দেখা যাবে চোখে সুরমাও দিয়েছেন । আমি ভাল মত তাকালাম না । এই জাতীয় মানুষরা কঠিন প্রকৃতির হয়ে থাকেন। শুটিং নিয়ে অকারণ হৈ চৈ শুরু করে দিতে পারেন। হয়ত বলে বসবেন আজ জুম্মাবার আজ এইসব কী হচ্ছে ? ঢাকার আশে পাশের মানুষ শুটিং-এ অভ্যস্ত। জায়গাটা ঢাকা থেকে অনেক দূরে। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা। সেখান থেকে দুর্গাপুর । দুর্গাপুর থেকে আরাে তিন কিলােমিটার । জায়গাটার নাম চন্ডিগড়। কে জানে হয়ত চন্ডিগড়ের মানুষরা খুব ধর্মভীরু।
এত জায়গা থাকতে চন্ডিগড়ে শুটিং হচ্ছে। কারণ চিত্রনাট্য এই ভাবে লেখা। ঢাকা থেকে গারাে পাহাড়ের দেশ দুর্গাপুরে বেড়াতে এসেছে একটা পরিবার, রিটায়ার্ড পুলিশের বড় কর্তা এবং তার দুই মেয়ে দিলশাদ ও নিশাত। ছুটি কাটানাের গল্প। তারা উঠল একটা ডাক বাংলােয় অনেক মজা করল । আমি হচ্ছি ছােট বােন দিলু ।
মওলানা সাহেব বিনীত গলায় বললেন, আসসালামু আলায়কুম।
আমি খুবই অস্বস্থিতে পড়ে গেলাম । বয়স্ক কোন ভদ্রলােক আগ বাড়িয়ে সালাম দিলে খুব অস্বস্থি লাগে। আমি লজ্জিত গলায় বললাম, ওয়ালাইকুম সালাম।
‘শুটিং হচ্ছে নাকি মা?’। ‘জুি।’ ‘দাঁড়ায়ে যদি দেখি কোন অসুবিধা আছে ?
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
জ্বি না।’ ‘কেউ কিছু বলবে নাতাে?’ * জুি না।’ ‘আপনি কি শুটিং এর মেয়ে ? ‘জি। ‘শুটিং এর কথা শুধু শুনেছি। দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।
আজ দেখুন। ‘রাংতা লাগানাে বাের্ডের মত জিনিসগুলি কী ? ‘এদেরকে বলে রিফ্লেক্টর। আয়নার মত। গায়ের উপর আলাে ফেলে । ‘বাহ চমৎকার । লাল সার্ট পরা ভদ্রলােক কে?’ “উনি মঈন খান। এই ছবির পরিচালক। ছবিটা উনি বানাচ্ছেন।’ ‘আলহামদুলিল্লাহ্। উনার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে ?
‘কেন যাবে না—অবশ্যই যাবে। তবে এখন কাজ করছেনতাে এখন বিরক্ত না করাই ভাল।
‘ জ্বি আচ্ছ। জি আচ্ছা । বিরক্ত করব না। মঈন সাহেবের স্ত্রী মাশাল্লাহ দেখতে খুব সুন্দর।‘
উনি ডিরেক্টর সাহেবের স্ত্রী না । উনার নাম পাপিয়া—এই ছবির নায়িকা। খুব বড় অভিনেত্রী।
ভদ্রলােকের ভুরু কুঁচকে গেল। পাপিয়া ম্যাডাম যেভাবে বসেছেন তাতে যে কোন মানুষেরই ভুরু কুঁচকাবার কথা। দু‘টা চেয়ার গায়ে গায়ে লেগে আছে।
পিয়া ম্যাডাম তার বা হাত পাশের চেয়ারের হাতলে তুলে দিয়েছেন। দূর থেকে মনে হয় তিনি ডিরেক্টর সাহেবের কাধে হাত রেখে বসে আছেন।