কড়া রােদ উঠেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ। সকালবেলা ঠান্ডা থাকে । কুয়াশা কুয়াশা ভাব থাকে । এগারােটার দিকে ঝাঝালাে রােদ উঠে যায়। এমন দে যে চোখ জ্বালা করতে থাকে।
‘মা শুটিং কি শেষ হয়ে গেছে ?
জ্বি না— আজ সারাদিনই শুটিং হবে।‘ ‘ঐ যন্ত্রটা কী?‘
‘এর নাম ক্রেন ট্ৰলী। ক্যামেরা ক্রেন টুলীতে বসিয়ে উপুর নিচ করা হয় । আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখুন আমি চলে যাচ্ছি।‘ ‘আমি চন্ডিগড় হাইস্কুলের শিক্ষক—ইসলামিয়াত পড়াই। | ‘ও আচ্ছা। খুব ভাল। ‘ আমিও চলে যাব—আজ জুম্মাবার নামাজ আছে । আমার নাম মেরাজ উল্লাহ্ । লােকে অবশ্য মেরাজ মাস্টার ডাকে। আমি আরাে কিছুক্ষণ দেখি— আযান হয় বারােটার সময়। বারােটা বাজতে এখনাে দেরি আছে।‘
আপনার যতক্ষণ ইচ্ছা দেখুন। ‘মা আপনার নামটা জানা হয় নাই।‘ ‘আমার নাম বকুল।‘ ‘মাশাল্লাহ অতি সুন্দর নাম ।
আমি জায়গা ছেড়ে চলে এলাম—মেরাজ মাস্টার সাহেব আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে গভীর আগ্রহে চারপাশের কর্মকান্ড দেখছেন। আজ আমার কোন সিকোয়েন্স হবে না । সাব্বিরের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করবেন তিনি এসে পৌছান নি, তার গতকালই এসে পৌঁছানাের কথা। তাকে ছাড়া শুটিং শুরু করা যাচ্ছে না। ভদ্রলােক সবাইকে খুব বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। তবে ডিরেক্টর
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
সাহেবের মধ্যে এ নিয়ে কোন দুঃশ্চিন্তা লক্ষ্য করছি না। কোন কিছু নিয়েই দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ না হবার ক্ষমতা এই মানুষটার আছে । কেমন গা এলিয়ে সিগারেট টানছেন যেন মনে হচ্ছে তিনিই রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার—পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছুটি কাটাতে স্বয়ং দুর্গাপুরের পাহাড়ে এসেছেন । ছুটি শুরু হয়েছে।
পাপিয়া ম্যাডামের দিকে চোখ পড়তেই দেখি তিনি হাত উঁচিয়ে আমাকে। ডাকছেন। আমি চাপা অস্বস্তি নিয়ে এগুচ্ছি। এই মহিলার সামনে কেন জানি আমি কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারি না। পাপিয়া ম্যাডাম লাল পাথরের নেকলেস পরেছেন । শিমুল ফুলের মত পাথরগুলিও জ্বলছে। তার চোখে এখন সানগ্লাস । কিছুক্ষণ আগেও সানগ্লাস ছিল না। তাঁকেতাে সারাক্ষণই লক্ষ্য করছি । কোন ফাকে সানগ্লাস পরে ফেললেন ? পাপিয়া ম্যাডামের সামনে দাড়ানাের পর আমার প্রথম যে ইচ্ছাটা হল তা হচ্ছে আমি অবিকল উনার মত একটা লাল পাথর বসানাে নেকলেস কিনব ।
পাপিয়া ম্যাডাম শান্ত গলায় বললেন, ‘বকুল তুমি ঐ মওলানার সঙ্গে গুটগুট করে কী কথা বলছিলে ? | ‘কী হচ্ছে না হচ্ছে উনি জানতে চাচ্ছিলেন।’
‘পাবলিকের সঙ্গে কোন রকম মেলামেশা করবে না । সে যদি কিছু জানতে চায়— ইউনিটের সঙ্গে কথা বলবে । তােমার ফড়ফড় করে এত কথা বলার দরকার কী ? আমি তােমার ভালর জন্যেই বলছি।
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘তুমি আমার উপর রাগ করছ নাতাে?’
জ্বি না।’ ‘শাে বিজনেসে যারা থাকে তাদের সবার উচিত মানুষজনের কাছ থেকে একটু দূরে থাকা। লােকজন আসবে নানান কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে । তুমি খােলা মনে উত্তর দেবে–তারপর সেগুলি ফুলিয়ে ফাপিয়ে অন্যদের বলবে। মওলানা সাহেবকে আমার খুব কনসপিকিউয়াস মনে হচ্ছে | মওলানা মানুষ তিনি থাকবেন মসজিদে, শুটিং স্পটে কেন?’
মঈন সাহেব হাসি মুখে বললেন— মানুষের স্বাভাবিক কৌতুহল ! বেচারা মওলানা বলে তার কৌতূহল থাকবে না ?
পাপিয়া ম্যাডাম খুব ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন, প্লীজ দয়া করে তুমি আল্লাদী ধরনের কথা বলবে না। মওলানাকে বেচারা বলছ কেন ? বেচারার ডেফিনেশন
কী ?
মঈন সাহেব বেচারার ডেফিনেশন শুরু করলেন–– আর আমি আশ্চর্য হয়ে লােম ব্যাপারটা কী, পাপিয়া ম্যাডাম ইনাকে তুমি তুমি করে বলছেন কেন ? কে ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে যতবার কথা বলতে শুনেছি ততবারই আপনি তে শুনেছি। আজ হঠাৎ তুমি কেন ? ‘পাপিয়া শােন, বেচারা মানে হচ্ছে নেই-চারা। বে হল নেই, কাজেই বে “নেই চারা। চারা হল চারাগাছ । অর্থাৎ যার শিকর আছে । গাছ নেই মানে *ড়েও নেই। কাজেই বেচারার অর্থ দাঁড়াচ্ছে–– শিকড়হীন মানুষ।‘
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
পাপিয়া ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, মঈন ভাই শুনুন । যা কিছু একটা =জক দাড়া করালেইতাে হয় না। লজিক ব্যাপারটাকে আপনি খেলাে করে লেছেন।
তাই কি ?
হ্যা তাই। আমি আপনার লজিক লজিক খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত । এবার ক্ষান্ত দিন। অনেকতাে হল!
তুমি দেখি সত্যি সত্যি রাগ করছ—“শােন পাপিয়া আমি আসলে রসিকতা ছিলাম। তুমি মনে হচ্ছে আজকাল রসিকতাও নিতে পারছ না। তােমার কি রীর খারাপ ? | ‘হ্যা আমার শরীর খারাপ।
‘পাপিয়া শােন, তুমি একটা কাজ কর– নার্ভ রিলাক্স করে এ জাতীয় দু’টা | G্যাবলেট খেয়ে শুয়ে থাক । বিশ্রাম নাও। আজ তােমার কোন শর্ট হবে না।
পাপিয়া ম্যাডাম সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। দু’জনের কথা কাটাকাটির মধ্যে পড়ে আমি খুবই বিব্রত বােধ করছি। পাপিয়া ম্যাডাম এখন অবশ্যি ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে আপনি আপনি করেই কথা বলছেন। মনে হয় উনার শরীর আসলেই ভাল না । কখন আপনি বলছেন, কখন তুমি বলছেন বুঝতে পারছেন না। উনি দ্রুত পা ফেলে এগুচ্ছেন আমি যাচ্ছি তার পেছনে পেছনে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে উনি এখনই বলবেন— এই মেয়ে তুমি আমার পেছনে পেছনে অসছ কেন ? আমি কেন উনার পেছনে পেছনে যাচ্ছি তাও বুঝতে পারছি না। রেগে যাওয়া মানুষের সঙ্গে থাকতে নেই। রেগে যাওয়া মানুষ তার রাগ চারদিকে ছড়িয়ে দেয়। আমি জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই উনার বাগের খানিকটা আমার উপর এসে পড়বে।
হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী
বকুল। ‘জ্বি। ‘তােমার মা তােমাকে এক ডাকে কেন ?
‘আদর করে ডাকেন | বকুল থেকে বন্ধু ।
এইসব আদর ভাল না। তুমি শাে বিজনেসের মেয়ে। তোমার নাম লােকের মুখে মুখে ফিরবে—এইখানে বন্ধু আবার কী ? তা ছাড়া বকুল নামটাওতাে ভাল না । শাে বিজনেসে নাম হবে ফ্লাওয়ারী। বকুল ফুলের নাম হলেও ফ্লাওয়ারী নাম।
তােমার আর কোন নাম নেই?’
‘আমার ভাল নাম~~ মালিহা রুমালী।
‘রুমালী নামটাতাে বেশ ইন্টারেস্টিং। তবে মালিহা না। মা দিয়ে যে সব নাম শুরু তার কোনটাই আমার ভাল লাগে না? সেইসব নামে মা মা গন্ধ থাকে। শাে বিজনেসের মেয়ের নামে মা মা গন্ধ থাকা ঠিক না। রুমালী নামটা
অবশ্যি ভাল।‘