হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-৮)

‘আমি মঈন স্যারের কাছে গিয়েছিলাম একটা চাকরির জন্যউনি বিখ্যাত মানুষউনার কত জানাশুনা, উনি একটু বলে দিলেই আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে যায় এই আশায় যাওয়া । উনি বললেন—– আমার সঙ্গে দুর্গাপুরে চলচলে এসেছি‘ 

হুমায়ুন আহমেদ রুমালী‘ভাল করেছেননা, খুব ভাল করি নিএক কাপড়ে চলে এসেছি।এক কাপড়ে এলেন কেন

‘স্যারকে চাকরির কথা বলতেই উনি বললেন, চল আমার সঙ্গে দুর্গাপুরে আমি বললাম, জ্বি আচ্ছা এই বলেই স্যার ঘর থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলেনউনি যে তখনই দুর্গাপুর যাচ্ছেন তাতাে আমি জানি নাউনি জীপে উঠলেন, জীপের পেছনে ইউনিটের বাস । আমি বাসে উঠলাম। 

‘দুর্গাপুরে পৌছে উনি আপনাকে কিছু বলেন নি ? 

‘ জ্বি-না। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে উনি বােধ হয় আমার কথা ভুলেই গেছেন। আমাকে হয়ত ইউনিটের কেউ ভাবছেন। আমি যে নিজ থেকে তাঁকে কিছু বলব সেই সাহসও আমার নেই। আমি উনাকে খুবই ভয় পাই।’ 

‘সবাই ভয় পায়। আমিও ভয় পাই। আচ্ছা আপনিতাে গাছ পালা খুব চেনেন। এই গাছগুলির নাম কী ? সাদা সাদা ফুল। 

‘এই গাছের নাম দলকলস । ফুলে খুব মধু হয়। বাচ্চারা ফুল ছিড়ে ছিড়ে মধু খায় ।

‘সত্যি ? ‘হা সত্যি। খেয়ে দেখুন।’ 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

সেলিম ভাই ফুল তুলে দিলেন। ঠোটে লাগিয়ে কীভাবে টানতে হয় দেখিয়ে দিলেন। আমি টান দিতেই সত্যি সত্যি মুখের ভেতর মধু চলে গেল। হালকা মিষ্টি মধু! আশ্চর্যতাে । 

‘আরাে মধু খাবেন ? ফুল তুলে দেব ?’ * দিন। 

সেলিম ভাই ফুল তুলছেন। আমি মুখে দিচ্ছি, টেনে টেনে মধু নিয়ে ফুল ফেলে দিচ্ছি— আমার খুবই মজা লাগছে। 

বকু! এই বক!’ 

আমি তাকিয়ে দেখি মা ছুটতে ছুটতে আসছেন। সেলিম ভাই এর সঙ্গে আমাকে দেখে মা’র নিশ্চয়ই আত্মা কেঁপে গেছে। তিনি যে ভাবে ছুটছেন তা দেখে যে কেউ বলবে এই মাত্র তিনি কোন ভয়াবহ দুঃসংবাদ শুনেছেন। আমার হঠাৎ কেন জানি ইচ্ছে হল মা’কে আরাে ঘাবড়ে দি। সেলিম ভাইকে কী বলব, সেলিম ভাই কিছু মনে করবেন না—আপনি ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যে আমার হাতটা একটু ধরুন তাে। হাতটা ধরবেন এবং হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন–আর কিছু লাগবে না। বললাম না, কারণ এই ঘটনায় মা যতটা না ঘাবড়াবেন তারচে বেশি ঘাবড়াবেন সেলিম ভাই ।। 

থাক দরকার নেই। আমি মার দিকে তাকিয়ে আছি তিনি উন্মাদিনীর মতই ছুটে আসছেন। তিনি তাঁর ঝিনুক-কন্যাকে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে ডালা বন্ধ করে দেবেন । অনেকক্ষণ ধরে মেয়ে ঝিনুকের বাইরে। আর সময় দেয়া যায় না। 

আমি মার দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সেলিম ভাই বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। দলকলস গাছের নামটা বলার জন্যে তাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত। ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে না ।  

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

মা ডাঙ্গায় তােলা মাছের মত খাবি খাওয়ার মত করছেনবড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। ছুটে আসার ধকল কাটাচ্ছেনতাঁর শরীরের অবস্থা যা ছােটাছুটি কমিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু মা সহজ স্বাভাবিক ভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারেন না তাঁকে কিশােরী মেয়েদের মত ছুটে যেতে হবে এবং ফলস্বরূপ অনেকক্ষণ ধরে খাবি খেতে হবে। 

‘বকু পানি খাব।’ 

এইখানে পানি কোথায় পাবে ? তুমি অলিম্পিকের দৌড় দিলে ব্যাপার কী মা ? আচ্ছা থাক এখনি জবাব দিতে হবে নাতুমি সুস্থ হয়ে নাও। বসবে ? ঘাসের উপর বসে পড়শাড়ি নষ্ট হলে হবে‘ 

মা ঘাসের উপর বসে পড়লেনআমি অপেক্ষা করছি কখন তিনি স্বাভাবিক। হবেন ।। 

‘দারুণ এক ঘটনা বকুদারুণ ঘটনা শুনব, তােমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হােক। 

ঘটনা শুনলাম, আমার কাছে তেমন দারুণ কিছু মনে হল না। চন্ডিগড় গ্রামে হাফিজ আলি বলে এক যুবক আছে তার স্ত্রীর নাকি অদ্ভুত ক্ষমতাযাকে যা বলে তাই হয়সবাই এই মেয়েকে খুব মানেমা বৌটির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেনদেখা করে সেখান থেকেই দৌড়তে দৌড়তে আসছেন| মা তােমার ধারণা বৌটার সত্যি সত্যি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে ? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী

‘অবশ্যই আছে।‘ 

‘তােমাকে দেখে সে কী ভবিষ্যত্বাণী করল ? ফড়ফড় করে কি বলে দিল—একদিন আপনার কন্যা বাংলাদেশের এক নম্বর নায়িকা হবে? তার এসি লাগানাে গাড়ি থাকবে। গুলশানে বাড়ি থাকবে। বাড়িতে সুইমিং পুল থাকবে সেই সুইমিং পুলে তুমি তােমার মেয়েকে নিয়ে সাঁতার কাটবে।’ 

সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করিস না বকুবৌটার ক্ষমতা আসলেই অস্বাভাবিকআমি ওদের বাড়িতে গেলামবৌটা দরজা ধরে দাঁড়াল। 

দেখতে কেমন মা ?“দেখতে খারাপ না। সুন্দরই আছে। বয়স কমতাে। কম বয়সের যে সৌন্দর্য সেই সৌন্দর্য। 

‘তােমাকে কী বলল

আমাকে দেখেই বলল, আপনার স্বামী দূর দেশে থাকেনচিন্তা করবেন না উনি ফিরে আসবেন। 

‘ভূয়া কথা । তােমার স্বামী দূর দেশে থাকে না, ঢাকা শহরেই থাকে, এবং সেই স্বামী কখনাে ফিরে আসবে না‘ 

‘তুই সব জেনে ফেলেছিস এই ভাবটা দূর করতাে। এই দুনিয়ার তুই কিছুই জানিস না।’ 

‘যা জেনেছি তাই আমার জন্যে যথেষ্ট। আর জানতে চাই না।’ 

‘তুই আমার সঙ্গে চলতাে বকুল । বৌটার কাছে তােকে নিয়ে যাই। দেখি বৌটা তােকে দেখে কী বলে।’ 

‘আমি এইসব বিশ্বাস করি না মা। আমি মরে গেলেও ঐ মহিলা পীরের কাছে যাব না।। | ‘পীর না। খুব সাধারণ মেয়ে তবে খুব ক্ষমতা কার মনের ভেতর কী আছে সব বলে দিতে পারে।’ 

‘তাহলেতাে আরাে যাব না। আমার মনের ভেতর ভয়ংকর সব জিনিস আছে। এইসব জেনে ফেললে অসুবিধা আছে।’ 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *