হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী -(পর্ব-৯)

‘তাের মনের ভেতর কী আছে? 

‘তােমাকেতাে মা আমি বলব না। আর যদি মনের ভুলে কোনদিন বলে ফেলি তুমি গলা টিপে আমাকে মেরে ফেলবে । আমি এখনি মরতে চাই না। আরাে কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই মা দেখ দেখ জীবন বাবুর চিল । আকাশে উড়ছে।’ 

হুমায়ুন আহমেদ রুমালীজীবন বাবুর চিল মানে ? 

কবি জীবনানন্দ দাশের চিল—সােনালী ডানার চিল ! কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরপাক খাচ্ছে দেখেছ মা ? 

‘তুই আমার সঙ্গে বৌটার কাছে যাবি না?’ 

না। এবং আমার একটা উপদেশ শােন মা, তুমিও যেও না। আগে ভাগে ভবিষ্যৎ জানা খুবই ভয়ংকর ব্যাপার।’ 

‘ভয়ংকর ব্যাপার কেন ? 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

‘তুমি বাবার সঙ্গে সুন্দর কিছু সময় কাটিয়েছ না? তুমি যদি গােড়া থেকেই জানতে একদিন বাবা তােমাকে ছেড়ে চলে যাবে তাহলে কি এত সুন্দর সময় কাটাতে পারতে ? 

‘তুই বেশি জ্ঞানী হয়ে যাচ্ছিস বন্ধু । এত জ্ঞানী হওয়া ভাল না।’ 

আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে জীবনবাবুর চিল উড়ছে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে চিলগুলি । হায় চিল, সােনালী ডানার চিল । এই ভিজে মেঘের দুপুরে…… ! 

অনেকক্ষণ হল সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখছিশত শত জোনাকি পােকা, জ্বলছে নিভছেকী যে আশ্চর্য হচ্ছিজোনাকি পােকা আগে দেখি নি তা না অনেক দেখেছিকিন্তু এত জোনাকি পােকা এক সঙ্গে কখনাে দেখি নি। মনে হচ্ছে থােকায় থােকায় আলাের ফুল ফুটেছে। ফুলগুলি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। চঞ্চল অস্থির কিছু ফুলপৃথিবীতে কত অদ্ভুত দৃশ্যই না আছে। 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

আমার জীবনের প্রথম জোনাকি পােকা দেখার দৃশ্যটাও খুব অদ্ভুত ছিল । বাবা-মার সঙ্গে ট্রেনে কোথায় যেন যাচ্ছিরাতের ট্রেনট্রেনের বাতি হঠাৎ নিভে গেলমা বিরক্ত হয়ে নানান কথা বলতে লাগলেন-~~~-“ছাতার এক দেশে ছাতার এক ট্রেনএখন ডাকাত পড়বে জানা কথা” এই সব মায়ের কথা শুনে আমার ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি দ্রজা জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে একদল ডাকাত ঢুকে পড়বে। ডাকাত ঢুকল নাকী ভাবে জানি একটা জোনাকি পােকা ঢুকে পড়ল বাবা বললেনরুমালী দেখ একটা জোনাকি পােকা আমি অবাক হয়ে দেখছি কী সুন্দর আলাে এই জুলছে, এই নিভছে ।

বাবা বললেন বেচারা জোনাকি একা একা ট্রেনে করে কোথায় যাচ্ছে কে জানেআমারাে মনে হল তাইতাে—এর বন্ধু বান্ধব, সঙ্গী সাথী সব কোথায় পড়ে আছেআর সে একা একা চলে যাচ্ছে। বাবা জোনাকি পােকাটা ধরে আমার হাতে দিয়ে বললেন—মুঠি বন্ধ করে ধরে থাকআঙ্গুলের ফাক দিয়ে আলাে আসবে। আমি মুঠি বন্ধ করে ধরে আছি। উত্তেজনায় আমার শরীর কাপছেমা বললেন, বকু এখনই জোনাকি পােকা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেফেলে দে বললাম। 

আমি বললাম, কেন ? | মা চাপা গলায় বললেন, গাধা মেয়ে, জোনাকি পােকা ধরে রাখলে রাতে বিছানা ভিজানাে রােগ হয়। 

আমি বললাম, বিছানা ভিজানাে রােগটা কী ? 

মা আরাে গলা নামিয়ে বললেন—প্রতি রাতে বিছানায় পেচ্ছাব করবি। গাধা মেয়ে । বিয়ের পরেও এই অভ্যাস যাবে না। 

কী সর্বনাশের কথা। আমি জোনাকি পােকাটাকে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। সে যতক্ষণ উড়ে গেল আমি তাকে দেখার চেষ্টা করলাম। যে হাতে পােকাটা ধরেছিলাম কে দেখি সেই হাতে কেমন অদ্ভুত দুর্বা ঘাসের গন্ধের মত গন্ধ । 

‘মিস রুমাল! 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

আমি চমকে দেখি সােহরাব চাচা। তাঁর হাতে প্রকান্ড বড় একটা বালতি। ফিল্ম লাইনের সবকিছুই খানিকটা উদ্ভট। এত বড় বালতি আমি আগে দেখি নি। 

‘কী করছ গাে মা ? ‘ ‘জোনাকি পােকা দেখছি চাচা।’ ‘জংলা জায়গা। জোনাকি-ফোনাকি কত কিছু দেখবে । চা কফি কিছু খাবে? ‘জ্বি না। ‘ 

‘কিছু লাগলে বল— আমি বাজারে যাচ্ছি। পাপিয়া ম্যাডামের সবুজ কালির বল পয়েন্ট দরকার । এখন আমি সবুজ কালির বল পয়েন্ট কোথায় পাব কে জানে নেত্রকোনা ছাড়া পাওয়া যাবে না। ‘ 

নেত্রকোনা যাবেন?’ ‘এখানে না পেলে যাব।’ ‘আমি পাপিয়া ম্যাডাম হলে আপনাকে একটা জিনিস দিতে বলতাম।’ ‘জিনিসটা কী?’ 

‘ফুলের মালার মত একটা জোনাকি পােকার মালা। মালা গলায় দিয়ে বসে থাকতাম—মালা জ্বলতাে নিভতাে। 

সােহরাব চাচা সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় বললেন, আচ্ছা দেখি কী করা যায় । মৌমাছির মােম জোগাড় করতে পারলে জোনাকির মালা বানানাে যাবে। 

আমি বললাম, আমি ঠাট্টা করছিলাম চাচা। আপনাকে জোনাকির মালা বানাতে হবে না। আপনি ভারী বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বালতিটা রাখুন তারপর কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প করুন। 

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

সােহরাব চাচা বালতি নামিয়ে রাখলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, বল কী গল্প শুনতে চাও | 

তাঁর ভাবটা এ রকম যে, আমি যে গল্পই শুনতে চাই, তিনি সেই গল্পের রেকর্ড বাজিয়ে দেবেন। 

‘মহিলা পীরের গল্প বলুন। 

সােহরাব চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, মহিলা পীরটা কে

এই অঞ্চলে একজনের সন্ধান পাওয়া গেছে যে নিমিষের মধ্যে মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান বলে দিতে পারে‘ 

ও আচ্ছাহাফিজ আলির বৌ এর কথা বলছ ? ‘বৌটাকে আপনি দেখেছেন

‘ন তাকে দেখি নি হাফিজ আলিকে দেখেছি সকালবেলা সে ছিলতােকাঠ ফাড়াই করে দিল ফাকিবাজের শেষ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সারাদিনের জন্যে নিয়েছি। দুপুরের পর থেকে নেই।‘ 

তার বৌ যে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এটা কি সত্যি! আরে দূর দূর গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই এই জাতীয় খবর শুনবে 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *