বন্ধু তুই রােদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?‘ আমি পাশ ফিরে মাকে দেখলাম । মা কোন ফাঁকে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বিড়ালের চেয়েও নিঃশব্দে হাঁটতে পারেন। আশে পাশে কেউ নেই, আমি হয়ত নিজের মনে গল্পের বই পড়ছি।
এক সময় হঠাৎ দেখৰ মায়ের মাথাটা আমার ঘাড়ের পাশে। তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বলবেন, কী পড়ছিস? আমি যদি বলি গল্পের বই মা বলবেন, আজে বাজে গল্প নাতাে? দেখি বইটা। মা বইটা হাতে নেবেন। বই এর নাম পড়বেন। নামের মধ্যে প্রেম ভালবাসা জাতীয় কিছু থাকলে তার ভুরু কুঁচকে যাবে। আমি যে পাতাটা পড়ছি সেই পাতাটা পড়ে দেখবেন। এই হচ্ছে আমার মা সাবিহা বেগম। বয়স আটত্রিশ । সেই বয়স তিনি নানান ভাবে কমানাের চেষ্টা করছেন ।
মুখের চামড়ায় ভাজ পড়েছে। সেই ভাজ দূর করার অনেক চেষ্টা চলছে। তিনি কোত্থেকে একটা বই জোগাড় করেছেন। নজিবুর রহমান নামের এক ভদ্রলােকের লেখা—“যৌবন ধরে রাখুন । সেই বই-এ মুখের চামড়ার ভঁজ দূর করার যে সব প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা আছে তার কিছু কিছু প্রয়ােগ করছেন। তেমন লাভ হচ্ছে না। আমার ধারণা খানিকটা ক্ষতি হচ্ছে। মা’র চোখ দু’টা ভিতরে ঢুকে চেহারায় খানিকটা ইঁদুর ভাব চলে এসেছে।
হুমায়ুন আহমেদ রুমালী
এখন বাজছে সকাল ন’টা এর মধ্যেই মা গােসল করে ফেলেছেন। চোখে কাজল দিয়েছেন। ম্যাচ করে শাড়ি ব্লাউজ পরেছেন । হাতে একটা ভ্যানিটি ব্যাগও আছে। সেই ব্যাগের রঙও শাড়ির রঙের সঙ্গে মেলানাে – সবুজ। মা বললেন, কিরে বকু রােদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
মার গলায় প্রবল উৎকণ্ঠা—যেন রােদে দাঁড়ানাের কারণে আমার শরীরে কিছুক্ষণের মধ্যে ফোসকা পড়ে যাবে। অথচ আমি মােটেই রােদে দাঁড়িয়ে নেই। আমি দাড়িয়ে আছি বিশাল একটা শিমুল গাছের নীচে। শিমুল গাছে কোন পাতা নেই— শুধুই থােকা থােকা ফুল ! এমন কড়া লাল রঙ যে—- তাকালে চোখ ধাধিয়ে যায়। মনে হয় গাছে আগুন ধরে গেছে। এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার মনে হচ্ছে আমার মাথার উপর আগুন জ্বলছে । দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে ! গাছে হেলান দিতে পারলে আরাে ভাল হত কিন্তু হেলান দেবার উপায় নেই— গাছ ভর্তি বড় বড় কাটা । আমি মার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম । এই মিষ্টি হাসি হচ্ছে নকল মিষ্টি। অভিনয়ের মিষ্টি হাসি। আমি যখন তখন এই হাসি হাসতে পারি । মা আবারাে বললেন, কিরে কথা বলছি জবাব দিচ্ছিস না কেন ?
হুমায়ুন আহমেদ রুমালী
আমি বললাম, মা তােমাকে খুব সুন্দর লাগছে ।
মা এই প্রশংসাতেও টললেন না। প্রায় ধমকের গলায় বললেন–— শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
কারণ আছে বলেই দাঁড়িয়ে আছি।‘ ‘কারণটা কী ?
কারণটাতাে মা তােমাকে বলা যাবে না।‘ ‘ফাজলামি করবি না। ‘আমাকে ডিরেক্টর সাহেব থাকতে বলেছেন।
সঙ্গে সঙ্গে মা‘র মুখে তৃপ্তির হাসি দেখা গেল । খুশি : ডিরেক্টর সাহেব থাকতে বললেতাে থাকতেই হবে। এই মুহূর্তে তিনিই সব কিছু আমাদের সম্রাট। সম্রাটের প্রতিটি কথা পালন করতে হবে। তাকে খুশি রাখতে হবে । মা‘র এখন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্রাটকে খুশি রাখা। তার আশেপাশে থাকা। সম্রাটের সস্তা ধরনের রসিকতায় হা হা হি হি করে হাসা । আমাদের এই সম্রাটের ধারণা তিনি খুব রসিক মানুষ। ডিরেক্টর সাহেবের নাম মঈন খান। বয়স ঠিক কতু এখনাে জানি না— চল্লিশের উপরতো বটেই। রােগা পাতলা মানুষ। ভদ্রলােকের মধ্যে একটা বহুরূপী ব্যাপার আছে। একেক দিন তাকে একেক রকম দেখা যায়। আমার মনে হয় ব্যাপারটা ঘটে তার চশমার কারণে। ভদ্রলােকের অনেকগুলি চশমা। একেক দিন একেক রকমের চশমা পরেন। চশমার সঙ্গে মিলিয়ে চুল আচড়ানাের মধ্যেও কিছু একটা নিশ্চয়ই করেন। তাঁর চেহারা পাল্টে যায়। চেহারার সঙ্গে সঙ্গে ভাবভঙ্গি পাল্টে যায়। আজ তিনি সােনালী ফ্রেমের চশমা পরেছেন।
হুমায়ুন আহমেদ রুমালী
মা বললেন, মঈন ভাই তােকে এখানে থাকতে বলেছেন ? ‘হঁ্যা।‘ ‘কেন?’ ‘কাজ দেখতে বলেছেন।’
‘তাতাে বটেই— কাজ না দেখলে কাজ শিখবি কীভাবে?
মা লম্বা লম্বা পা ফেলে ডিরেক্টর সাহেবের দিকে এগুচ্ছেন। আমি শংকিত বোধ করছি। কারণ ডিরেক্টর সাহেব আমাকে এখানে দাড়িয়ে থাকতে বলেন নি। শমুল গাছটা দেখে আমার এত ভাল লেগেছে যে আমি ইচ্ছা করে এখানে এসে। নড়িয়েছি। শুটিং এর কাজ হচ্ছে রাস্তার ঐ পাশে। ন’দশ বছরের একটা মেয়ে এবং চার পাঁচ বছরের একটা ছেলেকে দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেই সকাল থেকে। মেয়েটার পরণে ফ্রক ! ছেলেটা সম্পূর্ণ নগ্ন। শুধু তার কোমরে কালাে
তা বাঁধা। সুতার সঙ্গে তিনটা শাদা কড়ি।
যে দৃশ্যটা এখন নেয়া হবে সেই দৃশ্যটা এরকম—এই দুই ভাই-বােন পানিতে ঝাপাঝাপি করছিল। হঠাৎ দেখতে পেল শহুরে কিছু মানুষ চারটা গরুর “ড়িতে করে যাচ্ছে। শহুরে মানুষদের গায়ে ঝলমলে পােষাক, তারা আনন্দ করতে করতে যাচ্ছে। এই দেখেই দুই ভাই-বােন পানি থেকে উঠে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়াবে । কৌতূহলী চোখে গরুর গাড়ির ভেতরের মানুষগুলিকে দেখতে চেষ্টা করবে। গরুর গাড়ির ভেতরে সাকির নামের এক ভদ্রলােক ক্যামেরায় তাদের ছবি তুলতে যাবেন—ওমি মেয়েটা হেসে ফেলবে, আর ছেলেটা দু’ হাতে তার নেংটো ঢেকে ফেলবে ।
হুমায়ুন আহমেদ- রুমালী
খুব সহজ দৃশ্য। অন্য কেউ হলে ফট করে নিয়ে নিত। কিন্তু আমাদের ডিরেক্টর সাহেব এই দৃশ্যটাকে যথেষ্ট জটিল করে ফেলেছেন। রাস্তার পাশে ট্রলী পেতেছেন। দৃশ্যটা নেয়া হবে ট্রলীতে। রিফ্লেক্টর বাের্ড হাতে তিনজন লাইটম্যান পঁড়িয়ে আছে। এরা একটু পরপর ধমক খাচ্ছে ।ট্রলীও বােধ হয় ঠিকমত বসছে
— ক্যামেরা কাপছে। কোদাল দিয়ে রাস্তাটা সমান করে ট্ৰলী বসানাে হয়েছে। তারপরেও বােধ হয় রাস্তা সমান হয় নি। ডিরেক্টর সাহেবের কাছ থেকে ক্যামেরাম্যান ও ছােট্ট একটা ধমক খেলেন।
বাচ্চা দু’টি পুকুর থেকে উঠে এসেছে বলে তাদের গা ভেজা থাকার কথা। রােদে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের গা শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন তাদের মাথায় বালতি ভর্তি পানি ঢালা হচ্ছে। এই কাজটিতে এরা দুজনই খুব মজা পাচ্ছে । মনে হচ্ছে তাদের জীবনে এমন আনন্দময় মুহূর্ত আর আসে নি।
আমি লক্ষ্য করলাম মা ছুটতে ছুটতে যাচ্ছেন। আমি মার মুখ দেখতে পাচ্ছি না—কিন্তু আমি জানি তার মুখ ভর্তি হাসি।
আজকের পরিস্থিতি মােটেই ভাল না। এখনাে ক্যামেরা ওপেন হয় নি। এই অবস্থায় মা গিয়ে কী না কী বলবে কে জানে! তাদের কথাবার্তা এরকম হতে পারে । মা বলবেন, মঈন ভাই আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে ? { আপনার কাজ কেমন হচ্ছে, না-জিজ্ঞেস করে মা বলবেন—- আমাদের কাজ কেমন হচ্ছে। মা প্রমাণ করতে চাইবেন যে উনার কাজটাকে মা নিজের কাজ ভাবছেন। }
মঈন সাহেব মার কথার জবাবে কোন কথা বলবেন না, ট হয়ত হাসবেন। মেজাজ ভাল থাকলে অবশ্যি মা’র সঙ্গে রসিকতা করে কিছু বলবেন । আজ মেজাজ ভাল নেই। মা তা ধরতে পারবেন না। কারণ মা অন্যের মেজাজ মর্জি কিচ্ছু বুঝতে পারেন না। নিজের মনে ছড়বড় করে কথা বলে যান।
হুমায়ুন আহমেদ- রুমালী
আমার ধারণা মা এক পর্যায়ে বলবেন—মঈন ভাই, আমার মেয়ে আপনাকে কী চোখে যে দেখে আপনি যা বলেন তাই তার কাছে একমাত্র সত্য । আপনি তাকে কাজ দেখতে বলেছেন– ঐ দেখুন সে রােদে পঁড়িয়ে আছে। আপনি তাকে ছায়ায় দাঁড়াতে বলুনতাে। আপনি না বললে যাবে না। আশ্চর্য মেয়ে। কী সমস্যায়
যে ভাই মেয়েটাকে নিয়ে আছি । | মঈন সাহেব তখন ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাবেন। কী হচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করবেন। তিনি বলে ফেলতে পারেন-~-কই আপনার মেয়ের সঙ্গে আজ আমার কোন কথা হয় নি। তখন অবস্থাটা কী হবে! ডিরেক্টর সাহেবের কাছে মা’র ছুটে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে—– আমার কথা যাচাই করে নেয়া। মা’র স্বভাব হচ্ছে— যে যাই বলুক মা যাচাই করে নেবেন।
মা কাউকেই বিশ্বাস করেন না। কোন ফেরেশতা এসে যদি মাকে বলে – আপা শুনুন, আপনার মেয়েকে দেখলাম একা একা রিকশায় করে নিউ মার্কেটে যাচ্ছে। মা সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, ও কী রঙের সালােয়ার পরেছে বলুনতো?