হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী (শেষ-পর্ব)

এত জোরে চিৎকার করো না মা ভােকাল কর্ড নষ্ট হয়ে যাবেবাকি জীবন হাঁসের মত ফ্যাস ফ্যাস করতে হবেহুমায়ুন আহমেদ রুমালী

তুই এতক্ষণ ধরে মুখ ধুচ্ছিস কেন?‘ 

আমি হাসলাম । বেসিনের উপরে পারা নষ্ট হয়ে যাওয়া আয়না বসানােসেই আয়নায় সব কিছুই ঢেউ খেলানাে দেখায়আমি আয়নায় দেখলাম একটা মেয়ে ঢেউ খেলানাে হাসি হাসছে। আয়নাতেই দেখা যাচ্ছে মা নেমে আসছেন। তিনি ধাক্কা দিয়ে আয়নায় আমার মাথা ঠুকে দেবেন। ঝনঝন শব্দে আয়না ভাঙ্গবে । ভাঙ্গা কাচ ঢুকে যাবে কপালেঅভিনয় করতে হবে কপালে কাটা দাগ নিয়ে নাকি তিনি বাথরুমের দরজা বন্ধ করে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। ফাঁসির আসামীকে ছােট্ট ঘরে আটকে রাখলে তার কী হয় আমি জানি আমার যদি কখনাে ফাসি হয়তাহলে সলিটারী কনফাইনমেন্টে থাকার সময়টা আমার খুব খারাপ কাটবে না । 

মা ঈগলের মত ছুটে আমার কাধ ধরে ফেললেন আর তখনি ঘরে ঢুকলেন পাপিয়া ম্যাডাম মামুখ সঙ্গে সঙ্গে হাসি হাসি হয়ে গেলতাকে দেখে এখন মনে হবে তিনি তার অতি আদরের কন্যার সঙ্গে বাথরুমে কিছু অন্তরঙ্গ আলাপ করছেনমা বললেন, কেমন আছেন

পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, ভাল। 

মা বললেন, মেয়ের মাথার চুল ঠিক করে দিচ্ছিলামএমন পাগলী মেয়ে, সারা সকাল কোথায় কোথায় ঘুরেছে দেখেন না চুলের অবস্থা। একা একাই রওনা হয়েছিল, আমি বললাম, একা যাবি না। সেলিমকে সঙ্গে করে নিয়ে যা। 

আমি মার স্ট্র্যাটিজি দেখে হাসলাম। তিনি সবাইকে বলে বেড়াবেন সেলিমকে আমার সঙ্গে পাহারাদার হিসেবে তিনিই পাঠিয়েছেনআমি নিয়ে যাই 

নি । 

পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, বকুল একটু বারান্দায় এসাে। আমি বারান্দায় চলে এলাম

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

মেয়েকে লেখা চিঠি তােমাকে পড়াব বলেছিলামনাও পড়ে দেখবড় বড় অক্ষরে লেখা চিঠি। 

মা, আমার মাআমার সােনা মা, ময়না মা, গয়না মাকত দিন তােমাকে দেখি না। রাতে যখন ঘুমুতে যাই, আমার পাশে তােমার বালিশটা রেখে দি বালিশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমুতে যাইআমার মনে হয় বালিশে মাথা রেখে তুমি ঘুমুচ্ছ । মা তােমাকে না দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছেআবার আমি তোমাকে কবে দেখব

তােমার 

মা । 

চিঠি পড়তে পড়তে কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল । আমি তাকিয়ে দেখি পাপিয়া ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। 

রাজকীয় ব্যাপার। প্রায় শ’খানেক মানুষ আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে। আমি হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আছি। আমার মাথার উপর শুটিং এর বিশাল রঙ বেরঙের ছাতা। আমি মেকাপ নিচ্ছি । মেকাপম্যান সুবীরদা আমার মুখে প্যানকেক ঘষছেন। মেকাপের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার এই হল শুরু | কেউ যদি জিজ্ঞেস করে শুটিং এর সবচে খারাপ অংশ কোনটি ? আমি বলব, মেকাপ নেয়া। ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর এবং মাঝেমধ্যে গ্লানিকরও। একজন পুরুষ মানুষ মুখে হাত ঘষছে— ব্যাপারটা কেমন না ?

হুমায়ুন আহমেদ -রুমালী 

তবে সুবীরদার কাছে মেকাপ নিতে কোন গ্লানিবােধ হয় না। তিনি শুরুই করেন ‘মা’ ডেকে । মেকাপের পুরাে সময়টা টুকটুক করে গল্প করেন যখন মেকাপ শেষ হয়ে যায় তখন মনে হয়—আহা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কেন ? আরও খানিকক্ষণ থাকলে কী হত! মজার মজার গল্প শােনা যেত। 

আমি মেকাপ নিচ্ছি গাছতলায়। ঘরের ভেতর নেয়া যাচ্ছে না ঘর অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি আপাতত নেই । যখন আসে তখন বাল্বগুলি এমন মিটিমিটি করে জ্বলে যে মনে হয় ইলেকট্রিসিটি থাকাটাই ভাল ছিল । 

গাছের নীচে রাণী রাণী ভাব ধরে মেকাপ নিতে আমার ভালই লাগছে । সুবীরদা মাথার উপর ছাতা দিয়ে ভাল করেছেন। পাখিরা এখন আর মাথায় বাথরুম করতে পারবে না । পরশু বিকেলে পাপিয়া মাডাম গাছের নীচে বসে কফি খাচ্ছিলেন হঠাৎ তার মাথায় পাখি বাথরুম করে দিল। আমি খুব ভদ্র ভাষা ব্যবহার করলাম। আসলে আমার বলা উচিত— পাখি ‘গু করে দিল। তিনি পাখিদের কাণ্ডে হতভম্ভ হয়ে গেলেন। কফি খাওয়া তাঁর মাথায় উঠল ! সাবান শ্যাম্পু নিয়ে ছােটাছুটি পরে গেল। মাথা ধােয়া হল কয়েকবার । মাথায় আয়না ধরা হলাে। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন- এখনাে পরিষ্কার হয় নি। 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *