হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি শেষ খন্ড

খুব ভালো কথা। মেয়েকে ডেকে ‘রায় নিয়ে দাও। আর দেলােয়ারকে বল তাকে যেন রেলস্টেশনে নিয়ে ট্রেনে তুলে দেয়। সে কি এক বস্ত্রে যাবে, না একটা স্যুটকে সঙ্গে নিতে পারবে? | আজহার সাহেব একদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন। তার হাত কাপছে। মনে হচ্ছে তিনি চোখেও ঝাপসা দেখছেন মনােয়ারার মুখ কেমন যেন অস্পষ্ট লাগছে।

মীরার গ্রামের বাড়ি 

মনােয়ারা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, যা করবে নিজের সম্মান বজায় রেখে করবে। লােকজন যেন কানাকানি না করে। আচ্ছা শােন, মেয়েকে গলা টিপে মেরে দড়ি দিয়ে ঘরে ঝুলিয়ে দিলে কেমন হয়? আমরা আত্মহত্যা বলে প্রচার করে দেই। তােমার কি ধারণা এতে সব দিক রক্ষা হয়? 

আজহার সাহেব আবারাে উঠে দাঁড়াতে গেলেন, মনােয়ারা তাকে ধরে বসিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বললেন—না তুমি উঠবে না। তুমি জাজ সাহেব, রায় 

দিয়ে আমি তোমাকে উঠতে দেব না। 

আজহার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, তুমি যা ভালাে বােঝ কর। “আমার উপর দায়িত্ব 

এই দায়িত্ব সবসময় মেয়েদেরই নিতে হবে কেন? ছেলেরা তেল ? ছেলেরা কি পৃথিবীতে এসেছে গায়ে ফু দিয়ে বেড়ানাের জন্যে ? 

“আমাকে এইসব কেন বলছ? 

মীরার গ্রামের বাড়ি শেষ খন্ড

জানি না কেন বলছি। আসলেই তো তোমাকে না জানলেই হত । আনন্দের ব্যাপারগুলি তােমাকে জানানাে যায় । সমস্যাগুলি কেন জানবে? মেয়েকে ক্লিনিকে নিয়ে ঝামেলা মুক্ত করে আনব, তুমি কিছুই জানবে না । তুমি কফি খেতে খেতে মেয়েদের সঙ্গে পাপ-খাদকের গল্প করবে । একসময় মেয়ের বিয়ে হবে। তুমি মেয়ে জামাইকে গ্রামের বাড়ি দেখাতে আনবে। তুমি তােমার। এক জগতে কী সব মহৎ কম করেই লেখাবে।” 

মনােয়ারা তুমি ঠিক করে বল। তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর ।’ তােমাকে ঘৃণা করি না আবার ভালােবাসি না। ‘ভালােবাস না?” 

না। এত অবাক হয়ে তাকাচ্ছে কেন? আমি যা করি তার নাম অভিনয়। ভালােবাসার অভিনয়। তুমি তাই কর। অ|মালের গাড়ি আমাদের শাড়ি এইসব বলে এমন ভাব করি যেন একজন আরেকজনের প্রেমে হাবুড়ৰ খাচ্ছি। আসল ব্যাপাল তা না। তুমি এখন যাও—তােমার পাথরের মতাে মুখ দেখতে ভালো লাগছে না।

তুমি গিয়ে রান্না-বান্নার জোগাড় দেখ। রাতে মাস্টারসাহেবরা খাবেন। তলে কী গল্প করবে তাও ঠিক করে রাখে। পাপ-খাদকদের গল্পটা আবারাে করতে পারি। অনেক গল্পের মধ্যে তােমার এই গল্পটা ই কমিয়ে বাচ্চা। বার বার দেখানাে যায়।” 

আজহার সাহেব ঘর থেকে বের হবার পর পরই মীরা পানির ঘাস এবং চামচ নিয়ে ঢাকল। সে দেখল মা ঘুমিয়ে পরেছেন। সে মাকে জাপাল না। আর থেকে বের হয়ে এল। সন্ধ হয়ে এনেছে। 

মীরার গ্রামের বাড়ি শেষ খন্ড

শেফা একা একা পুকুরপাড়ে বসে আছে। সে খুব ভয় পেয়েছে। একটু আগে সে ভয়ংকর একটা দৃশ্য দেখে এসেছে। নদীজানের রে বাবা বসে আছেন । বাবা হাউমাউ করে কালছেন। দাদাজান বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে। লি_সুন । এর মানে কী? কী হয়েছে? কে সে জিতল করবে। পুকুরপাড়ে লে কাদার জন্যে এসেছিল। এখন তার একটুও কান্না পাচ্ছে না। তার হাত পা পিছে । 

কামরাঙ্গা গাছ ভর্তি পাখি। বেশির ভাগই টিয়াপাখি। এরা চুপচাপ থাকে, হঠাৎ হঠাৎ সবাই একসঙ্গে ডেকে ওঠে এবং শেফা ভয়ংকর চমকে উঠে । 

শেফার ভয়-ভয় করছে। সন্ধ্যাবেলা পুকুরপাড়ে একা একা থাকা ঠিক না। অশরীর। এই সময় নেমে আসে। কিন্তু শেফা কোথায় যাবে? মা শোবার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে আছে। মায়ের ভয়ংকর কিছু হয়েছে এটা সে বুঝতে পারছে। এই ভয়ংকর কিছুটা কী? | বড় আপারও ভয়ংকর কিছু হয়েছে।

বড় আপা বারান্দায় চেয়ারে বলে আছে। তার চেহারা পর্যন্ত বদলে গেছে। তার ঠোট কীভাবে যেন কেটেছে। মাছের ঠোট বড়শি লেগে যেভাবে কেটেছিল অবিকল সেইভাবে কেটেছে। সেই ঠোট ফুলে কী বিশ্রী হয়েছে। বড় আপা ঠোটে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কী অদ্ভুত ভাবেই না বসে আছে। শেফা দুবার সামনে দিয়ে হেটে গেল কিন্তু শেফা নিশ্চিত যে আপা তাকে দেখতে পাননি। 

মীরার গ্রামের বাড়ি শেষ খন্ড

কী হচ্ছে এ বাড়িতে! মাছটা মাৱা ঠিক হয়নি। মনে হয় মৃত মাছটার অভিশাপ লেগে গেছে। মাছটা বেচে থাকলে শেফা সুশাই মাছটাকে পুকুরে ফেলে দিত। 

শেফা চমকে তাকাল। দেলােয়ার ভাই সামনে দাড়িয়ে আছেন। শেফার অবস্থাও কি তার আপার মতো হয়েছে। একটা মানুষ হেঁটে ঠিক তার সামনে এলে | Sল তারপরও শেফা তাকে দেখতে পেল । মালটা খুন কথা লল, এখনি ললি। 

ছেলের সঙ্গে যেন ছোট অশর বিবাহ হয় । হে শরিয়ারদেগার। লিগ সি মালিক, হে ইমারি রহিম, নারিশের এই দোয়া ট্রা তুমি কবুল কর । আমিন।” 

“ণে লােয়ার ভাই আমার খুব মনটা খারাপ। 

বুঝতে পারছি।’ কী হয়েছে অাপনি কি কিছু জানেন? 

জানি না ছোট আপা। তবে যাই হােক সমস্যা থাকবে না। সব আগের মতাে হয়ে যাবে? 

‘চাচাজীর উপর আল্লাহপাকের খাস রহমত আছে। পীর বংশের মানুষ। উনার শারীতি ও শুমছে। মার আমি নিজেও দোয়া করতেছি—একটা যতম শুরু মিলিয়েছে। 

মীরার দাদীমার নামাজে দাঁড়ানাের কথা। তিনি নামাজে দাঁড়াননি। ছেলের মাথায় পানি ঢালছেন। শেফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । আজহার সাহেব তার মাকে চিনতে পারছেন না, ছােট মেয়েটাকেও চিনতে পারছেন না। তিনি নিজের মনে খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প করে যাচ্ছেন। নেলরিল্যান্ডে এক আদিবাসীগােষ্ঠী আছে, যাদের বলা হয় পাপভক্ষক, Sin eaters. এরা মানুষের পাপ খেয়ে যেতে পালে । কেউ যখন মারা যায় পাপভক্ষকদের বর দেয়া হয়। এরা। দলবেধে এসে ত মাটির সব পাপ খেয়ে মনটাকে নিলােপ করে ফেলে । 

মীরার গ্রামের বাড়ি শেষ খন্ড

 আপনার উপর কি আল্লাহপাকের ব্রহমত আছে?” 

 আমি কে আমি কেউ না। তারপরেও লো করতে দােষ নাই।” “আমার ধারণা আপনি খুবই ভালাে মানুষ । আমি যখন বড় হব তখন আপনার মতাে একজন মানুষকে বিয়ে করব।’ 

আপনি রাগ করেনা তাে? না। 

আপনার মতাে গরিব-টরিব রিনের কাউকেই বিয়ে করতে হবে। কারণ আমার চেহারাতাে ভালাে না।’ 

তোমার চেহারা ভালো না কে বলেছে? ‘আমি জানি। 

না তুমি জানাে না। “দেলােয়ার ভাই।’ 

মীরা মার ঘরে ঢুকল । ক্ষীণ স্বরে ডাকল, মা। 

মনোয়ারা জেগে উঠলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় তার সবকিছু যেন কেমন এলোমেলাে লাগছে। তিনি উদভ্রান্তের মতাে এদিক-ওদিক দেখছেন। 

মীরা নিচুগলায় প্রায় ফিসফিস করে বলল, মা তুমি একটু আস ।। 

‘আপনি আমার জন্যেও দোয়া করবেন যেন আমার খুব ভালাে একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়। নিজের বিয়ের জন্যে নিজে দোয়া করতে লজ্জা লাগে। তারপরও গত শবেবরাতে আমি দোয়া করেছি।’ “আল্লাহপাক তােমার দোয়া কবুল করেছেন। 

কী করে বুঝলেন?’ “কিছু কিছু জিনিস বােঝা যায়। আমিও আজ মাগরিবের ওয়াক্ত থেকে দোয়া করব যেন এমন একজনের সঙ্গে তােমার বিবাহ হয় যে সারাজীবন তােমাকে মাথায় করে রাখে। 

মীরার গ্রামের বাড়ি শেষ খন্ড

“থ্যাঙ্ক হয়। থ্যাংক য়ু ভেরি মাচ ।” 

দেলোয়ার হাসছে। মাগরিবের ওয়ান থেকে তার দোয়া করার কথা কিন্তু সে এখনই দােয়া করে ফেলল—“চাচাজীর চেয়ে একশ গুণ ভালাে একটা 

‘বাবা কেমন যেন ছটফট করছেন। দাদীজান বাবার মাথায় পানি ঢালছেন। বাবা লে যাচ্ছে মা। 

মনােয়ারা উঠে বসলেন। মীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মা তুমি বাবাকে শান্ত কর। আর শোন—র্যাটমের যে-প্যাকেটগুলি আছে, আমাকে দাও। আমি খাব। তোমাদের এই কষ্ট আমার সহ্য হচ্ছে না মা। 

 মনােয়ারা বললেন, ভয় পাচ্ছিল কেন? আমি বেঁচে আছি না! আমার এত কষ্টের সংসার আমি জলে ভেসে যেতে দেব না। আয় কাছে আয়, আদর করে নেই। 

মীরা মাকে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, মা আমি আরেকটা অন্যায় করােছ। ড্রাইভার চাচাকে ঢাকা যেতে দেইনি। 

মলেরা মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ভাল ছেলেকে আমার দরকার নেই। আয় তাের বাবার কাছে যাই । 

 

Read More

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এর নিঝুম রাতের আতঙ্ক খন্ড-১

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *