হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৫

“জ্বি আচ্ছা। 

‘শীতের মধ্যে পাতলা একটা শার্ট গায়ে দিয়ে ঘুরছ কেন? শীত লাগে না ? তোমার গরম কাপড় আছে?” মীরার গ্রামের বাড়ি

এ দেলােয়ার লােকটাকে বলবে সে যেন হুটহাট করে আমার ঘরে না ঢোকে। সন্ধ্যাবেলা ঘুমুচ্ছি, হুট করে ঘরে ঢুকে পড়ল । গ্রামের ছেলে তো। এই ব্যাপারগুলি জানে না। 

তুমি কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন মা। তুমি তাকে বলে দেবে সে যেন আমার ধরে এইভাবে না ঢোকে।

আচ্ছা  আমি বলে লেব। এসে আমাকে আপামণি ডাকে। অসহা । তাকে বলবে যেন আপামণি না 

‘মা তোমার সঙ্গে আরেকটা শেষ কথা। আমি যে নৌকায় বলেছিলাম। তোমার গা থেকে কাদামাটির গন্ধ আসে। আসলেই আসে।’ 

ও আচ্ছা।’ 

“কিন্তু এই গন্ধটা যে আমার কী ভালাে লাগে তুমি জানাে না। তুমি রাতে ঘুমুতে যাবার আগে তােমার গায়ের গন্ধ আমাকে দিয়ে যাবে। ব্লাউজ খুলে আমি তােমার বুকে নাক ঘষব ।” 

মনােয়ারা বিরক্ত মুখে বললেন, তুই কী যে হচ্ছিস।’ তার বিরক্তির অভিনয়টা তেমন ভালাে হল না। তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমল করতে লাগল। ) 

বারান্দায় দেলােয়ার একটা মাটির মাল নিয়ে আসছে। মালশা থেকে ঝুকা ঝুকা ধােয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়ায় দেলোয়ার চোখ মেলতে পারছে না, এমন অবস্থা। মনােয়ারা বললেন, মালশায় কী দেলােয়ার? 

দেলােয়ার লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ধূপ চাচীআম্মা। তাকে যে-কোনাে প্রশ্ন। করলেই সে খানিকটা লজ্জা পায় । 

‘ধূপ জ্বালিয়েছ কেন? 

মশার খুব উপদ্রব। আপামণির ঘরে ধােয়া দিব। 

মনােয়ারা খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, মেয়েদের ঘরে ঢোকার সময় দরজা ধাক্কা দেবে, কেমন? 

দেলোয়ার লজ্জায় প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যেতে যেতে বলল, জ্বি আচ্ছা। “বােয়া না দিলেও হবে। এরা শহরের মেয়ে, ধােয়া পছন্দ করবে না। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৫

‘গরম কিছু পরবে। তােমাকে দেখে তাে আমারই শীত লাগছে। শেফাকে দেখেছ ? শেফা কোথায়?” 

ছােট মালামণি গরঘাটে।। 

‘আশ্চর্য তাে, রাতের বেলা সে পুকুরঘাটে কী করে? ওকে ঘরে আসতে বল । 

চাচাজী। দেলােয়ার মালশা নিয়ে অতি দ্রুত পুকুরঘাটের দিকে রওনা হল । মনােয়ারা রান্নাঘরের দিকে চললেন। তার রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। পুকুরঘাটের দিকে যেতে ইচ্ছে কাছে।’ 

এই বাড়ির পুকুরঘাটটা মনােয়ারার খুব পছন্দ। ছােট্ট বাধানাে ঘাট, যেন বাড়ির বৌ-ঝিদেরী জনাই করা হয়েছে। বারােয়ারি ব্যাপার না। বিশাল এক কামরাঙ্গা গাছ ঘাটের ওপর ছায়া ফেলেছে। মনােয়ারার ধারণা পৃথিবীর সবচে সুন্দর গাছ কামরাঙ্গা গাছ। কী অদ্ভুত তার চিরল চিরল পাতা। 

শো চোখমুখ শক্ত-শক্ত করে ব্যাটে বসে আছে। চোখমুখ শক্ত করার কারণ একটু আগেই সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে। ভূতের ভয়। তার মন খুব খারাপ ছিল বলে সে একা-একা ঘাটে এসে বসেছিল। বসার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই গা ছমছম করতে লাগল। মনে হল সে একা না, তার আশেপাশে আরো কেউ আছে। একজন তাে মনে হল ঠিক তার পেছনে দাড়িয়ে। সেই একজন।

অল্পবয়েসী একটা ঘােমটা-দেয়া বউ। তার শাড়ির শব্দ, হাতের চুরির শব্দ পর্যন্ত শেFা পেতে শুরু করল। মনে হচ্ছে এই মেয়েটার মতলব ভালাে না, সে এসে শেফার পাশে বসবে। ঘোমটার ভেতর দিয়ে তার দিকে তাকাবে এবং একসময় হাত ধরে টানতে টানতে পানিতে নিয়ে যাবে। ঠিক এ-রকম একটা গল্প সে দেব সাহিত্য কুটিরের বই পড়েছিল। সেই গল্পেও গ্রামের পুকুরঘাট থেকে বাচ্চা একটা ছেলেকে ঘােমটা-পরা বউ ভুলিয়ে ভালিয়ে পানিতে নিয়ে ডুবিয়ে শেফার বুক ধকধক করছে। চিকার করে কাউকে ডাকতে  ইচ্ছা করছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বত্ত বের হচ্ছে না। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওপর তার প্রচণ্ড রাগও হচ্ছে | কেন সে একা-একা ঘাট এল কী দরকার ছিল। শেফার মন। 

মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৫

‘লি চোখ ছােট হয়, ঠোট মােটা হয় এবং গালের চামড়া শক্ত হয় তাহলে ফেস এক্সপ্রেশন লেখা হয়ে যায়। কারণ হাছুি মানুষের একুপ্রেশন হল চোখ 

বেশিরভাগ সময় আমি মন খারাপ করে থাকি–ফেল এক্সপ্রেশন লেখ বলে কেউ বুঝতে পারে না। আজ সারাদিন আমার খুবই মন খারাপ ছিল।’ 

হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখনি মালশী হাতে দেলােয়ার চলে চুল। এত শাস্তি শেফা তার জীবনে পায় নি। ও না, ভুল হয়েছে। এ-রকম শাস্তি শেফা আরেকবরি তার জীবনে পেয়েছিল। সেটা খুবই গােপন ব্যাপার কাউকে বলা যাবে না । 

ছােট আপা, চাচাজী যেতে বলেছে। শো পা দোলাতে দোলাতে বলল, বলুক। দেলোয়ার বল, একা একা বসে আছেন, ভয় লাগে না। 

ভয় লাগবে কেন ? একা একা বসে থাকতে আমার ভালাে লাগছে। দেলােয়ার ভাই, শুনুন । আপনাকে থ্যাংকস দেয়া হয়নি। মেনি থ্যাংকস । চশমার জনে। 

দেলোয়ার হাসল। অন্ধকারে তার হাসি দেখা গেল না। দেলােয়ারের ধারণা সে তার জীবনে এমন সরল সাদাসিধা মেয়ে দেখেনি। আজ সকালে নৌকায় উঠতে গিয়ে মেয়েটার চোখ থেকে চশমা পরে গেল । মেয়েটা তা নিয়ে একটা শব্দ করল না।

 

হুমায়ূন আহমেদের লেখা মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৬

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *