রঙের সঙ্গে যে সম্পর্ক আছে তা তিনি জানেন। কিছু রঙকে বলাই হয় উষ রঙ, ওয়ার্ম কালার—যেমন লাল, হলুদ । কিছু রঙ আবার ঠাণ্ডা রঙ —যেমন নীল।
মনোয়ারা চায়ের মগ নিয়ে বারান্দায় এলেন। আজহার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কই শেফা আর মীরাকে বলেছ ?
মনােয়ারা কুণ্ঠিত গলায় বললেন, ওরা আসবে না।
“আসবে না কেন? বাগানে বসে খেজুরের রস খাবে কত ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। টাটকা রস। ঢাকায় এই জিনিস পাবে কোথায়?
“মীরা শুয়ে আছে। ওর শরীর ভালাে যাচ্ছে না।’
‘সবসময় এক অজুহাত দিও না। শরীর ভালাে যাচ্ছে না মানে কী? এমন একটা ভাব সে ধরে আছে যেন তাকে আন্দামান দ্বীপে এনে ফেলা হয়েছে।’
মনােয়ারা বললেন, ওরা ওদের মতাে করে থাকুক । চল আমরা দুজন বাগানে যাই। যাবে ? দাঁড়াও আমি একটা চাদর নিয়ে আসি।
আজহার সাহেব হ্যা না কিছু বললেন না। তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে গেল । তিনি ভেবে রেখেছেন রস খাবার পর মেয়েদের নিয়ে হাঁটতে বের হবেন। উত্তর বন্ধে মটরটির ক্ষেতের দিকে যাবেন। দেলােয়ার সঙ্গে যাবে। দেলােয়ারের সঙ্গে থাকবে কেরােসিনের চুলা এবং পানি গরম করার পাত্র । মটরশুটির ক্ষেতে বসে মটরশুটি সিদ্ধ করা হবে । তারপর খােসা ছাড়িয়ে মটরশুটি খাওয়া।
আজহার সাহেবের দাদা মুনশি হেলালউদ্দিন এই বাগান করেছিলেন। মুনশি হেলালউদ্দিন মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এক রাতে স্বপ্নে তিনি কয়েকটা রােগের ঔষধ পেয়ে যান।
মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৭
শিক্ষার পাশে-পাশে লােকজনদের অষুধ দেয়া শুরু করেন। কামেলা রােগের অষুধ এবং সূতিকার অষুধ। তার যখন খুব নাম-ডাক হল, দূরের গ্রাম থেকে বোতল নিয়ে অষুধের জন্য লোকজন আসতে শুরু করল, তখন তিনি হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন। তাকে নাকি অষুধ না-দিত স্বপ্নে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অষুধ নিতে এসে লােকজন ফেরত যেতে শুরু করল। এতে তার নাম আরাে ছড়িয়ে পড়ল।
লােকজনের ভিড় বেড়ে গেল। তার কিছুদিন পর গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি পেয়েছেন। শুধু যে পীরাতি পেয়েছেন তাই না, তার পােষা দুটা জ্বীনও আছে। রাতে দরজা বন্ধ করে তিনি জ্বীনদের সঙ্গে কথা বলেন। জ্বীনদের সঙ্গে জিকির করতে বসেন । নতুন পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ এবং পানিপড়া নেবার জন্যে দলে দলে লােক আসতে লাগল। তিনি পানিপড়া এবং তাবিজ দিতে শুরু করলেন । অবিবাহিত মেয়েদের দিতেন সূতাপড়া। কালো রঙের সুত্রায় ফু দিয়ে দিতেন। সেই সূতা খোপায় চুলের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হত। সূতা বাধার দশদিনের ভেতর বিয়ের সম্বন্ধ আসত। নিয়ম হচ্ছে প্রথম যে-সম্বন্ধ আসবে সেখানেই মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। খােপায় সূতা বাঁধা অবস্থায় আসা সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।
. মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি করে অনেক টাকাপয়সা জমিজমা করেছিলেন। তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে পাকা বাড়ি তােলেন। বাড়ির নাম হয়ে যায়
পীরবাড়ি। | হেলালউদ্দিন সাহেবের শেষ জীবন সুখের হয়নি। মাথাখারাপের মতাে হয়ে গিয়েছিলেন। রাতে বা দিনে কখনােই ঘুমাতে পারতেন না। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমুনি আসত, তিনি চোখ বন্ধ করেই সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখে। চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতেন। সবার ধারণা তার পােষা দুটা জ্বীন বিগড়ে গিয়েছিল। তারাই তাকে যন্ত্রণা করত । জীন দুটার একটান্ন লমি হবিব আর একটার নাম জাবির । দুজনের বয়সই চারশর উপর। দুটাই অবিবাহিত। এদের বাড়ি কোহকাফ নগরে। এদের মধ্যে একজন জ্বীন (হবি) আগে হিন্দু ছিলেন পরে মুসলমান হয়েছেন।
মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৭
লােকশ্রুতি হল মুনশি হেলাল উদ্দিন মৃত্যুর সময় ইচ্ছা করে জ্বীন দুটাকে আজাদ করে যাননি। তারা পীরবাড়িতেই আটকা পড়ে আছে । আমৃত্যু তাই থাকবে। গ্রামের অনেক লােক গীরবাড়ির ছাদে দুটা আগুনের হলকাকে নাচানাচি করতে দেখেছে। কেউ কেউ এখনাে দেখে ।
মনােয়ারা এবং আজহার সাহেব খেজুরের রসের গ্লাস হাতে নিয়ে মুনশি হেলালউদ্দিন সাহেবের শখের বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছুেন । আম-কাঠালের বাগান, মাঝখানে কয়েকটা ‘জলপাই গাছ আছে। জলপাই গাছের জায়গাটা আসলেই সুন্দর । উলিপাই গাছের শুকনাে পাতার রঙ গাঢ় লাল। শুকনাে পাতা পড়ে গাছের নিচটা এমন হয়েছে যে মনে হয় কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। দু বছর আগে সবচে বড় জলপাই গাছের গুঁড়ি আজহার সাহেব বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি সেই বাঁধানাে গাছের নিচে বসে আছেন।
মলয়া বললেন, প্রায় দশ বছর পর খেজুরের রস খাচ্ছি। আজাহার সাহেব বললেন, খেতে কেমন লাগছে?
মনােয়ারা মুগ্ধ গলায় বললেন, ভালাে । খুবই ভালাে । বলতে বলতে আগ্রহ নিয়ে গ্রালে চুমুক দিলেন। আসলে তার মােটেই ভালাে লাগছে না। কেমন বমি চলে আসছে, গন্ধটাও খারাপ কেমন পচা-পাতা পচা-পাতা গন্ধ।
মীরার গ্রামের বাড়ি খন্ড-৭
স্বামীকে খুশি করার জন্যে রস খেয়ে মুগ্ধ হবার অভিনয় তাকে করতে হচ্ছে। একজন আদর্শ মহিলাকে অভিনয় করায় অত্যন্ত পারদর্শী হতে হয়। তাদের জীবনের একটা বড় অংশ কাটে আনন্দিত এবং মুগ্ধ হবার অভিনয় করে।
শুকনাে পাতা মাড়িয়ে দেলােয়ার আসছে। দেলােয়ারের গায়ে মাপে বড় হলুদ রঙের একটা কোট। কোটটা আজ সকালেই মনােয়ারা দেলােয়ারকে দিয়েছেন। আজহার সাহেবের কোট। পুরানাে হলেও এখনাে ভালাে। দেলােয়ারের হাতে কেরােসিনের চুলা, এলুমিনিয়ামের একটা কড়াই। মটরটি সিদ্ধ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে সে এসেছে ।
‘চাচাজী চলে যাই। আজহার সাহেব বললেন, দেলােয়ার থাক বাদ লা । মনােয়ারা বললেন, বাল কবে কেন? চল আমরা দুজন যাই।
‘মেয়েরাই ব্যাপারটা এনজয় করত, ওরা যখন যেতে চাচ্ছে না তখন থাক। দেলােয়ার তুমি চলে যাও।
দেলােয়ার চলে গেল । চাচাজার সামনে থেকে যে সে সরে পরার সুযােগ পেয়েছে তাতেই সে খুশি।