‘পারব। কবে আসব?” ‘আজই আস না। বাবার সঙ্গে কথা শেষ করে চলে এসাে। ‘আচ্ছা।
শুভ্র মাহিন সাহেবের শােবার ঘরে ঢুকল। ঠিক ঘর না, এটা এ বাড়ির স্টোর রুম। মাহিন সাহেব অসুস্থ হবার পর এই ঘর থাকার জন্যে বেছে নিয়েছেন। কোন মতে একটা খাট এঘরে পাতা হয়েছে। আর কোন আসবাব রাখার জায়গা নেই। ঘরে একটি টেবিল ফ্যান আছে। সেই ফ্যান মাথার কাছে খাটের উপর বসানাে। ঘরে জানালা নেই। ভেন্টিলেটারটা সাধারণ ভেন্টিলেটরের চেয়ে বড় বলে কিছু আলাে বাতাস ঢুকে।
মাহিন সাহেব দরাজ গলায় বললেন, কেমন আছ শুভ্র? ‘ভাল আছি।
‘আরাম করে পা তুলে বস। চাদর পরিষ্কার আছে। নীতু আজই চাদর বদলেছে। আমি জানতাম তুমি আসবে। তাই চাদর বদলাতে বললাম।
শুভ্র পা তুলে বসল। নীতু চা নিয়ে ঢুকল। শুভ্রর সামনে রাখতে রাখতে বলল, তুমি যাবার সময় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে যাবে। কয়েকদিন অফিসে যাবার সময় বাসায় তালা দিয়ে যেতে হচ্ছে। বাসায় বাবা ছাড়া কেউ নেই। বাড়িওয়ালার কাছে একটা চাবি আছে। তিনি একবার এসে খোঁজ নিয়ে যান। তালা আমাদের বসার ঘরে টেবিলের উপর আছে। শুভ্র, পরে তােমার সঙ্গে দেখা হবে।
‘জি আচ্ছা।
মাহিন সাহেব উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মাথাভর্তি ধবধবে সাদা চুল। দু’সপ্তাহ শেভ করা হচ্ছে না বলে মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি। গায়ের চাদরও সাদা রঙের বলে তাঁকে ঋষি–ঋষি দেখাচ্ছে।
‘চায়ে চিনি হয়েছে শুভ্র ?” ‘হয়েছে। আপনার শরীর আজ কেমন?” ‘অসম্ভব ভাল। ‘রাতে নাকি ঘুম হয় নি?”
মেঘের ছায়া খন্ড-২১
“রাতে আমার কখনাে ঘুম হয় না। এরা জানে না। এই বয়সে ঘুম না হওয়া কোন বড় ব্যাপার না। শােন শুভ্র, তােমার সঙ্গে আমি এখন খুব জরুরি বিষয় নিয়ে কথা বলব। খুব জরুরি। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সিদ্ধান্ত তােমাকে জানাব। খুব মন দিয়ে শােন।।
‘আপনার সব কথাই আমি খুব মন দিয়ে শুনি। | ‘একমাত্র তুমিই শােন। আর কেউ শুনে না। দেখ শুভ্র, আমি এই সংসারে উপদ্রবের মত আছি। পক্ষাঘাত সারার কোন সম্ভাবনা নেই। অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। আগে বাঁ হাতটা নাড়াতে পারতাম, এখন তাও পারি না। শরীর অসুস্থ হলে মনও অসুস্থ হয়। আমার মনও এখন অসুস্থ। রাত–দিন চেঁচামেচি করি। আমার চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমার স্ত্রী এক সপ্তাহ ধরে তাঁর ভাইয়ের বাসায় আছেন। কাজের মেয়ে ছিল। সে পালিয়েছে তিনদিন আগে। তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ?”
‘শুনছি।
‘আমি এদের ঘাড়ে ভূতের মত চেপে আছি। সিন্দাবাদের ভূত। এরা আমাকে কি করে ঘাড় থেকে নামাবে বুঝতে পারছে না।
এরা আপনাকে ঘাড় থেকে নামাতে চাচ্ছে এরকম মনে করছেন কেন? ‘মনে করাই তাে স্বাভাবিক। নীতু বিয়ে করতে পারছে না আমার জন্যে। একটা ছেলের সঙ্গে তার ভাবটাব হয়েছে বলে মনে হয়। ওদের অফিসেই কাজ করে। কয়েকবার এ বাড়িতে এসেছে। কখনাে আমার সঙ্গে দেখা করেনি। নীতুর সঙ্গে গল্প করে চা–টা খেয়ে চলে গেছে। আমি যতদিন বেঁচে আছি নীতু বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করতে পারবে না। এটা হল বাস্তব কথা। আমি ওদের মুক্তি দিতে চাই। বুঝলে শুভ্র? চির মুক্তি!
‘কিভাবে?
“সেটা নিয়েই ভাবছি। আত্মহত্যা সহজ পথ, তবে খুবই নিম্নমানের পথ। আত্মহত্যা খুনের চেয়েও খারাপ। খুন করার পর অনুশােচনার একটা সুযােগ থাকে। আত্মহত্যার পর সেই সুযােগও থাকে না।
মেঘের ছায়া খন্ড-২১
‘আপনি কি আত্মহত্যার কথা ভাবছেন?
‘এখনাে ভাবছি না। অন্য পথ আর কি আছে খুঁজে বেড়াচ্ছি। পাচ্ছি না। আমি হয়েছি পরাশ্রয়ী। নিজে নিজে খেতে পারি না। অন্যকে খাইয়ে দিতে হয়। আমার কোন উপার্জন নেই। বেঁচে থাকার জন্যে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে সবদিক রক্ষা হত। চট করে তা হবে বলে মনে হয় না। আমার মানসিক শক্তি এখনাে প্রবল। আমার মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য আমাকে আরাে সাত–আট বছর অপেক্ষা করতে হবে। সাত–আট বৎসর নীতু আমার জন্যে অপেক্ষা করবে – এটা উচিত না।
শুভ্র বলল, আপনার জন্যে সিগারেট এনেছি। ধরিয়ে দেব? ‘দাও।
মেঘের ছায়া খন্ড-২১
শুভ্র সিগারেট ধরিয়ে মাহিন সাহেবের ঠোটে খুঁজে দিল। তিনি ধোঁয়া ছেড়ে তৃপ্তির গলায় বললেন, বেঁচে থাকতে আমার এখনাে ইচ্ছা করে। এই যে ধোয়ার সঙ্গে নিকোটিন নিচ্ছি —শরীর আরাম পাচ্ছে। তােমার সঙ্গে কথা বলছি তাতেও আনন্দ পাচ্ছি। আনন্দের ব্যাপার এখনাে আছে তবে তাকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হবে কি–না সেটাই বিচার্য। সমস্ত জীবজগতের একটা সহজ নিয়ম আছে। অসুস্থ, দুর্বল, অক্ষম কাউকে জীবজগৎ সহ্য করে না। সাধারণত তাকে মেরে ফেলে কিংবা এমন ব্যবস্থা করে যেন মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। একটা কাক অসুস্থ হলে অন্য কাকরা কি করে জান ?”
‘তাকে ঠুকরে ঠুকরে মেরে ফেলে। অসুস্থ কাক কোন প্রতিবাদ করে না। চুপ করে বসে থাকে।
‘আপনি তাে কাক না। আপনি মানুষ।
‘মানুষ হলেও আমি সমগ্র জীবজগতেরই একটা অংশ। জীবজগতের সবার জন্যে যা সত্যি — তা আমার জন্যেও সত্যি।
‘চাচা, আমার মনে হয় কোন কারণে আপনার মন–টন খারাপ বলে এ জাতীয় চিন্তা–ভাবনা করছেন।
‘সহজে আমার মন খারাপ হয় না। তবে এখন হচ্ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রেগে যাচ্ছি। এগারােই সেপ্টেম্বর দিন সাবেরের মৃত্যুদিন। এরা দেখি এই দিনটার কথা ভুলে গেছে। কারাের মনেই নেই কি অসম্ভব যন্ত্রণা নিয়ে ছেলেটা আমার কোলে মারা গেল!
Read More