মিজান সাহেব বেশ স্বাভাবিক আছেন। তিনি নাপিতের দোকান থেকে চুল কাটিয়েছেন। একেবারে কদমছাট। মাথাটা কালো রঙের কদম ফুলের মতই দেখাচ্ছে। চুল কাটার জন্যেই তাকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। এ ছাড়া তার মধ্যে আর কোন অস্বাভাবিকতা নেই। কথাবার্তা, চালচলন খুব স্বাভাবিক। হঠাৎ হঠাৎ স্ত্রীর। দিকে তাকিয়ে দু–একটা কুৎসিত বাক্য বলে আবার স্বাভাবিক হয়ে যান।
যেমন, আজ দুপুরে ভাত খাওয়ার সময় সহজভাবে ভাত খাচ্ছিলেন, হঠাৎ মনােয়ারার দিক তাকিয়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, মাগী, তুই তরকারিতে লবণ দেস না কেন? আমার কি লবণ কেনার পয়সাও নাই? মানােয়ারা কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিলেন, কাঁদলেন না। কাঁদলে আবার কোন বিপত্তি ঘটে। তিনি ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে লবণ নিয়ে এলেন।
ততক্ষণে মিজান সাহেব স্বাভাবিক। তিনি কোমল গলায় বললেন, মনু, তুমি একসঙ্গে খেয়ে ফেল না কেন? একসঙ্গে খেয়ে ফেললে ঝামেলা কমে। কাজের। লােক একটা রাখতে হবে। কাজের লােক ছাড়া সংসার চালানাে সম্ভব না। তুমি একা কদিক দেখবে? | সৌভাগ্যের সংবাদ বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতে হয়। দুর্ভাগ্যের সংবাদ দিতে হয়।
মেঘের ছায়া খন্ড-২৭
সবাই জেনে যায়। ঢাকায় মিজান সাহেবের সব আত্মীয়স্বজনই খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা দেখতে আসছেন। পাগল দেখা এবং পাগলের সঙ্গে কথাবার্তা বলার এক আলাদা মজা। মিজান সাহেব সবাইকেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করলেন। কোন রকম পাগলামি দেখালেন না। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বললেন, হাসলেন।
জাহেদ সন্ধ্যবেলা মামাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার মিজান সাহেবের অফিসের এক কলিগের ভায়রা ভাই। সেই কলিগই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মস্তিষ্ক বিকৃতির জন্যে খুব ভাল ডাক্তার। অর্ধেক ফি–তে তিনি রােগী দেখে দেবেন। অর্ধেক ফি–তে যে সব রােগী দেখা হয় তাদের পেছনে ডাক্তাররা অর্ধেকেরও কম সময় ব্যয় করেন।
উপসর্গ শােনার আগেই ব্যবস্থাপত্র লেখা হয়ে যায়। তবে এই ডাক্তার অনেক সময় ব্যয় করলেন। নানান ধরনের প্রশ্ন ঐশ্ন করে বললেন, আমি তাে কিছু পাচ্ছি না। আমার মনে হয় আপনারা অকারণে বেশি দুঃশ্চিন্তা করছেন। উনার মূল সমস্যা কি?
জাহেদ অস্বস্তির সঙ্গে বলল, হঠাৎ রেগে যান। মামীর সঙ্গে কুৎসিত ব্যবহার করেন। গালাগালি করেন।
স্ত্রীর প্রতি মাঝে মাঝে রেগে যাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক? আমরা সবাই কখনাে কখনাে রাগি ।
মেঘের ছায়া খন্ড-২৭
জাহেদ বলল, কিন্তু উনার মনে থাকে না যে উনি রেগেছেন। তাছাড়া মামা আগে কথা প্রায় বলতেন না, এখন প্রচুর কথা বলেন। সারাক্ষণই কথা বলেন।
‘উনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন? “জ্বি বলেন। রাত জেগে গল্প করেন।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমার ধারণা, এক ধরনের নার্ভাস শকের ভেতর দিয়ে উনি গেছেন। স্নায়ুর উপর দিয়ে বড় ধরনের কোন ঝড় বয়ে গেছে। ঝড়ের কারণে স্নায়ুর তন্ত্রীতে এক ধরনের ধাক্কা লেগেছে। সাময়িক বিকল অবস্থা যাচ্ছে। এটা কিছুই না। ঠিকমত খাওয়া–দাওয়া করতে হবে। ঘুমুতে হবে।
সবচে’ ভাল হয় যদি স্থান পরিবর্তন করা যায়। আপনি বরং আপনার মামাকে নিয়ে কোথাও যান, ঘুরে–টুরে আসুন। | কথাবার্তা মিজান সাহেবের সামনেই হচ্ছে। তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। ডাক্তার সাহেব থামতেই বললেন, এটা মন্দ বুদ্ধি না। জাহেদ, চল গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। টাটকা–টাটকা খেজুরের রস খেয়ে আসি। অনেকদিন খেজুরের রস খাওয়া হয় না।
ডাক্তার সাহেব বললেন, ভাল বুদ্ধি। যান, গ্রাম থেকে ঘুরে আসুন।
মেঘের ছায়া খন্ড-২৭
জাহেদ তার মামাকে নিয়ে বিমর্ষ মুখে বের হয়ে এল। ডাক্তার সাহেব লম্বা প্রেসক্রিপশন করেছেন। নানান ধরনের ভিটামিন, হজমের অষুধ, ঘুমের অষুধ। তিনশ’ টাকা চলে গেল অষুধে। মিজান সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, অষুধে। কোন কাজ হবে না। আমার দরকার গ্রামের খােলা হাওয়া। রাত এগারােটায় বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস আছে। চল বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেসে চলে যাই। ট্রেনেও অনেকদিন চড়া হয় না। ভালই হল। আজ লজ্জা ভেঙ্গেই যাবে।
মামাকে বাসায় রেখে জাহেদ গেল কেয়ার সঙ্গে দেখা করতে। পুরাে দু’দিন চলে গেছে কেয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি। গতকাল একবার এসেছিল। লজ্জায় সিড়ি ভেঙ্গে উঠতে পারেনি।
জালিল সাহেব দরজা খুলে দিয়ে হাসিমুখে বললেন, আরে দূলামিয়া যে! হা হা।
হা। আসুন, আসুন। আপনি আসবেন বুঝতে পারছিলাম।
মেঘের ছায়া খন্ড-২৭
জাহেদ শুকনো গলায় বলল, কেমন আছেন?
‘আলহামদুলিল্লাহ ( ভাল আছি। আপনার ব্যাপারটা কি বলুন দেখি ? বিয়ে করে বৌ ফেলে চলে গেলেন। নাে পাত্তা। ব্যাপারটা কি? আমার আটত্রিশ বছরের জীবনে এমন ঘটনা শুনি নি।
জাহেদ বলল, কেয়া আছে? | ‘আছে, আছে – যাবে কোথায়? ঘরেই আছে। জ্বর হয়েছে শুনেছি। আমি ঠাট্টা করে বলেছি — বিরহ জ্বর। হা হা হা।।
‘কেয়াকে একটু খবর দেবেন?” : আরে কি মুশকিল! আমি খবর দেব কেন? আপনি হলেন এ বাড়ির জামাই। আপনি সুরসুর করে ভেতরে ঢুকে যান। আমি কে? আমি হলাম আউটসাইডার।
জাহেদকে ভেতরে ঢুকতে হল না। কেয়া বের হয়ে এল। তার গায়ের। একশ’ দুইয়ের কাছাকাছি। অসহ্য মাথার যন্ত্রণা। মনে হচ্ছে মাথা ছিড়ে পড়ে যাবে। কিন্তু সে বেশ স্বাভাবিক। জাহেদের দিকে তাকিয়ে হাসল। নরম গলায় বলল, চল ছাদে যাই।
Read More