ফুপিয়ে ফুপিয়ে কে যেন কঁদছে।
মাহিন সাহেব কান্নার শব্দ শুনছেন। সব শব্দ তাঁর চেনা। এই কান্নার শব্দ অপরিচিত। অবশ্যি তিনি জানেন কে কঁদছে। এ বাসায় তিনি ছাড়া আর একজন মানুষই বাস করে – নীতু। নীতুই কাঁদছে। নীতু ছাড়া আর কে হবে? কিন্তু এরকমভাবে কাদছে কেন? মাহিন সাহেব ডাকলেন, নীতু! নীতু !
নীতু দরজা ধরে দাঁড়াল। মাহিন সাহেব বললেন, কি করছিলি? ‘রুটি বানাচ্ছিলাম। তুমি রুটি খাবে রাতে। ‘কাঁদছিলি নাকি?”
‘না, কাদছিলাম না। কথায় কথায় আমি কাঁদি না। তাছাড়া কাদার মত কিছু হয়নি।
‘আমি ভুল শুনলাম?
‘হ্যা, তুমি ভুল শুনেছ। অনেক দিন থেকেই তুমি ভুল চিন্তা করছিলে। এখন তুমি ভুল শােনাও শুরু করেছ।
‘আয় আমার কাছে। বােস। ‘আমার রুটি বানাতে হবে, বাবা।
‘রুটি পরে বানালেও হবে। না বানালেও অসুবিধা নেই। রাতে আমি কিছু খাব না। তুই আমার কাছে এসে বােস।
মেঘের ছায়া খন্ড-৩১
নীতু বাবার কাছে বসল। মাহিন সাহেব বললেন, মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছা করে তাের মাথায় হাত রেখে আদর করি। ইচ্ছা করলেও পারি না। মহাশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আমার সেই অধিকার হরণ করেছেন।
নীতু বলল, তুমি কি কোন দীর্ঘ বক্তৃতা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ, বাবা? দীর্ঘ বক্তৃতা শােনার ইচ্ছা আমার নেই। ছােটবেলা থেকে তােমার দীর্ঘ বক্তৃতা এত শুনেছি যে বক্তৃতা ব্যাপারটা থেকে আমার মন উঠে গেছে।
‘তাও আমি জানি। বক্তৃতা দেয়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন আমি আমার সব কথা শুভ্র’র জন্যে জমা করে রাখি। সে এলে তাকে বলি।
‘ভাল। কথা শােনাবার একজন কেউ আছে। ‘তাের নেই?
না, আমার নেই। আমার কথা শােনাবার কেউ নেই।
মাহিন সাহেব গলার স্বর তীক্ষ্ণ করে বললেন, যে ছেলেটিকে তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস সে তাের কথা শুনে না?
‘তাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। সবাইকে সবকিছু বলা যায় না। আমি এখন যাই – তােমার খাবার রেডি করি।
মেঘের ছায়া খন্ড-৩১
‘কিছু রেডি করতে হবে না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু খাব না। ‘সিদ্ধান্ত কখন নিলে? ‘গতকাল নিয়েছি। আজ তা কার্যকর করতে যাচ্ছি। ‘তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি খাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছ?” ‘হঁ্যা।। ‘কেন?”
‘আমার পক্ষে একা একা বাস করা সম্ভব না। আমি একজন পরজীবী। রাস্তায় ভিক্ষা করে জীবনযাপন করব তাও সম্ভব না। অবাস্তব পরিকল্পনা।
‘না খেয়ে থাকার পরিকল্পনা বাস্তব ? ‘এটি অবাস্তব, তবে আমি কোন বিকল্প পাচ্ছি না।”
না খেয়ে না খেয়ে তুমি মারা যাবে এটিই কি তােমার পরিকল্পনা?” ‘হ্যা। তবে মৌলিক পরিকল্পনা না। আমার আগেও একজন তা করে গেছেন। তার নাম লিয়াওসিন – চৈনিক কবি। তিনি অবশ্যি করে গেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। তিনি মৃত্যু কি, মৃত্যু কিভাবে মানুষকে গ্রাস করে তা জানার জন্য উপবাস শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগুতে থাকেন। তুই কি শুনতে চাস তাঁর অভিজ্ঞতার কথা ?
‘তাের শুনতে ভাল লাগবে। মৃত্যুর কাছাকাছি পোছে যাবার সময় তিনি বেশকিছু ত্রিপদী কাব্য রচনা করেন। তার আক্ষরিক অনুবাদ ইংরেজিতে করা হয়েছে। ইংরেজি থেকে আমি কিছু কিছু বাংলা করেছিলাম। শুনবি?”
‘না, শুনব না।” ‘আচ্ছা একটা শােন –
“দিন হল রাত্রি, এবং রাত্রি হল দিন মাথার ভেতর উঠল বেজে এক সহস্র বীণ।”
মেঘের ছায়া খন্ড-৩১
নীতু উঠে চলে গেল। মাহিন সাহেব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি তার পরিকল্পনায় মােটামুটি স্থির । খাওয়া বন্ধ। এই ভাবেই তিনি এখন মৃত্যুর দিকে এগুবেন। সবাইকে মুক্তি দিয়ে যাবেন। কাউকে আনন্দ দেবার ক্ষমতা এখন তাঁর নেই। কিন্তু মুক্তি দেবার ক্ষমতা তার অবশ্যই আছে। আবারাে কান্নার শব্দ শুনছেন। রান্নাঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে। নীতুই কাঁদছে।
নীতু! নীতু! নীতু ঘরে ঢুকল না। রান্নাঘর থেকেই বলল, কি ? ‘তুই কি শুভ্রকে একটু খবর দিতে পারবি? ওর সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। খুব জরুরি।
‘খবর দেব। ‘আজ খবর দিবি?” “হ্যা, আজই দেব।” ‘তাের মা‘কে খবর দিতে পারবি? তাের মা‘র সঙ্গেও আমার কথা বলা দরকার।
‘মা’কে খবর দেয়া যাবে না। মা ঢাকায় নেই। রাজশাহী গিয়েছেন। ছােট খালার মেয়ের বিয়ে।
Read More