রেহানা গ্লাসভর্তি তেতুলের সরবত নিয়ে যাচ্ছিলেন, শুভ্র’র ঘরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। চাপা হাসির শব্দ আসছে। শুভ্র হাসছে। রাত একটা বাজে। শুভ্রের ঘরের বাতি নেভানাে। সে অন্ধকারে হাসছে কেন? মানুষ কখনাে অন্ধকারে হাসে না। কাঁদতে হয় অন্ধকারে, হাসতে হয় আলােয়। রেহানা ডাকলেন, শুভ্র !
শুভ্র হাসি থামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, কি মা? ‘কি করছিস?” ‘ঘুমুচ্ছিলাম, হঠাৎ ঘুম ভাঙল। রাত কত মা?” ‘একটা বাজে। তাের কি কিছু লাগবে?
না। শুভ্র আবার হাসছে।শব্দ করে হাসছে। রেহানা চিন্তিত মুখে সরবতের গ্লাস নিয়ে শােবার ঘরে ঢুকলেন। কেন জানি শুভ্রকে নিয়ে তার চিন্তা লাগছে। তাঁর মনে হচ্ছে শুভ্র’র কোন সমস্যা হয়েছে। ইয়াজউদ্দিন সাহেব খালি গায়ে ফ্যানের নিচে বসে আছেন। কার্তিক মাস, ঠাণ্ডা–ঠাণ্ডা লাগছে। শীত নেমে গেছে।
ঘুমুতে হয় গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে। এই সময়ে খালি গায়ে ফ্যানের নিচে বসে থাকার অর্থ হয় না। ইয়াজউদ্দিন সাহেব বসে আছেন, কারণ তাঁর গরম লাগছে। অল্প–অল্প ঘাম হচ্ছে। বুকে চাপা ব্যথা অনুভব করছেন। তাঁর ধারণা, তিনি হার্ট এ্যাটাক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য যে–কেউ এই অবস্থায় ঘাবড়ে যেত। ইয়াজউদ্দিন সাহেব খুব স্বাভাবিক আছেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, গ্লাসে কি?
‘তেতুলের সরবত। বিট লবণ, চিনি, তেতুল। খাও, ভাল লাগবে।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব কোন তর্কের ভেতর গেলেন না। গ্লাস হাতে নিলেন। রেহানার নির্বুদ্ধিতায় মাঝে মাঝে তিনি পীড়িত বােধ করেন। আজও করছেন। তাঁর কি সমস্যা রেহানা জানে না। রেহানাকে বলা হয় নি। অথচ সে তেতুলের সরবত নিয়ে এসেছে, এবং রেহানার ধারণা হয়েছে এই সরবত খেলে ইয়াজউদ্দিন সাহেবের ভাল লাগবে। কে তাকে এই সব চিকিৎসা শিখিয়েছে?
মেঘের ছায়া খন্ড-১
বছর দুই আগে তাঁর একবার তীব্র পেটব্যথা শুরু হল। রেহানা এক গ্লাস বরফ–শীতল পানি নিয়ে এসে উপস্থিত, পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল, পানিটা খাও, ভাল লাগবে। তিনি খেয়েছেন। আজও তাই করলেন, হাত বাড়িয়ে তেতুলের সরবত নিয়ে দু’চুমুক খেয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। রেহানা বললেন, ভাল লাগছে না?
‘হ্যা, ভাল লাগছে। ‘চিনি কম হয়েছে, আরেকটু চিনি দেব?” ‘চিনি ঠিকই আছে। ‘শরীরটা কি এখন ভাল লাগছে ?” ‘হ্যাঁ, ভাল লাগছে। ফ্যান একটু বাড়িয়ে দাও।
ইয়াজউদ্দিন সাহেবের শরীর মােটেই ভাল লাগছে না। নিঃশ্বাস নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। বসে থেকে স্বস্তি পাচ্ছেন না। শুয়ে পড়লে হয়ত ভাল লাগত। তিনি ঘড়ি দেখলেন, একটা দশ বাজে। ঘরে আলাে জ্বলছে। আলাে চোখে লাগছে। মানুষের। অসুস্থতার প্রথম লক্ষণ হচ্ছে – আলাে অসহ্য বােধ হওয়া। অসুস্থতা মানুষকে আলাে থেকে অন্ধকারে নিয়ে যেতে চায়।
রেহানা বললেন, তুমি কি বারান্দায় এসে বসবে? বারান্দায় হাওয়া আছে। হাওয়ায় বসলে তােমার ভাল লাগবে। ‘চল বারান্দায় যাই। ‘সরবতটা খাবে না?
মেঘের ছায়া খন্ড-১
ইয়াজউদ্দিন স্ত্রীর সাহায্য ছাড়াই উঠে দাঁড়ালেন। বারান্দায় গিয়ে বসলেন। পুরানো ধরনের এই বাড়ির পেছনে লম্বা টানা ঝুল–বারান্দা। বারান্দার এক মাথায় তিনটি বেতের চেয়ার ছাড়া কোন আসবাব নেই। চেয়ার তিনটি দেয়াল ঘেসে পাশাপাশি সাজানাে। সাদা রঙ করা, গদি সবুজ।
মাঝখানের চেয়ারটা তাঁর। দীর্ঘ দশ বছরে তিনি কখনাে মাঝের চেয়ার ছাড়া কোথাও বসেননি। আজ বসলেন। তিনি সর্ব দক্ষিণের চেয়ারে বসেছেন। মাঝেরটা খালি। তিনি ভেবেছিলেন, রেহানা এই ব্যাপারটা ধরতে পারবে। সে মনে হচ্ছে ধরতে পারেনি। রেহান। তাঁর পাশের চেয়ারে বসেনি। মাঝখানে একটা খালি চেয়ার রেখে তৃতীয় চেয়ারটিতে বসেছে।
Read More
হুমায়ূন আহমেদের লেখা মেঘের ছায়া খন্ড-২