হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-১০

একশ’ টাকার নােট দিয়ে এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট আনতে তাকে পাঠালে সে সিগারেট আনবে। সঙ্গে দু’টা দেয়াশলাই আনবে, শুধু বাকি টাকাটা ফেরত দেবে না। এমন ভাব করবে যেন এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এবং দুটা দেয়াশলাইয়ের দাম কাঁটায় কাঁটায় একশ’ টাকা।

লিলুয়া বাতাস

বাবলু! জি জহির ভাই। আজকের কাগজে বিনােদন পাতা ছাপা হয়েছে । সেটা পড়েছিস? 

নীলার ছবি ছাপা হয়েছে বিনােদন পাতায়। তাই নাকি? 

পরিচালক মুকুল সাহেব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দৃশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন, এরকম একটা ছবি । নীলা আছে পরিচালকের পাশে, সে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পরিচালক সাহেবের কথা গিলছে এমন ভাব । পেপারটা হাতে নিয়ে ছবিটা দেখ। 

আমি ছবি দেখলাম। জহির ভাই ভুল বলেন নি। নীলা ফুপু সত্যি সত্যি বিকট হাঁ করে আছে। নীলা ফুপু জহির ভাইয়ের চেয়ে এক দু’বছরের ছােট। জহির ভাই তাকে সে জন্যেই নাম ধরে ডাকে। সম্পর্ক হিসেবে জহির ভাইয়েরও উচিত তাকে ফুপু ডাকা । তা সে ডাকবে না । আমার ক্ষীণ সন্দেহ, জহির ভাই নীলা ফুপুকে খুবই পছন্দ করে। যদিও এই পছন্দের ব্যাপারটা সে কখনাে বলে নি। একবার ফুপুর অ্যাপেন্ডিস অপারেশন হয়। তাঁকে সারারাত হাসপাতালে থাকতে হলাে। জহির ভাইও সারারাত কাটালেন হাসপাতালের বারান্দায়। 

জহির ভাই দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, বাবলু শােন, নীলার কি ঐ পরিচালক সাহেবের সাথে খুব ভাব ? মনে হয় ভাব । তোদের বাসায় আসে মাঝে-মধ্যে? আমি কখনাে আসতে দেখি নি । বােধহয় আসে না। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-১০

নীলা যদি চা খাবার দাওয়াত দেয় তাহলে আসবে না ? বাসায় আসল, চা। কেক চানাচুর খেল। আমি তার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলাম। 

তােমার পরিচয় করার দরকার কী ? বিখ্যাত একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকা ভালাে না ? 

জহির ভাই হাসছেন। এই হাসি আগের হাসির মতাে সুন্দর না। যে মানুষ সুন্দর হাসি হাসে, সে অসুন্দর হাসিও হাসে। কিন্তু সে নিজে কি সেটা জানে ? 

জহির ভাই, তােমাকে একটা প্রশ্ন করব। উত্তর দিতে চাইলে দেবে। দিতে চাইলে নাই। 

কঠিন প্রশ্ন ? 

 প্রশ্নটা সােজা, তবে উত্তর বেশ কঠিন। তুই হেঁয়ালিতে কথা বলা শুরু করেছিস কবে থেকে? প্রশ্ন কর। দি ইমেজের মালিককে তুমি গুলি করেছ, তাই না? হ্যা। আর কে করবে? তুই বুঝলি কী করে? 

তােমার ডানহাতে গুলি লেগেছে, সেখান থেকে বুঝতে পেরেছি। তুমি লেফট হ্যান্ডার। পিস্তল থাকবে তােমার বাঁ হাতে। নিজেকে যদি গুলি কর তাহলে ডান হাতেই গুলি করবে। 

Good logical deduction, ফেলুদার বই আজকাল বেশি বেশি পড়ছিস -কি ? 

পুলিশ ভাইজান কফি নিয়ে এসেছে। কফির সঙ্গে সে নিজ থেকেই এক প্যাকেট নােনতা বিসকিটও এনেছে। জহির ভাই কফিতে বিসকিট ভিজিয়ে বেশ মজা করে খাচ্ছেন। চায়ে বিসকিট ভিজিয়ে লােকজন খায়। কফিতে বিসকিট ভিজিয়ে কেউ খায় বলে আগে শুনি নি। 

জহির ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কি ম্যাকবেথ ভাইজানকে চিনিস ? 

-তাে! 

চিনলেও চলবে। ম্যাকবেথ ভাইজান জীবন সম্পর্কে কী বলেছেন মন দিয়ে শােন। 

Life is a tale 

Told by an idiot, full of sound and fury, 

Signifying nothing. বুঝেছিস কিছু ? 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-১০

সারকথাটা হলাে, জীবন চিল্লাফাল্লা ছাড়া কিছু না। জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনার কিছু নাই।যা তুই এখন বিদেয় হ। আমি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাব। 

দুপুরে বিরানি খাব না ? 

আরেকদিন এসে খেয়ে যাবি। টেবিলের উপর দেখ, হলুদ রঙের ট্যাবলেট আছে, দে। খেয়ে ঘুম দেই। 

ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হবে কেন ? ওষুধ না খেয়েই বা ঘুমাতে হবে কেন ? 

আমি উঠে দাঁড়ালাম। কেবিন থেকে বের হবার সময় পুলিশ বলল, ছােটভাই, আবার আসবেন। 

খিরসাপাতি আম মুখে দিয়ে বড়খালা খুব রাগ করলেন। আমার দিকে আগুন আগুন চোখে তাকিয়ে বললেন, এটা খিরসাপাতি ? 

খিরসাপাতি না ? 

মিষ্টি, না টক— এটা কী ? তুই খেয়ে আনিস নাই ? 

অন্যের পয়সা নষ্ট করছিস, এইজন্যে খেয়ে আনিস নাই। অন্যের পয়সা নষ্ট করতে মজা লাগে ? যা আম ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আয়। এরা ফেরত নিবে না। গরিব মানুষ। এরা রাস্তার পাশে ঝুড়ি নিয়ে বসে। বিক্রি করা আম ফেরত নিলে এদের পােষে না।। 

তুই ফুটপাত থেকে খিরসাপাতি আম কিনে এনেছিস ? এটা ফুটপাতের আম? যা, আম নিয়ে বিদায় হ। ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আয় । এক্ষুনি যা। 

যে আমের অর্ধেকটা তুমি খেয়েছ সেটা তাে ফেরত নিবে না। অবশ্যই ফেরত নিবে। তার বাপ ফেরত নিবে । 

খুবই আশ্চর্যের কথা, আমওয়ালা আম ফেরত নিল । আমাকে বলল, কেন ফেরত নিব না? আপনে রইদে ঘামতে ঘামতে আসছেন। চউখ-মুখ লাল হয়ে গেছে— আমি ফেরত নিব না— এটা কেমন কথা! তবে বাবা, এই আম কিও আসল খিরসাপাতি। মধুর চেয়ে মিষ্ট। নেন একটা খান। কোনাে দাবি নাই । একটা দু’টা যে কটা ইচ্ছা খান। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-১০

আমি আম খেলাম। আমওয়ালা কথা ভুল বলে নি। আসলেই মধুর মতাে মিষ্টি। বড়খালার কাছে পানশে লাগল কেন কে জানে। 

আমার নাম রমজান। বাপে রােজার মাসের নামে নাম রাখছে বইল্যা মিথ্যা বলতে পারি না। মিথ্যা ব্যবসাও করতে পারি না। নামের কারণে ধরা খাইছি। আম মিষ্টি কিনা বলেন ? 

অবশ্যই মিষ্টি আমের মিষ্টি কিন্তু মূল না। চিনিও মিষ্টি। চিনি কি আম? আমের আসল স্বাদ ঘেরানে। একটা আম আছে দিনাজপুর এলাকায় হয়, নাম কদমখাস । খুবই অল্প পরিমাণ হয় । পাওয়া যায় না বললেই হয়। কদমখাস যে একবার খাইছে তার মুখে অন্য আম রুচবে না। হিমসাগর, গােপালভােগ মুখে নিয়া থু কইরা ফেলবে। 

কী নাম বললেন ? কদমখাস। কদমখাস আম খেতে ইচ্ছা করছে। 

এক সপ্তাহ পরে খোজ নিয়েন। দেখি খাওয়াইতে পারি কিনা। আল্লাহপাকের হুকুম হইলে খাওয়াইতে পারব। হুকুম না হইলে উপায় নাই। এই যে এত ভালাে আম আপনে ফেরত আনছেন আল্লাহপাক হুকুম করেছেন বলে ফেরত আনছেন। 

আম ফেরত আনার মতাে তুচ্ছ বিষয়েও আল্লাহপাক হুকুম দিবেন ? 

অবশ্যই। যিনি সব কিছু হিসাবের মধ্যে রাখেন তার কাছে কোনাে কিছুই তুচ্ছ না। নেন, এই আমটা খান । দাবি ছাড়া দিতেছি। আপনের সাথে আমিও একটা খাব । 

এই আমটার নাম কী ? 

অনেকে অনেক নামে ডাকে, আসল নাম মধুমুখা । 

মধুমুখা ? 

জি মধুমুখা। এই আমের মুখ মধুর মতাে মিষ্টি। মুখ থাইকা যতই নিচে নামবেন ততই চোকা হবে। এইটা আরেক মজা। 

লিলুয়া বাতাস খন্ড-১০

দু’জন দুটা মধুমুখা খেয়ে শেষ করলাম। রমজান মিয়া ঝুড়ি বেছে আরাে দু’টা আম বের করল, নাম সন্ন্যাসীভােগ।খান খান, কোনাে দাবি নাই । আপনের উছিলায় আমি খাইতেছি। আল্লাহপাক হুকুম করেছেন আমার এই দুই পিয়ারা বান্দা আষাঢ় মাইস্যা রইদে বইসা আম খাবে । আম খায়া মজা পাবে । এই দুই বান্দার মজা দেইখা আমি খুশি হবাে। উনার হুকুমেই আমরার খাইতে হইতেছে। নিজের ইচ্ছায় তাে কিছু করার উপায় উনি রাখেন নাই । উনি আজিব একজন। 

আমরা মহানন্দে আম খেয়ে যাচ্ছি । আগুনঝরা রােদ উঠেছে। কাক রােদ বৃষ্টি নিয়ে মাথা ঘামায় না, আজ তারাও ছায়া খুঁজছে। কয়েকটা কাক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় বসে ঝিমাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। আকাশ নীল কাচের মতাে ঝকঝকে। আকাশের দিকে তাকালে দৃষ্টি ঠিকরে আসে। 

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, লু হাওয়ার মতাে গরম হাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ কোত্থেকে যেন শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। যতবারই এই হাওয়া লাগছে ততবারই আমি চমকে উঠছি। রমজান মিয়া গামছা দিয়ে মুখে লেগে থাকা আমের রস মুছতে মুছতে বলল, এই যে ঠাণ্ডা হাওয়া হঠাৎ কইরা আহে, এই হাওয়ার নাম লিলুয়া বাতাস । আল্লাহপাক তার রহমতের জানালা মাঝেমধ্যে খােলেন, তখন এই হাওয়া আহে। আইজ আমাদের উপরে আল্লাহর রহমত নাজেল হইছে। সােবাহানাল্লাহ্। 

 

Read More

হুমায়ূন আহমেদের লেখা লিলুয়া বাতাস খন্ড-১১

 

 

 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *